Robbar

অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনওদিন!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 7, 2025 8:58 pm
  • Updated:September 8, 2025 11:00 am  

সবচেয়ে অবাক করা পতঙ্গ, জোনাকি। রাতের আঁধারে জোনাকির ঝিকিমিকি দেখে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। যেদিন শুনেছিলাম, বাবুই পাখি তার বাসায় বাচ্চাদের জন্য কিছু জোনাকি ধরে এনে রাতের বেলায় আলোর ব্যবস্থা করে, চমৎকার লেগেছিল ব্যাপারটা। তারপর থেকে আমরা মাঝে মাঝেই মুঠো করে জোনাকি ধরে এনে মশারির মধ্যে রেখে রাতের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আলো দেখতাম। যারা গ্রামের ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে জোনাকির ঝাঁক দেখেনি, লিখে তাদের সে অনুভব দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। ‘অবাক করা পতঙ্গ’ কেন বললাম তার সাপেক্ষে ছোট করে তথ্যদায়ক ক’টি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

সমীর মণ্ডল

৩.

ছোটবেলায় বড়রা আমাদের ভয় দেখাত। কার্যসিদ্ধির জন্য ভয় দেখানোটা অভিভাবকদের একটা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে হত। ভয় দেখানোর ছিল নানা পদ্ধতি বা পন্থা। আধা শহর বা শহরে ভূতের ব্যাপারটা বিশ্বাস করানো কঠিন, অতএব ‘ছেলেধরা’র ভয়। আমাদের গ্রাম্য জীবনে ভয় দেখানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল ভূত-প্রেত-দত্যি-দানব। কী বোকা ছিলাম, সহজে বিশ্বাস করেও নিতাম। কত রকমারি ভূতের গল্পই না শুনেছি ছেলেবেলায়!

ভূতের ঘরবাড়ির কোনও সীমা-পরিসীমা ছিল না। জলে-জঙ্গলে, মাঠে-ঘাটে, গাছের মাথায়, ঘরের চালে এমনকী আস্তাকুঁড়ে ফেলে রাখা ভাঙা হাঁড়ি-কলসির মধ্যেও তাদের বসবাস। তালগাছের মাথায় যে ভূতের বাসা তারা আবার বেলগাছে থাকে না। সেখানে থাকে ‘বেম্মদত্যি’! শ্যাওড়াগাছে পেত্নী আর শাকচুন্নির বাসা, বটগাছের বড় কোটরে ঘাড় মটকানো ভূতের ঘরবাড়ি। পাকুড়গাছের মগডালে শকুনের বাসা। রাতবিরেতে সেখান থেকে ভেসে আসত শিশুর কান্নার মতো শব্দ।

আগেই বলেছি, আমাদের ঘরের পাশে স্থির জলের ছোট্ট নদী ‘সোনাই’। সোনাইয়ের জলে নিত্য চান-দান। গ্রীষ্মে হাঁটুজলে বেদম সাঁতার এবং জলখেলার শেষ নেই। নৌকোর গলুইয়ে বসে নিচে স্বচ্ছ জলে জলজ লতাপাতা, মাঝে মাঝে ছিপ দিয়ে ট্যাপা মাছ, পুঁটি মাছ। সেইখানে ছিল নাকি নদীর মধ্যে জলের ভূত। সে গল্পটাই আগে বলব, তারপরে বলব বিশাল জলাভূমির নানা রকম মেছোভূত আর আলেয়ার গল্প। আমাদের ছেলেবেলায় ছিল ‘আলেয়া’ ভূত। মায়াবী আলোর বিস্ময়।

