জঁর মানে শুধুই গল্পের ধরন নয়। এখানেই সাহিত্যে উৎস ঘটলেও সিনেমায় এই গোত্রের ধারণাটি প্রায় স্বকীয়তা পায়। ল্যান্ডস্কেপ, পোশাক, প্রপস, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে শারীরিকতাও এক একটি জঁরে এক এক রকমের হয়ে যায়। ভিন্ন হয়ে যায় বাচনপ্রক্রিয়া, সংলাপের ভাষা বা অভিনয়শৈলী। সেরকমভাবেই শব্দ বা সংগীতের ব্যবহারও ভিন্ন রকমের হয়। আমরা বাঙালিরা জঁর বলতে ‘গল্পের ধরন’ বুঝে আসছি দীর্ঘদিন, বা বড়জোর গল্পের আবহ। তাই আমাদের ভূতের গল্প হয় গা ছমছমে, অথবা আমাদের প্রেমের গল্প হয় মনকেমন করা। কিন্তু সিনেমা এইটুকুতেও ক্ষান্ত হয় না। কী ধরনের উপাদানে গা ছমছম করে? মন কেমন কেমন করবে কি শুধুমাত্র আখ্যান আর চরিত্রের জন্য?
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
৩.
এই যে জঁর (বা কারও কারও উচ্চারণে জনরা)– এই জিনিসটা কী? শুধুই গল্পের ধরন? যেমন রোমান্টিক গল্প, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, থ্রিলার ইত্যাদি? সংজ্ঞার্থে তাই। জঁরের উৎস সাহিত্যে; কিন্তু সিনেমায় তা আরও কিছু মাত্রা জুটিয়ে থাকে, যা সাহিত্যে সম্ভব নয়, কারণ সিনেমা শুধুই গল্প বলা নয়। সিনেমা গল্প দেখানো, গল্প শোনানো, গল্পের কৃতিও বটে।
যেমন ধরুন ল্যান্ডস্কেপ। ল্যান্ডস্কেপ কি শুধুই প্রেক্ষাপট? যে জঁরটি আমার প্রিয় বলেই বারবার উল্লেখিত হয়েছে আগের দু’টি কিস্তিতে, সেই ওয়েস্টার্ন-এ আমরা খুব নির্দিষ্ট ল্যান্ডস্কেপ দেখতে পাব, আমেরিকার পশ্চিমের সেই ল্যান্ডস্কেপ যেখানে আধুনিক সভ্যতার উপস্থিতি সবে শুরু হয়েছে। রুক্ষ প্রান্তর, লালচে মাটির অ্যারিজোনা বা টেক্সাসও হতে পারে; আবার এমন স্থানও হতে পারে মিসিসিপির ধারে, যেখানে সবুজের প্রাবল্য বেশি। এক সময়ে দেখব যে এই সমধর্মী ল্যান্ডস্কেপ আমেরিকা ছাড়িয়ে ভিন্ন দেশেও পাওয়া গেলে, তাকে ওয়েস্টার্ন মনে হবে।
কিন্তু এই ল্যান্ডস্কেপ কিছুতেই পাবেন না গ্যাংস্টার বা ফিল্ম নোয়ায়। সেখানে নাগরিক পরিসর খুব জরুরি হয়ে যাবে।
একইভাবে পোশাক। ওয়েস্টার্নকে অনেকে ‘কাউবয় ফিল্ম’ বলতেন। কাউবয় জীবিকার সঙ্গে জড়িত একটি বর্ণনা; গরু চড়ায় যে ছেলেরা। কিন্তু গত একশো বছরের দর্শকের কাছে কাউবয় হল মূলত একধরনের জিনসের টুপি এবং দৃশ্যমান হোলস্টারে রিভলভার– এরকম একটি সমাহার। এই পোশাকটা ঠিক গ্যাংস্টারে পাবেন না। সেখানেও টুপি আছে, কিন্তু তার ধরন ভিন্ন। সেখানেও বন্দুক আছে; কিন্তু লোকানো পোশাকের তলায়। ওয়েস্টার্নে একজন রেড ইন্ডিয়ান তার প্রাগাধুনিক পোশাকে থাকবেন। তাকে যদি কদাচিৎ গ্যাংস্টারে দেখা যায়, তাহলেও তিনি নাগরিক পোশাক পরিহিতই থাকবেন।
