অতীতের দুই ছায়ামূর্তি। রান্নাঘরে গোটা কয়েক ভাঙা প্লেট, কয়েকটা হাঁড়িকুড়ি। বসার ও শোওয়ার ঘরে আসবাব বলতে প্রায় কিছুই নেই। দামি জিনিসপত্র যাও বা ছিল প্রথম প্রথম বন্ধক দিতেন সভে্তলানা, তারপর শুরু করলেন বিক্রি করতে। শেষকালে বিক্রি করার মতো কিছুই অবশিষ্ট রইল না। টেলিভিশন, রেকর্ড প্লেয়ার ভাঙা, তাই বিক্রি করা যায়নি। মেঝেতে হাবিজাবি জিনিসের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে বইপুথি– ‘ধুলোমাটি’ ‘ধানকানা’র সাম্প্রতিক সংস্করণও আছে তার মধ্যে।
২৬.
স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে
প্রথম প্রকাশের দীর্ঘ তিরিশ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ‘ধুলোমাটি’র জন্য ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ পেলেন ননী ভৌমিক। বিলম্বে হলেও এক ধরনের স্বীকৃতি। কিন্তু তাঁর নিজের কাছে স্বীকৃতি পেল কোথায় তাঁর লেখক সত্তা? প্রায় তখন থেকে সমস্ত পুরস্কার তিরস্কারের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
রহস্য কাহিনির মতোই রহস্যজনক আমার মনে হয়েছে ননী ভৌমিকের জ্ঞাতসারে জীবন অপচয়ের কাহিনি। ননীদার সেই পরিণতির কথা ভাবতে গেলে আমার কেন যেন বারবার মনে পড়ে যায় অন্ধত্বপ্রাপ্ত মিলটনের সেই নিদারুণ উক্তিটি: ‘And that one Talent which is death to hide.’ বোঝাতে পারলাম না বোধহয়। তাহলে স্মরণ করতে হয় বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’-এর অন্তর্ভুক্ত Talent সংক্রান্ত সেই নীতি কাহিনিটি।
Talent (তালন্ত্) প্রাচীন রোমক মুদ্রা। মুদ্রা যেমন না খাটালে, আবর্তিত না হলে অর্থহীন হয়ে পড়ে, তেমনই talent বা প্রতিভাও শেষ পর্যন্ত না খাটালে তিরস্কৃত হতে হয়। বাইবেলের সেই নীতিকথায় কথিত আছে প্রভু তাঁর একজন ভৃত্যকে একটিমাত্র ‘তালান্ত’ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভৃত্য তা না খাটিয়ে সংরক্ষণের জন্য মাটিতে পুঁতে রেখে দিয়েছিল, যে কারণে প্রভু তাকে দূর করে দেন। প্রতিভা খাটাতে না পারলে তার শাস্তি অবশ্যম্ভাবী।
ননী ভৌমিকের প্রতিভার অপচয়ের দায় অবশ্য বর্তায় সেই প্রভুদেরই ওপর, যাঁদের হাতে তিনি তাঁর প্রতিভা সমর্পণ করেছিলেন: প্রভুরাই না কোনও একটা দায় এড়াতে তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন?