ঠাম্মার মুখে যেসব গল্প শুনতাম তাতে আমাদের নৌকোর গলুইয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা একেবারে মাথায় উঠল। আমাদের ঘাট থেকে অদূরে, যেখানটায় কোন বাড়িঘর নেই, ঘন গাছের জঙ্গল, সেইখানে নাকি নদীর মধ্যে আছে এক ‘দহ’। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর পর যেখানে প্রতিমা বিসর্জন হয়। ঠাম্মা দহের মানে বুঝিয়েছিল। নদীর নিচে অতল গহ্বর। যেখানে জলের নিচে তল খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আমরা যখন তখন গভীর জলে ডুব দিয়ে এক দমে নিচের তলা থেকে মাটি তুলে এনে দেখাতাম। কী জানি বাবা! ঠাম্মা বলতো, ওই দহের মধ্যে থাকে সেই জলের ভূত। ভূত তো নয়, সে নাকি ছিল এক জল-দানবী! তার শরীর নেই, আছে শুধু প্রকাণ্ড এক মাথা। জলের ভিতর বহুদূর বিস্তৃত তার মাথাভরা চুলের রাশি। বিশাল হাঁ-মুখ, গালের মধ্যে দু’-পাটিতে পাঁচশোর মতো দাঁত! ওর ওই চুল দিয়ে নাকি জলের ভেতর মানুষের পায়ে জড়িয়ে টেনে নিয়ে যায়। তারপর মুখের মধ্যে পুরে মহাসুখে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। কল্পনায় কত ভাবে সেই মুখখানা ভেবেছি। স্বচ্ছ জলে, হালকা ঢেউয়ে ঝাঁঝির নরম দোলা দেখলে মনে হত ওটা বোধহয় ওই দানবীর চুলেরই শাখা-প্রশাখা। গা শিরশির করত। তারপর থেকে একলা জলে নামিনি বহুকাল।

আলেয়া ভূতের যত গল্প ছোটবেলায় লোকমুখে শুনেছি তার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পটাও ঠাম্মার। সে শুধু ভূতের গল্প নয়, ভূতের জন্মকাহিনি। ভূত তৈরির পদ্ধতি। শুনলে আজও গা ছমছম করে। ঠাম্মা বলত, কোন এক জাতের লোকেরা মৃত্যুর পরে নাকি তাদের দেহকে পোড়ায় না, কবরেও দেয় না। লোকালয় থেকে দূরে কোথাও মাটিতে গলা সমান গর্ত করে সারা শরীরটা পুতে দেয়। মুণ্ডুটা মাটির ওপরে থাকে জেগে। মুখাগ্নি করার পর সেই মুখের সামনে প্রদীপ জ্বেলে তার ওপরে একটি বড় মাটির হাঁড়ি চাপা দিয়ে রেখে আসে। পরে তার অশরীরী আত্মা আলেয়া ভূত হয়ে মানুষকে ভয় দেখায় মাঠেঘাটে। লোকবিশ্বাসে বলা হয়, এ আলো নাকি মৃত মানুষের আত্মা, যারা পথহারা মানুষকে আরও অচেনা পথে টেনে নিয়ে যায়।

আলেয়ার আলো

অন্ধকার রাতে ফাঁকা মাঠে হঠাৎ ভেসে ওঠে এক রহস্যময় আলো। মাটি থেকে খানিকটা উঁচুতে দপ করে জ্বলে ওঠে আগুন। অল্পক্ষণ পরে একটু দূরে আবার, আর একটু দূরে গিয়ে আবার, এইভাবে সেই আলো চলতে থাকে। কখনও বা একটানা বেশ খানিকক্ষণ চলে বেড়ায়। মনে হয় যেন অচেনা কারও ইশারা, আবার যেন অদৃশ্য কোনও প্রদীপের দপদপে শিখা। সেই আলো কখনও ধানখেতের ওপর ভেসে ওঠে, কখনও কুয়াশাভেজা জলাজমির বুকে। অচেনা পথিক তাকে অনুসরণ করলে হারিয়ে যায় দিক, মিলিয়ে যায় গন্তব্য। তাই আলেয়ার আলো একদিকে যেমন মুগ্ধতার, অন্যদিকে তেমনি ভয়ের প্রতীক হয়ে আছে লোককথায়। রং বদলায় আলেয়া। কখনও আগুনের মতো, কখনও সাদাটে, কখনও আবার নীলাভ।

বড় হয়ে জেনেছি, জলাভূমির জলজ গাছপাতা পচে তৈরি হচ্ছে মিথেন। আরও কিছু গ্যাসের নাম বলছেন বিজ্ঞানীরা। অ্যামোনিয়া, হিলিয়াম, হাইড্রোজেন, ফসফিন, ডাইফসফিন। মাটির নিচে জমে থাকা পচা জৈবপদার্থ থেকে বের হয় গ্যাস। হঠাৎ অক্সিজেনের ছোঁয়ায় সেগুলো দপ করে জ্বলে ওঠে, যেন অন্ধকারের বুক চিরে ক্ষণিকের মৃদু আলো। সেটাই আলেয়া। প্রকৃতির খেলা আর বিজ্ঞানের হিসেব।

ভাগ্যিস আমাদের জল ছিল। আদিগন্ত জলাভূমি– ‘বল্লীর বিল’ বা ‘বিলবল্লী’। ছিল মাইলের পর মাইল কচুরিপানা আর অসংখ্য জলজ ঘাসের ভাণ্ডার। আর তাই না আমাদের ভাগ্যে ছিল আলেয়ার পাশাপাশি বসবাস। না-হলে বড় হয়ে চিত্রকলায় মায়াবী আলোর খেলা বুঝতামই না কোনও দিন।

বাংলার জলাভূমি, আলোকচিত্র: সুস্মিতা চক্রবর্তী

এ জীবনে দেখা হল কতই না প্রাকৃতিক আলোর রূপ। জন্মাবধি দেখে আসছি সূর্যের আলো, জগতে আলোর প্রধান। সূর্যের ধার করা আলো দিল চাঁদ। দূরবর্তী গ্রহ নক্ষত্র থেকে আসা তারার আলো সাজিয়ে রাখল রাতের আকাশকে। মেরু অঞ্চলে সূর্যের চার্জড কণার সঙ্গে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়ায় সবুজ, লাল, বেগুনি, উত্তর-দক্ষিণের আলো– অরোরা। অস্ট্রেলিয়ায় দেখলাম, ভয়াবহ বনের আগুন– দাবানল, ইন্দোনেশিয়ায় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। মেঘ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল বজ্রপাতের আলোর ঝলকানি। বৃষ্টির ফোঁটার ভিতর আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণে রামধনু। আর আছে কীট-পতঙ্গের মতো অনেক ক্ষুদ্র প্রাণীর দেহে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন আলো– ‘জীবজ্যোতি’, বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘বায়োলুমিনেসেন্স’।

সবচেয়ে অবাক করা পতঙ্গ, জোনাকি। রাতের আঁধারে জোনাকির ঝিকিমিকি দেখে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। যেদিন শুনেছিলাম, বাবুই পাখি তার বাসায় বাচ্চাদের জন্য কিছু জোনাকি ধরে এনে রাতের বেলায় আলোর ব্যবস্থা করে, চমৎকার লেগেছিল ব্যাপারটা। তারপর থেকে আমরা মাঝে মাঝেই মুঠো করে জোনাকি ধরে এনে মশারির মধ্যে রেখে রাতের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আলো দেখতাম। যারা গ্রামের ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে জোনাকির ঝাঁক দেখেনি, লিখে তাদের সে অনুভব দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। ‘অবাক করা পতঙ্গ’ কেন বললাম তার সাপেক্ষে ছোট করে তথ্যদায়ক ক’টি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

জোনাকির আলো

জোনাকির দেহে লুসিফেরিন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ এবং লুসিফেরেজ এনজাইমের বিক্রিয়ায় অক্সিজেনের সংস্পর্শে তৈরি হয় এই আলো। এটি একটি ঠান্ডা আলো, যার মানে, এতে তাপ উৎপন্ন হয় না, প্রকৃতির একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। জোনাকির আলো সূর্যের মতো গরম নয়, মোমবাতির মতো জ্বলে না। এ আলো পুরোপুরি ‘কোল্ড লাইট’। পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকর আলো বলা যায় এটিকে, কারণ শতভাগ শক্তি আলোতে রূপান্তরিত হয়, কোনও অপচয় নেই। জোনাকি অন্ধকারে আলো জ্বালে কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, যোগাযোগের জন্য। প্রতিটি প্রজাতির নিজস্ব আলোর ঝলকানির আলাদা আলাদা প্যাটার্ন থাকে। পুরুষ জোনাকি ঝিকমিক আলো দিয়ে সঙ্গীকে ডাকে, আর স্ত্রী জোনাকি নির্দিষ্ট আলোয় সাড়া দেয়। এভাবে একধরনের নীরব প্রেমালাপ চলে তাদের মধ্যে। আবার, কিছু জোনাকি আলো জ্বালতে শুরু করলেই সেই গাছে বা ঝোপে যত জোনাকি আছে তারা সবাই আলাদা আলাদা ভাবে শুরু করে আলো জ্বালা। সেটা তাদের একটা সম্মিলিত আলোর আলাদা সংকেত, যেন মহাসমাবেশ কিংবা মহামিছিল।

আলো চলে। আলো দোলে। আলো ভরসা। আলো ভয় দেখায়। আলো বন্ধু ,আলো প্রতিহিংসার। অন্ধকার রাতের শেষে ঠিক যেমন সূর্যোদয় মানুষের ভয় কাটায়, তেমনই সূর্য আমাদের পোড়ায়ও। গ্রামে কারও গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা অথবা ঘরের চালে আগুন জ্বালিয়ে তাদের সম্পত্তি নষ্ট করে দেওয়ার উদাহরণও কম ছিল না। প্রকৃতির আলো ছাড়িয়ে মানুষ তাই তৈরি করতে চেয়েছে তার নিজের ‘ইচ্ছে আলো’, ‘আকাঙ্ক্ষার আলো’। যুগে যুগে মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ওভারটেক করতে চেয়েছে ক্ষণে ক্ষণে।

শিল্পী: সমীর মণ্ডল

শিল্পী-সাহিত্যিক-নাট্যকার। আলো নিয়ে মানুষের খেলা। জীবনানন্দ দাশ, তাপস সেন বা গণেশ পাইনরা নিজেরা আলেয়া দেখেছিলেন কি না, জানি না কিন্তু আমাদের আলেয়া দেখিয়েছেন। এ মানুষগুলোকে আমরা চিনি। ছবিতে মায়াবী আলো দেখিয়েছেন গণেশ পাইন আর মায়াবী অন্ধকার চিনিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। রাজা রবি বর্মা, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবিতে দেখিয়েছেন আলোর ম্যাজিক। আর আলোর জাদুকর তাপস সেন আমাদের অনুভূতি ভুলিয়ে দিয়েছেন নাটকের আলোয়।

আজকের পর্ব এখানেই শেষ করে দিলে হয়তো ভালো হত। এখন যা বলতে চাই তা আরেকটি পর্বে বলা যেতে পারত। কিন্তু না, আমার মনে হয়, অকারণে একটি বিষয়কে টেনে দু’টি পর্বে লম্বা করার কোনও মানে হয় না। আমার পেটে গিজগিজ করছে আরও অসংখ্য কথা। এক একটা সময় লিখতে গিয়ে মনের মধ্যে কেমন যেন হয়। সেটা, সেই অবস্থাটা এখানে ধরতে না পারলে ভীষণ অসোয়াস্তি। প্রিয় পাঠক লক্ষ করবেন, আমি লেখায় যতটা তথ্য প্রদানকারী, তার চেয়ে বেশি নিজে ঘটনার সাক্ষী, প্রত্যক্ষদর্শী। এবার বৈপরীত্য আসবে, আসবে সংঘাত।

মায়াবী আলো, গণেশ পাইনের ছবি

এইখানে সেই নাটক-পাগল তরুণের গল্পটা বলি, আলোর ব্যবহারের রোমহর্ষক এক ঘটনা। এ গল্প থিয়েটারের বা সিনেমা জগতের অনেকেই জানেন হয়তো। ছেলেটির নাটক অন্তপ্রাণ। থিয়েটারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট পয়সা তার নেই। গরিব। আর মরণ হয়েছিল সে ফ্যাসিবাদ এবং একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাটক করে। প্রতিবাদী মন। তৎকালীন শাসকের কানে এল সে কথা। একদিন নাটক দেখার ইচ্ছে হল নেতার। খবর পাঠালেন ছেলেটিকে, পরের শোয়ে তিনি নাটক দেখতে আসছেন।

ভীত, শঙ্কিত তরুণ। কী চাইছেন নেতা? তিনি কি এই নাটক বন্ধ করতে দিতে চাইছেন, নাটক দেখে কি ধমকাতে আসছেন! নাকি নাটকের এই গোষ্ঠীটাকে এবং তাদের আনুগত্য তাঁর দলের কাজে লাগাতে চাইছেন! মনে হাজার প্রশ্ন। সত্যি সত্যি শোয়ে এলেন নেতা। সর্বশক্তি দিয়ে সেদিনের অভিনয় করল তরুণ। শো শেষে নেতা দেখা করলেন ছেলেটির সঙ্গে। মুখে তাঁর প্রশংসা, প্রসন্নতা। খুব শিগগিরই ছেলেটির সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চান বলে দফতরে আসতে বলে, একটা দিন ঠিক করে, বেরিয়ে গেলেন নেতা। শোয়ের আগে যে ভয় ছিল সে ভয় দশ গুণ বেড়ে গেল তরুণের।

নির্দিষ্ট দিনে নেতা এবং নাট্যকারের দেখা হল। অবাক করা ঘটনা ঘটল। নেতার কথাবার্তা তরুণ নাট্যকারের চিন্তার বাইরে। বললেন, আমি তোমার নাটক দেখে মুগ্ধ। এখনকার তরুণদের মধ্যে তুমি নিঃসন্দেহে মেধাবী এবং প্রতিভাবান। তোমার বিষয়-চিন্তা এবং আঙ্গিক আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমি এটা বজায় রাখো। আমি তোমার একজন ভক্ত হয়ে পড়েছি। তোমাকে আমি সাহায্য করতে চাই। বলো তুমি নাটকের জন্য আমার কাছ থেকে কী পেলে উপকৃত হবে? প্রায় অবিশ্বাস্য এ কথা শুনে তরুণ স্তম্ভিত। সবিনয়ে জানাল, একটি মঞ্চ এবং সামান্য কিছু নাটকের সরঞ্জাম ছাড়া তার আর কিছু চাহিদা নেই।

…………………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন সমীর মণ্ডল-এর অন্যান্য লেখা

…………………………….

প্রায় রাতারাতি তৈরি হল মাঝারি সাইজের অতি আধুনিক একটি প্রেক্ষাগৃহ। দু’পাশে দেওয়াল ঘেঁষে এবং মাঝখানে একটি মিলিয়ে তিনটি দর্শকদের যাতায়াতের পথ, মধ্যে সুন্দর আধুনিক আসন। শব্দের উপযোগী দেওয়াল এবং দামি দামি আধুনিক আলোর সরঞ্জাম। অর্থব্যয়ে কোনও কার্পণ্য ছিল না। নতুন নাটক এবং প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দিনে নেতা স্বয়ং উপস্থিত। ভিড় উপচে পড়ছে প্রেক্ষাগৃহে। শহরের নাট্যপ্রেমীরা যত তার চেয়ে অনেক বেশি নেতার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু এবং তাঁর অনুগত প্রিয়পাত্ররা।

সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চের পর্দা খুলল। শুরু হল নাটক। প্রথম দৃশ্যে তরুণ নাট্যকার মঞ্চে একাই। মঞ্চের দু’পাশ থেকে দুটো স্পটলাইট আলো ফেলল অভিনেতার মুখে। তারপরে দু’পাশের উইংসের দিক থেকে আরও দুটো আলো, আরও দুটো। পরপর অনেকগুলো উইংসের আলো জ্বলে উঠল। হঠাৎ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেল আলোর তীব্রতা। হাত দিয়ে মুখ ঢাকল ও। ফলো স্পট যেন আক্রমণ করছে অভিনেতাকে। এত তার তীব্রতা সে চোখে কিছু আর দেখতে পাচ্ছে না। উইংসের দিকে না গিয়ে মঞ্চের সামনে এবং দর্শকের মাঝখানে যে খালি অংশ থাকে খানিকটা, সেখানে লাফিয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই সময়ে প্রেক্ষাগৃহের পিছন থেকে যাতায়াতের তিনটে পথ দিয়ে তিনটে ফ্লাড লাইট ওর দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে যার আলোর অসম্ভব তীব্রতা। মুহূর্তের মধ্যে অভিনেতা তার দৃষ্টিশক্তি হারাল, আলোর তাপে সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

মঞ্চের আলো

এখানে পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন সেই ছিল তার জীবনের মতো অভিনয়ের শেষ দিন। শুধুমাত্র আলো দিয়ে প্রতিহিংসার এমন ডিজাইন পৃথিবীতে কেউ কল্পনাই করতে পারবে না।

তবে সুস্থ থিয়েটারে দর্শক অংশে বা মঞ্চভাগে ‘ব্লাইন্ডিং হোয়াইট লাইট’ ব্যবহার করে চমক তৈরির উদাহরণ অবশ্য আছে, তা আক্রমণের জন্য নয়। ব্লাইন্ডিং হোয়াইট লাইট, মূলত এক ধরনের নাট্যকৌশল, যা দর্শক বা পারফর্মারকে স্থায়ীভাবে অন্ধ করার ইচ্ছে নয়, একটা মুহূর্তের আতঙ্ক, বিভ্রান্তি বা মানসিক ধাক্কা সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। বিখ্যাত ফরাসি নাট্যব্যক্তিত্ব অ্যান্তোনিন আরতো, তাঁর ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’-তে আলোকে শারীরিক আক্রমণ বা মানসিক ধাক্কার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হঠাৎ কখনও তীব্র আলো দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলে, আর সেটাই ছিল নাট্য-আঙ্গিক। আধুনিক থিয়েটারে আমরা দেখেছি কখনও কখনও হাই-ইনটেনসিটি স্ট্রোব বা ব্লাইন্ডার লাইট ব্যবহার হয় ক্লাইম্যাক্সে, যাতে দর্শকের চোখ ও মন দুটোই সাময়িকভাবে কন্ট্রোল হারায়।

এবার একটু বিজ্ঞানে আসি। আলোর তীব্রতার চাহিদায় মানুষ সূর্যকেও টপকে যেতে চেয়েছে এবং টপকেই ছেড়েছে। বর্তমানে, ‘অ্যাটোসেকেন্ড লেজার‘ বা ‘পেটাওয়াট লেজার’ মানুষের তৈরি সবচেয়ে তীব্র আলোর উৎস। এক্সট্রিম লাইট ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রকল্পের অংশ হিসেবে তৈরি অ্যাটোসেকেন্ড লেজার অতি-উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার সিস্টেম। এই ধরনের লেজারগুলো অত্যন্ত তীব্র আলো উৎপন্ন করতে পারে, যার তীব্রতা সূর্যের পৃষ্ঠের আলোর তুলনায় বিলিয়ন গুণ বেশি হতে পারে। ভাবতেই মাথা ঘুরে যায়।

জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আদ্যিকাল থেকে মানুষ আলোর সংকেতে পথ দেখিয়ে এসেছে। আবার যুদ্ধকালে  মিলিটারি স্পটলাইট বা সার্চলাইটের ব্যবহারে শত্রুর বিমান, জাহাজ বা সৈন্যকে বিভ্রান্ত করেছে মানুষ। নাগরিক জীবনে উৎসবে, আমোদে-প্রমোদে আলোর প্রাচুর্য দেখে মনে হয় শক্তির কত অপচয়। আধুনিক কালে মানুষ যেন রাতের অন্ধকারকে অস্বীকার করতে চায়, যেন ২৪ ঘণ্টাই দিন এখন তার।

প্রকৃতির আলো আর মানুষের তৈরি আলো

তবু সত্যি বলতে, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা মেনে নিলেও অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনও দিন! ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে নিজের হাতে ধরা টর্চের মতো আলো যখন মঞ্চে কুশীলবরা নিজেরই মুখে ফেলে নাটক করে, তখন তাদের আমি আলেয়ার দল ভাবি। রাতের মাঠে হঠাৎ দেখা দেওয়া নীলচে আলো মানুষকে এখনও থমকে দেয়, শিহরিত করে। সে আলো শুধু রাসায়নিক বিক্রিয়ার নাম নয়, প্রকৃতির গোপন কবিতা, লোককথার অদ্ভুত প্রদীপ, যেখানে ভয় আর সৌন্দর্য হাত ধরাধরি করে হাঁটে।

অল্পবিজ্ঞান-এর অন্যান্য পর্ব…

২. বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আমাদের চিরকালের নায়ক হয়ে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন

১. বস্তু নাকি ভাবনা, শিল্পকলায় কী খোঁজেন?