অথবা অন্যান্য ভিজুয়াল অনুষঙ্গ, যেমন যান বা বাহন। আগের একটি কিস্তিতে ওয়েস্টার্নে ঘোড়া আর গ্যাংস্টারে গাড়ির কথা বলেছি। ওয়েস্টার্নে ঘোড়ার উপস্থিতি প্রায় অবধারিত। হয়তো কিছু ছবি হয়েছে, যাতে সিনেমার এই প্রিয় প্রাণীটি উপস্থিত নয়। কিন্তু সেই ছবিতে যেন প্রেতের মতো এই বলিষ্ঠ অথচ শান্ত প্রাণীটি হাজির থাকে। যেন ফ্রেমের পাশেই অফ-স্ক্রিনে আছে। ব্যবহারের মুনশিয়ানাতেই সত্যজিতের ‘অভিযান’-এ সেই আদ্যিকেলে গাড়িটা যেন খানিক ঘোড়ার মতোই লাগে; এবং গোটা ছবিতে ঘোড়া না থাকলেও শেষ স্বপ্নদৃশ্যে ঘোড়াখানি নরসিংহ-র অভীষ্ট বাহন হিসেবেই আবির্ভূত হয়।
অথবা ট্রেন। ওয়েস্টার্নে লোকোমেটিভ ট্রেন বিশেষ দ্যোতনা বহন করে। আগামী এক কিস্তিতে এই নিয়ে বিস্তারিত বলব, আপাতত এইটুকুই, রেললাইন ও ট্রেন ওয়েস্টার্নে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নগর-সভ্যতার প্রতীক। অর্থাৎ, আগত ভবিষ্যতের ধ্বজাধারী; এবং সেই জন্যই একধরনের কৃষিকেন্দ্রিক জগতের দিন গোনা শুরু হয় রেললাইন বা ট্রেনের দৃশ্যত আগমনে।
এতটা শুনেই বাঙালির একটি বিচিত্র অনুভূতি হতে পারে। যেন এই বাক্যগুলো খুব চেনা একটি দৃশ্যের দেজা ভু নিয়ে আসছে। হ্যাঁ, ‘পথের পাঁচালী’-র সেই কাশফুলের মাঠে ট্রেন দেখার দৃশ্য। নিশ্চিন্দিপুরের সীমানাকে সরলরেখায় বলিষ্ঠভাবে এঁকে চলে যায় ট্রেনটি; শুধু স্থানের সীমানাই আঁকে না, আঁকে কালের সীমানাও, ‘সেকাল’ আর ‘একাল’-এর মাঝের রেখাও। একইভাবে, এই ট্রেনের আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিল টেলিগ্রাফের লাইন। পাইলন থেকে পাইলনে টানা তার, যাতে বিজাতীয় সোঁ সোঁ আওয়াজ হতে থাকে, সেই তার পার্সপেক্টিভাল লাইনের মতোই দিগন্তে ভ্যানিশিং পয়েন্টের দিকে চলে যায়। অপু আর দুর্গা বোঝে যে তারা অজানার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। রেললাইন এবং টেলিগ্রাফ লাইন ওয়েস্টার্নেও একই অনুসঙ্গ আনে। অতীত ও পল্লিজীবনের প্রান্ত এবং নগরজীবন ও ভবিষ্যতের শুরু, একই দ্যোতনায়।
এভাবেই, বিভিন্ন জঁরের বিভিন্ন শব্দও আছে। ‘পথের পাঁচালী’-র সেই চিরস্মরণীয় দৃশ্যে টেলিগ্রাফ তারের রিনরিন, বাতাসের সোঁ সোঁ (পরের দৃশ্যে বাঁশবনের আওয়াজ) একধরনের ইরি (eerie) এবং অমিনাস (ominous) তৈরি করে, যার নন্দনতত্ত্ব সোজাসুজি হরর ছবি থেকে আসে। হরর ছবিতে ভূত বা ভয়ংকরের উপস্থিতি আগে পাওয়া যায় শব্দে। শব্দই জানান দিতে থাকে যে অমোঘ সেই মুহূর্তে এই আগত আতঙ্ক দৃশ্যমান হবে।
অতএব জঁর মানে শুধুই গল্পের ধরন নয়। এখানেই সাহিত্যে উৎস ঘটলেও সিনেমায় এই গোত্রের ধারণাটি প্রায় স্বকীয়তা পায়। ল্যান্ডস্কেপ, পোশাক, প্রপস, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে শারীরিকতাও এক একটি জঁরে এক এক রকমের হয়ে যায়। ভিন্ন হয়ে যায় বাচনপ্রক্রিয়া, সংলাপের ভাষা বা অভিনয়শৈলী। সেরকমভাবেই শব্দ বা সংগীতের ব্যবহারও ভিন্ন রকমের হয়। আমরা বাঙালিরা জঁর বলতে ‘গল্পের ধরন’ বুঝে আসছি দীর্ঘদিন, বা বড়জোর গল্পের আবহ। তাই আমাদের ভূতের গল্প হয় গা ছমছমে, অথবা আমাদের প্রেমের গল্প হয় মনকেমন করা। কিন্তু সিনেমা এইটুকুতেও ক্ষান্ত হয় না। কী ধরনের উপাদানে গা ছমছম করে? মন কেমন কেমন করবে কি শুধুমাত্র আখ্যান আর চরিত্রের জন্য? যে গল্প গা ছমছমে, আর যে গল্প মনকেমন করা, তাতে রঙের ব্যবহার কীভাবে ভিন্ন হবে? দৃশ্যে ফুল বা ফুলগাছ কি থাকতে পারে ভূতের গল্পে? প্রেমের গল্পে তো থাকেই। এই সামান্য ডিটেলগুলি আধুনিক জঁরের ভাবনায় অতএব নিয়ে আসে সিনেমায় সেই উপাদানের একটি ইতিহাসের অনুসঙ্গ (ঠিক যেভাবে প্রথম কিস্তিতে ঘোড়া আর গাড়ি নিয়ে বলেছিলাম)।
আবার, জঁর মানে শুধুই দৃশ্য-শ্রাব্য উপাদান বা বিন্যাস নয়। হ্যাঁ, চরিত্র, আখ্যানধর্ম ও নৈতিক বিশ্বও। কিন্তু সেই নিয়ে পরে কথা হবে।
আপাতত, ‘পথের পাঁচালী’-র সেই ট্রেনের দৃশ্যই যেহেতু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এবং ‘অভিযান’-এর প্রসঙ্গও এসেছে (মনে পড়ে গেল সেই ট্রেন আর ছ্যাকরা গাড়ির রেসের কথা!), সত্যজিতের আরেকটা ছবির দৃশ্যও মনে এল। সেই দৃশ্যে ট্রেনের ব্যবহারে প্রায় ওয়েস্টার্নের থ্রিল উঁকি মেরে চলে যায়! ‘সোনার কেল্লা’-য় ফেলুদা, তোপসে এবং জটায়ুর উটে চড়ে ট্রেনের দিকে ধাওয়া করে থামানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার সেই দৃশ্য!
…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্ব…
২. ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার পূর্বসূরি দুই নায়ক ও একটি ছদ্মবেশী জঁর