একবার কথায়-কথায় তিনি শুধু বলেছিলেন: ‘না এসে উপায় ছিল না।’ কেবল একদিনের একটা অন্তরঙ্গ কথোপকথনের মুহূর্তে সেটা সামান্য একটু ঝলক দিয়ে উঠেছিল। আমার মস্কোবাসের চতুর্থ বছরের কোনও এক গ্রীষ্মকালের ঘটনা। ননীদার বাড়িতে আরও কে একজন আসার কথা– কে তা ঠিক মনে নেই, তবে আমি আগেই এসে গেছি। সভে্তলানাও বাড়ি নেই, কোথায় যেন গেছেন, একটু পরে আসছেন। কিন্তু তাই বলে তো টুকটাক আলাপ থেমে থাকতে পারে না।
সেদিন আমি সাহস করে আবারও আচমকা ননীদাকে আমার সেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলাম: ‘আপনি মস্কোয় কীভাবে এলেন?’ উত্তরে তিনি রহস্য করে বললেন, ‘অর্ধচন্দ্র বোঝো?’ আমি ঘাবড়ে গেলাম। আমাকে বলছেন নাকি? আমি থ হয়ে বসে রইলাম। ননীদাও গুম মেরে গেলেন। আমার প্রশ্নের জবাব পেলাম না।
সেই দিন, মনে আছে, ওঁর ছোটগল্প আর ‘ধুলোমাটি’ নিয়ে দু’-একটি কথা আমি জানতে চেয়েছিলাম। আমার কৌতূহল চরিতার্থ করে তিনি শুধু বলেছিলেন এসবই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত রচনা। আমি তখন ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার শেষ যে ছোটগল্পটা, যেটা মস্কো থেকে লেখা সেটাও কি তাই?’ শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি এই ফাঁকে বলে ফেললাম ‘দস্তইয়েভস্কি কিন্তু বলতেন তাঁর গল্প-উপন্যাসের সব ঘটনা নাকি তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা-প্রসূত।’ ননীদা আমার সেই কথার খেই ধরে বললেন বাস্তব অভিজ্ঞতা মানেই যে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা– এমন তো না-ও হতে পারে। প্রসঙ্গ ঘুরে গেল।
এমন সময় ডোর বেল বেজে উঠল। না, অতিথি নয়, সভে্তলালা ফিরে এসেছেন। প্রায় একই সঙ্গে বাড়ির টেলিফোনও বেজে উঠল। ননীদা জায়গা ছেড়ে উঠে রিসিভার তুললেন। জানা গেল অতিথি আজ আসতে পারছেন না। জায়গায় বসে ননীদা অতিথির জন্য রাখা খালি পেগটা দেখিয়ে বললেন, ‘এবারে তিনটেতেই ঢালো।’ অতিথির জায়গায় এসে বসলেন সভে্তলালা। আমি বললাম, ‘টোস্ট হবে না?’ ননীদা বললেন, ‘হবে না কেন?’, ‘কীসের জন্য?’, ‘কেন, প্রেমের জন্য!’ সভেত্লানা হাততালি দিয়ে উঠলেন।
……………………………………………………….
মনে আছে এই পর্বে দেখা হলেই প্রশ্ন করতেন: ‘কবে এলে? কোথায় উঠেছ?’ কখনও অবাক হয়ে বলতেন: ‘এ কী, টাক পড়ে গেল যে?’ গোঁফ পেকে গেল এই বয়সে?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করতাম: ‘বয়স কত হল বলুন তো?’ উত্তরে দরাজ হাসি হেসে বলতেন: ‘তা কত হবে, বছর পঁয়ত্রিশ বড়জোর’। অর্থাৎ সেই কুড়ি পঁচিশ বছর আগেকার স্মৃতি। পরের সবটাই লুপ্ত।
……………………………………………………….
‘প্রগতি’ প্রকাশন উঠে যাওয়ার পর সামান্য একটা পেনশন তিনি পেতেন। কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল না তিনি পেনশন পান। একদিন পেনশনের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘আরে না না, পেনশন এখানে কে দেব? এখনও তো কাজ করছি। এই দেখো না…। টেবিলের ধারে গিয়ে কিছু কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে– ‘কী জানি কোথায় যেন রেখেছি।’ বলে আবার ফিরে এসে যথাস্থানে বসলেন। ‘বঙ্কিম পুরস্কার’-এর প্রসঙ্গ উঠতে তো তিনি অবাক: তাই নাকি? পেয়েছিলাম নাকি? কোথায়, জানি না তো! একেবারে কিছু জানি না। আনতে গিয়েছিলাম বলছ? না, একদম মনে করতে পারছি না।’ তাঁর ধারণা আমি কলকাতা থেকে সবে আসছি। বললেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার?’ তারপর উত্তরের কোনও অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন: ‘কেমন আছে? ভালো তো?’ শেষকালে আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘দেখো তো কী বেয়াক্কেল! একটা খবর নেই। একেবারে বেপাত্তা!…’
মনে আছে এই পর্বে দেখা হলেই প্রশ্ন করতেন: ‘কবে এলে? কোথায় উঠেছ?’ কখনও অবাক হয়ে বলতেন: ‘এ কী, টাক পড়ে গেল যে?’ গোঁফ পেকে গেল এই বয়সে?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করতাম: ‘বয়স কত হল বলুন তো?’ উত্তরে দরাজ হাসি হেসে বলতেন: ‘তা কত হবে, বছর পঁয়ত্রিশ বড়জোর’। অর্থাৎ সেই কুড়ি পঁচিশ বছর আগেকার স্মৃতি। পরের সবটাই লুপ্ত।
মাঝে মাঝে গেছি দেখা করতে। সভে্তলানাও ততদিনে হারিয়ে ফেলেছেন মানসিক ভারসাম্য। গত কয়েক বছর যুঝে যুঝে তিনি হয়রান। না, এ রোগ আর ভালো হওয়ার নয়। এখন আমি কী করি বলো তো এঁকে নিয়ে? ওঁর ব্যাকুল প্রশ্ন। উত্তর দিতে পারিনি।
অতীতের দুই ছায়ামূর্তি। রান্নাঘরে গোটা কয়েক ভাঙা প্লেট, কয়েকটা হাঁড়িকুড়ি। বসার ও শোওয়ার ঘরে আসবাব বলতে প্রায় কিছুই নেই। দামি জিনিসপত্র যাও বা ছিল প্রথম প্রথম বন্ধক দিতেন সভে্তলানা, তারপর শুরু করলেন বিক্রি করতে। শেষকালে বিক্রি করার মতো কিছুই অবশিষ্ট রইল না। টেলিভিশন, রেকর্ড প্লেয়ার ভাঙা, তাই বিক্রি করা যায়নি। মেঝেতে হাবিজাবি জিনিসের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে বইপুথি– ‘ধুলোমাটি’ ‘ধানকানা’র সাম্প্রতিক সংস্করণও আছে তার মধ্যে। বছর কয়েক আগে আমিই এনে দিয়েছিলাম কলকাতা থেকে। ‘অরুণা’ প্রকাশনী থেকে ডাকে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু ঠিকানা ভুল থাকাতে ননীদার হাতে পৌঁছয়নি। দেওয়ালে ঝুলছে বঙ্কিম পুরস্কারের তাম্রফলক। সবুজ ছাতা ধরেছে। লেখাগুলো ভালোমতো পড়া যায় না। শেলফের ওপর ননীদা ও সভে্তলানার অল্পবয়সের দু’টি ছবি-ফ্রেমে বাঁধানো, দিমার কোনও ছবি কোথাও নেই। আশ্চর্য!
এরই মধ্যে স্ত্রীর আবদারে ননীদা পড়ে শোনাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত প্রেম’। বড় করুণ দৃশ্য।
শেষবার গিয়ে দেখি আরেক নতুন দৃশ্য। ঘরের এক কোণে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ক্রুশবিদ্ধ যিশুর পুর্ণদৈর্ঘ্যের এক বিশাল কাটআউট। গৃহকর্তার মতো জীর্ণশীর্ণ দশা। সভে্তলানার পাগলামি। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম কোনও এক নাট্যশালায় এককালে ব্যবহৃত, অধুনা পরিত্যক্ত চিত্রপট। সভে্তলানাই জোগাড় করে এনেছেন। আশ্চর্য! এটাও কি প্রতীকী? ঘরের ওয়ালপেপার জায়গায় জায়গায় খসে গিয়ে দগদগে ঘায়ের মতো দেখাচ্ছে, গা ছমছম করা পরিবেশ।
‘ধুলোমাটি’, ‘ধানকানা’র লেখককে সেদিন চোখের সামনে দেখেছিলাম ট্র্যাজিক উপন্যাসের নায়ক হয়ে প্রবাসে অন্তিম দিন গুনতে। ভাবি, ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা নিয়ে যদি কোনও উপন্যাস লেখা হত, সেটা দ্বিতীয় ধুলোমাটি হত না, হতে পারত অবশ্যই দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস। কিন্তু কে লিখতে পারে সেই কাহিনি? ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভোররাতে মস্কোয় ঘুমের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ননীদা– ততদিনে, তার মাস দুয়েক আগে আমি সে দেশ ছেড়ে চলে এসেছি আমার জীবনের একটি পাট চুকিয়ে।
ইতিমধ্যে, ননীদার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যে কোনও কারণেই হোক, সভে্তলানাকে তাঁর বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়। তাঁর ঠাঁই হল মস্কোর এক দূর প্রান্তে, মনোরোগ চিকিৎসালয়ের এলাকার এক-কামরার একটি ফ্ল্যাটে। এও এক কাকতালীয় ঘটনা! আরও বছর তিনেক পরে তিনশো বছর জীবন উপভোগের স্বপ্নদর্শীকে ধরাধাম থেকে অকালে বিদায় নিতে হল।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি