Robbar

যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 26, 2024 4:52 pm
  • Updated:February 26, 2024 4:52 pm  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কালিনিনগ্রাদ শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, একেবারেই জার্মানশূন্য হয়ে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। জার্মানিও পরবর্তীকালে এই শহর আর দাবি করেনি। কালিনিনগ্রাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পৃথক কোনও প্রজাতন্ত্রও ছিল না যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পৃথক রাজ্যে পরিণত হবে– সেটা ছিল রুশ ফেডারেশনেরই অংশ, রুশি অধ্যুষিত অঞ্চল। রুশিরা রুশ দেশ থেকে স্বাধীনতা চাইবেই বা কেন?

অরুণ সোম

২.

ছোটবেলায় শুনতাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না; কিন্তু সেটা ছিল তার উপনিবেশগুলির দৌলতে। ভূগোলে পড়িনি, তাই জানতামও না যে আরও একটা দেশ তখনও ছিল, অনেক কাল হলই ছিল। যেখানে সূর্য অস্ত যায় না– রাশিয়া। কিন্তু সে তার নিজস্ব ভূখণ্ডের আয়তনের জোরেই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেই গৌরব অস্তমিত হয়েছে আজ অনেক কাল হল, তার উপনিবেশগুলি একে একে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর; কিন্তু ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে তার অন্তর্ভুক্ত অঙ্গরাজ্যগুলি পৃথক পৃথক হয়ে যাওয়ার পরও রাশিয়া একাই আজও তার নিজের জোরে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ– সেখানে আজও সূর্য অস্ত যায় না।

Former Soviet Union (USSR) Countries - WorldAtlas

প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বালটিক সমুদ্র, পুবে ভ্লাদিভস্তক থেকে পশ্চিমে কালিনিনগ্রাদ পর্যন্ত তার বিস্তার। পৃথিবীর ভূখণ্ডের এক সপ্তমাংশ। (সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকতে যা ছিল এক পঞ্চমাংশ) অবশ্য ২৪ শতাংশ ভূখণ্ডই সাইবেরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেখানেও লোকবসতি আছে, কলকারখানা আছে। দেশের দুই তৃতীয়াংশ এশিয়ায়, এক তৃতীয়াংশ ইউরোপে। মহানগরগুলির অধিকাংশই ইউরোপীয় অংশে। সারা দেশ জুড়ে ৯টি সময় মানমণ্ডল (আগে ১১টি ছিল)। কালিনিনগ্রাদ থেকে কাম‌চাতকা সময়ের ব‌্যবধান ১০ ঘণ্টা। পুবে ভ্লাদিভস্তক থেকে পশ্চিমে মস্কো– সাতটি সময় মানমণ্ডল পিছিয়ে আছে।

দেশের বড় বড় শহরের অনেকগুলিরই একাধিকবার নাম বদল হয়েছে, যার ফলে বিদেশিদের পক্ষে অনেক সময় ঐতিহাসিকভাবে এদের শনাক্ত করাও কঠিন।

সময়-বেষ্টনী ধরে পশ্চিম থেকে পুবে এগোতে গেলে প্রথমেই পড়ে দেশের প্রত‌্যন্ত পশ্চিমে লিথুয়ানিয়া ও পোল‌্যান্ডের মধ‌্যবর্তী ছিটম‌হল– কালিনিনগ্রাদ, সেন্ট পিটার্সবুর্গের পর রাশিয়ার বাল্‌টিক তীরবর্তী দ্বিতীয় বন্দরনগরী।

Kaliningrad: Russia fury as Poland body recommends renaming exclave
কালিনিনগ্রাদ

৭৫০ বছরের প্রাচীন শহর কালিনিনগ্রাদ। ঐতিহাসিক ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত সাত শতাব্দী পূর্ব প্রুশিয়া ও জার্মানির অংশে ছিল। তখন শহরের নাম ছিল কোয়েনিসবের্গ। ১৭৫৮-১৭৬৪ স্বল্প কিছুকাল রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে পোল‌্যান্ডে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকারে আসে। ১৯৪৩ সালে তেহরান মিটিং-এ ঠিক হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে বন্দর তৈরি হলে জার্মানদের আরও দুর্বল করে ফেলা সম্ভব হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সে যুক্তি মেনে নেন। যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে পূর্বতন পূর্ব প্রুশিয়ার উত্তরাংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়, দক্ষিণের অংশ পোল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৪৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের সভাপতি মিখাইল কালিনিনের মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে শহরটি কালিনিনগ্রাদ নামে আখ্যাত হয়। তখন থেকে সেই নামই বহাল আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, একেবারেই জার্মানশূন্য হয়ে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। জার্মানিও পরবর্তীকালে এই শহর আর দাবি করেনি। কালিনিনগ্রাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পৃথক কোনও প্রজাতন্ত্রও ছিল না যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পৃথক রাজ্যে পরিণত হবে– সেটা ছিল রুশ ফেডারেশনেরই অংশ, রুশি-অধ্যুষিত অঞ্চল। রুশিরা রুশ দেশ থেকে স্বাধীনতা চাইবেই বা কেন?

Mikhail Kalinin - Wikiquote
মিখাইল কালিনিন

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার অনেক শহর ও অঞ্চলের ঐতিহাসিক পূর্বনাম ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কালিনিনগ্রাদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয়নি। কোয়েনিসবের্গ হলে তো আবার সেই জার্মানিরই দাবি এসে যায়, তার ওপর অপরার্ধ আবার পোল‌্যান্ডে চলে গেছে।

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) জন্ম, শিক্ষাদীক্ষা, কর্মস্থল ও মৃত্যু কে‌ায়েনিসবের্গে। এই শহরের বাইরে তিনি কখনও কোথাও পদার্পণ করেননি। এখানে তাঁর সমাধি আছে।

Immanuel Kant's Grave, Kaliningrad
কালিনিনগ্রাদে ইমানুূয়েল কান্টের সমাধি

বালটিক সমুদ্র তীরে রাশিয়ার নির্মিত প্রথম শহর সেন্ট পিটার্সবুর্গ (সাংকত পেতের্বুর্গ)। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ১৭০৩ সালে নেভা নদীর ব-দ্বীপে জলাভূমির ওপর এই মহানগরের প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়ার জন‌্য ইউরোপের বাতায়ন খুলে দিয়েছিলেন দেশের তৎকালীন জার মহামতি পিয়োত্‌র। জারের সমনামী সেন্ট পিটারের নামে তার নামকরণ হয় সেন্ট পিটার্সবুর্গ। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে দেশের রাজধানী মস্কো থেকে এখানে স্থানান্তরিত হয়। সেই থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল।

সেন্ট পিটার্সবার্গ

সর্বাধিক বেশিবার নাম পরিবর্তন হয়েছে ওই শহরের। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সেন্ট পিটার্সবুর্গ নামই ছিল, কিন্তু ১৯১৪-র পর জার পিয়োতরের সম্মানে ‘পেত্রোগ্রাদ’ বা ‘পিয়োতরের শহর’ নামে আখ‌্যাত হয়। লেনিনের মৃত্যুর পর ১৯২৪ সালে তাঁর সম্মানে ‘লেনিনগ্রাদ’ বা ‘লেনিনের শহর’ নাম পরিগ্রহ করে। নয়া জমানায় আদি নাম সেন্ট পিটার্সবুর্গ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জার মহামতি পিয়োতরের শহর, মহানায়ক লেনিনের শহর, বিপ্লবের ক্রীড়াভূমি এই শহর রাশিয়ার দ্বিতীয় রাজধানী, রুশ শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান, প্রাসাদ নগরী নামেও পরিচিত। এখানেই বাস করতেন মহান রুশ লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কি।

Cold Russian Winter | The Neva River in St. Petersburg, Russ… | Flickr
শীতকালে নেভা নদীর তীরবর্তী সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহর

নেভা নদীর উপকূল ও সন্নিহিত এলাকার খালবিলের গ্রানিট পাথরে বাঁধানো ঘাট বরাবর ইউরোপের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ স্থপতিদের তৈরি বহু বিচিত্র ছাঁদের বলিষ্ঠ স্থাপত‌্যরীতির বিশাল বিশাল প্রাসাদ ও অট্টালিকা, জার্মান ধাঁচের ছুঁচালো চূড়া, ইংলিশ গার্ডেন, ইতালীয় ধাঁচের দালানকোঠার বহিরাবয়ব, ফরাসি বুলভার এই শহরের বৈশিষ্ট‌্য। পশ্চিমের চোখ ধাঁধানোর মতো এখানে আছে জার পিয়োতরের রাজপ্রাসাদ, জারের শীতপ্রাসাদ, আছে পৃথিবীর নানা দেশের ত্রিশ লক্ষাধিক প্রাচীন ও আধুনিক শিল্পের সংগ্রহশালা ‘এর্মিতাজ’, যা বিশ্বের অন‌্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পসংগ্রহশালা নামে পরিচিত।

মে-জুন মাসে আকাশে উত্তরের জ্যোতির প্রভাবে এই শহর দিন-রাত প্রায় সমান দিবালোকে উদ্ভাসিত।

শহরের সোভিয়েত নির্মাণ কর্মগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ‌্য নেভা নদীর ৮৬ কিলোমিটার গভীর তলদেশে পৃথিবীর অন‌্যতম গভীর ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশন– Admiralteyskaya। আবার এই মেট্রো স্টেশনের বাইরেই নেভা নদী তীরের শোভাবর্ধন করে আছে নৌবাহিনীর সদর দফতরের দালানের মাথার ওপর ৭২ মিটার উঁচু ছুঁচালো মিনার।

Leningrad, early 1980s | Ceri C | Flickr
আটের দশকের লেনিনগ্রাদ

নাৎসি জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেদিনকার লেনিনগ্রাদ শহর জার্মান বাহিনীর অবরোধের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ৯০০ দিনের সেই অবরোধের সময় যুদ্ধে অনাহারে, প্রবল শৈত্যের কবলে শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের– মোট প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। অবরোধের প্রথম ষোলো সপ্তাহের মধ্যে অবরুদ্ধ শহরে বসেই বিখ‌্যাত সোভিয়েত সুরকার দমিত্রি শস্তাকোভিচ লেনিনগ্রাদ সিম্ফনি নামে পরিচিত সিম্ফনি রচনা করেন এবং সেখানেই তার অনুষ্ঠান পরিবেশন করে প্রমাণ করলেন, শিল্পের মৃত্যু নেই।

(চলবে)

…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১। এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি