ঈশ্বরের ওপর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৬ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে বেরিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ঘন ঘন তুমুল করতালিধ্বনিতে অভিনন্দিত হল তাঁর ভাষণ। ইয়েল্ৎসিন ঘোষণা করলেন: ‘পৃথিবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। কমিউনিজমকে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে হচ্ছে না।’ কিন্তু বলতে ভুলে গেলেন যে তাঁর নিজের দেশে কমিউনিস্টরা রয়েই গেছে। বুশকে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়ে এলেন, পার্লামেন্টে কমিউনিস্টদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে তার কতদূর কী শেষ পর্যন্ত পালন করা সম্ভব হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ থেকেই গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনি জয় করলেন, কিন্তু নিজের দেশকে এখনও তিনি বশে আনতে পারেননি।
৫০.
উৎসাহে ভাঁটা, খোলা হাওয়ার দাপট
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২। গত ১৯-২২ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতি। স্মৃতি তর্পণ ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে উদ্যাপিত হল নতুন একটি বার্ষিকী। গত বছরের আগস্টে হঠকারিতার ফলে কমিউনিস্টদের পতন এবং গণতন্ত্রের বিজয় উপলক্ষে এই উৎসবের নামটি বিজাতীয়– ‘ভিভা রাশিয়া’। জাতীয় উৎসবের আকার অবশ্য নিতে পারল না, সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও। এই উপলক্ষে স্মারক মুদ্রা প্রবর্তন এবং রাশিয়ার হোয়াইট হাউস রক্ষাকারীদের স্মারক পদক প্রদান, তথা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও জনসমাজে আশানুরূপ সাড়া জাগল না। আগস্টের ঘটনাবলির একবছর পরে, দেশের লোক ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না তারা কী করবে ওই জয়ন্তী উৎসবে। দ্ব্যর্থক কথায় ও কাজে যার জুড়ি নেই, উৎসবের প্রাক্কালে সেই প্রেসিডেন্টের নিজেরই আচরণ ছিল অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত। প্রথমে বলেছিলেন, পুরো আগস্ট মাস মস্কোয় কাটাবেন, পরে নতুন করে কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই জেনে হুট করে ছুটি কাটাতে চলে গেলেন কৃষ্ণসাগর উপকূলে। ফিরে আসার দিন ছিল ১৬ আগস্ট। শেষ মুহূর্তে ছুটি আরও বাড়িয়ে নিলেন ২ দিনের জন্য, ফিরলেন ঠিক বার্ষিকীর দিনে। না, উৎসব উপলক্ষে কোথাও কোনও বাণী দিলেন না। উপরন্তু তাঁর প্রেস-সেক্রেটারি মারফত জানালেন, দেশ যখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে এমন এক বার্ষিকী উপলক্ষে উৎসব উদ্যাপনকে তিনি কুরুচির পরিচায়ক মনে করেন। ১৯ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দূরদর্শনে ভাষণ দিয়ে তিনি তাঁর কর্তব্য শেষ করলেন। তাই পরদিন সন্ধে ন’টায় হোয়াইট হাউসের সামনে যখন বাজনা বাজিয়ে জনসভার সূচনা ঘোষিত হল, তখন সমবেত জনতা ‘ইয়েল্ৎসিন’ বলে চিৎকার করলেও তাদের নিরাশ করলেন প্রেসিডেন্ট– ব্যালকনিতে তাঁর জায়গায় আবির্ভাব ঘটল পার্লামেন্টের স্পিকারের। তাছাড়া সমাবেশও আশানুরূপ ছিল না– মাত্র হাজার পাঁচেকের জনতা। গত বছরের ঘটনার পর যেমন ঘটেছিল, এবারেও ২২ আগস্ট রাশিয়ার হোয়াইট হাউসের সামনে ‘রক অন দ্য ব্যারিকেড্স’ নাম দিয়ে নামজাদা শিল্পীদের অংশগ্রহণে এক জলসা আয়োজিত হয়েছিল। একে ‘ফ্লপ অন দ্য ব্যারিকেড্স’ বলাই ভালো। সাকুল্যে দু’হাজার মানুষের সমাবেশ। গত বছরের মতোই ‘পাঙ্ক’ ও ‘রকার’-এর হুজ্জতি, বোতল ছোড়াছুড়ি, খণ্ডযুদ্ধ। আর জনগণ? তাদের মধ্যে প্রায় কোনও মতভেদ নেই। কোনও কিছুতেই তাদের আসে-যায় না– তাদের এখন অন্য চিন্তা–অন্ন চিন্তা। গত বছরের আগস্টের ঘটনা আজ আর কেউ স্মরণ করে না। এমনকী কমিউনিস্ট স্মৃতিচিহ্ন– লেনিন বা বলশেভিক নেতাদের অবশিষ্ট মূর্তিগুলি সরাতে বা ভাঙতে কারও কোনও আগ্রহ নেই। শুধু কি তাই? সাংবিধানিক আদালতে, পার্টির মামলার শুনানি এবং চক্রীদের ভাগ্যের ব্যাপারে জনসাধারণ আর মাথা ঘামায় না। এই কিছুদিন আগেও জনসাধারণের হাতে তাঁদের লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু আজ তাঁদের ছেড়ে দিলে কেউই কিছু মনে করবে না।
দেশটা যতদিন ‘নিষিদ্ধ দেশ’ নামে পরিচিত ছিল, ততদিন জানতাম ‘চোরাকারবারি’ বা ‘ফাটকাবাজ’ কথাগুলি এদের অভিধানে নেই। সত্য যখন উপলব্ধি করতে পারলাম তখন মনকে প্রবোধ দিতাম এই বলে যে, ওরকম লোকের সংখ্যা এদেশে নগণ্য। কিন্তু দুষ্ট ক্ষত যে কতদূর ছড়াতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেল সত্তরের বছরগুলির শেষদিকে। চোখের সামনে আমরা দেখতে পেলাম রমরমা অবস্থা একশ্রেণির মানুষের, আয়ের সঙ্গে যাদের ব্যয় মেলে না, যাদের আছে গাড়ি, কো-অপরেটিভের বাড়ি, শহরের বাইরে বাগানবাড়ি আর মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। উৎকোচ, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ততদিনে ঢুকে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দেখা দিয়েছে এক সুবিধাভোগী শ্রেণি– পেরেস্ত্রৈকা এদের জন্য, না এদের বিরুদ্ধে– সাধারণ লোক বুঝতে-না-বুঝতে এরাই রাতারাতি ভোল পালটে পেরেস্ত্রৈকার ধ্বজধারী হয়ে দাঁড়াল।
…………………………………………….
নির্দেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দালানগুলি প্রায় খালি হয়ে গেল, মস্কোর কোনও কোনও অঞ্চল ফেরিওয়ালা ও পসারির ভিড়ে এমন ছেয়ে গেল যে পথচলা দায়। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে জামাকাপড়, মনিহারি জিনিস– সবই বিক্রি হচ্ছে রাস্তায়, রাস্তার ওপরই লোকে জামাকাপড়, জুতো মেপে দেখছে, কিনছে। অনেক সময় সরকারি দোকানগুলির সামনেই বিক্রি হচ্ছে সেখান থেকে পাচার করা জিনিস, রিলিফের মাল। আজকাল সরকারি জিনিসের ওপরও দামের কোনও ছাপ মারা থাকে না। এমনকী রাস্তায় খবরের কাগজের ফেরিওয়ালাদেরও স্বাধীনতা আছে যেমন খুশি দাম হাঁকার– কাগজের ওপর লেখাই থাকে ‘খুচরো মূল্য যদৃচ্ছা’।
…………………………………………….
পুনর্গঠনের সঙ্গে খোলা হাওয়ার দাপটে পেরেস্ত্রৈকার আমলে এক বিপ্লব ঘটে গেল– যা ছিল চোরাবাজার তা হয়ে দাঁড়াল খোলাবাজার– আর কোনও রাকঢাক নেই। রাস্তাঘাটে বসে গেল বিকিকিনির হাট, জুয়া খেলার আসর। মাঝেমধ্যে পুলিশি হানা– আমাদের দেশের হল্লাগাড়ি কায়দায় চোর-পুলিশ খেলা।
এখন চলছে উত্তর-পেরেস্ত্রৈকা পর্ব। অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহদানের খাতিরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এই বছর ২৯ জানুয়ারি একটি হুকুমনামা জারি করে জাতিকে আরও এক পদক্ষেপ এগিয়ে দিলেন সভ্যজগতের পথে। হুকুমনামায় বলা হয়েছে: ‘এখন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি গাড়ি চলাচলের রাস্তা, পাতাল রেলের সাবওয়ে এবং সরকারি দপ্তরের দালানসংলগ্ন এলাকা বাদে তাদের সুবিধামতো যে-কোনও জায়গায় গাড়িতে করে বা হাতে হাতে জিনিসপত্র ফেরি করতে পারেন। স্থানীয় শাসনসংস্থাগুলিকে এই ব্যাপারে সহায়তাদানের অনুরোধ জানানো হচ্ছে।… ‘ দ্রব্যমূল্যের ওপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার পরও যখন পণ্যদ্রব্যে বাজার ছেয়ে গেল না, কলকারখানা, খামার একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে লাগল, ঘাটতির পরিমাণ যখন আরও বাড়তে লাগল, আর তার ফলে দ্রব্যমূল্য উত্তরোত্তর চড়তে লাগল, তখন সরকার বাজারের পথ প্রশস্ত করার জন্য জারি করল এই নতুন নির্দেশ। এই সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রীর মন্তব্য: ‘এই নির্দেশ ঘোষিত হওয়ার পর আমাদের অভিধান থেকে ‘ফাটকাবাজ’ শব্দটি চিরতরে উঠে গেল। ব্যাবসামাত্রই যে আইনসম্মত ও হিতকর এখন থেকে আমাদের সেটা মেনে নিতে হবে– তা সে ব্যাবসার রূপ যাই হোক না কেন।’
নির্দেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দালানগুলি প্রায় খালি হয়ে গেল, মস্কোর কোনও কোনও অঞ্চল ফেরিওয়ালা ও পসারির ভিড়ে এমন ছেয়ে গেল যে পথচলা দায়। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে জামাকাপড়, মণিহারি জিনিস– সবই বিক্রি হচ্ছে রাস্তায়, রাস্তার ওপরই লোকে জামাকাপড়, জুতো মেপে দেখছে, কিনছে। অনেক সময় সরকারি দোকানগুলির সামনেই বিক্রি হচ্ছে সেখান থেকে পাচার করা জিনিস, রিলিফের মাল। আজকাল সরকারি জিনিসের ওপরও দামের কোনও ছাপ মারা থাকে না। এমনকী রাস্তায় খবরের কাগজের ফেরিওয়ালাদেরও স্বাধীনতা আছে যেমন খুশি দাম হাঁকার– কাগজের ওপর লেখাই থাকে ‘খুচরো মূল্য যদৃচ্ছা’।
কিন্তু না, রাস্তার এই বিকিকিনির হাটে মূল্য একেবারে যদৃচ্ছা একথা মনে করা ঠিক হবে না। সরকারের হাত থেকে বাজার চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু ক্রেতা ও বিক্রেতা, চাহিদা ও জোগানের নিয়ম এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না– নিয়ন্ত্রণ করে সঙ্ঘবদ্ধ মাফিয়া। তারাই দর বেঁধে দেয়। জিনিস নষ্ট হয়ে গেলেও বিক্রেতার অধিকার নেই দাম কামানোর। মাফিয়ার দৃষ্টি সজাগ। একাধিক বার বাজারে চিনি ও সিগারেট কিনতে গিয়ে সে-অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেদিন একজন রাস্তার দোকানি ৬০ রুবল কিলো দরে চিনি দেবে বলে কথা দিলেও বিক্রি করতে পারল না আমার কাছে। শেষ মুহূর্তে আড়চোখে পাশে তাকিয়ে আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল পারব না, পাশে তাকাতে মস্তান গোছের একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হল না। একজন এক কুড়ি সিগারেট ১৫ রুবলের জায়গায় ১৩.৫০ রুবলে দিতে চাইলে তার হাল আরও খারাপ হল– সেই এলাকা থেকে টেনে বার করে দিল দুই মস্তান। দেখেছি এই বাজারে দরাদরি করার কোনও অর্থ হয় না– দর বাঁধা আছে। মস্তানরা বখরা পায়। পুলিশের বিশেষ কোনও ভূমিকা দেখলাম না।
এ-বাজারে সকলেই যে ফাটকায় নেমেছে তা নয়। সামান্য বেতন বা পেনশনের টাকায় সংসার চালানো দায়। ব্যাঙ্কে যে জমানো টাকা ছিল তাও নিঃশেষ, তাই অনেকে এখন বাড়িতে সঞ্চিত খাদ্যদ্রব্য, জামাকাপড়, হাঁড়িকুড়িও বিক্রি করছে। এদের অধিকাংশই মাঝবয়সি। চেনা লোকজনের নজর এড়ানোর জন্য বেপাড়ায় যান জিনিসপত্র বেচতে।
অবাধ বাণিজ্যের কল্যাণে গোটা শহরটা যখন কোলে মার্কেটে পরিণত হওয়ার অবস্থা, বাজারের ভিড় আর আবর্জনাস্তূপের ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের অবস্থা যখন প্রাণান্তকর হয়ে উঠল তখন পুরসভা সরকারি নির্দেশ খানিকটা সংশোধন করল– শহরের কেন্দ্রস্থলের ছয়টি বড়রাস্তায় কেনা-বেচা করা যাবে না। কিন্তু জিনিসপত্র বিক্রি করতে ইতিমধ্যেই যে-জনতা পথে নেমেছে তার ভিড়টা যাবে কোথায়? ফলে কেন্দ্রীভূত হল অনুমোদিত এলাকাগুলিতে– সেসব জায়গায় একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই– ভিড় আপনাকে ঠেলে নিয়ে যাবে উজানে। আর নিষিদ্ধ জায়গাগুলিতে? সেখানে পসারিদের ভিড় কমলেও একেবারে যায়নি। এবারে ভূমিকায় অবতীর্ণ হল পুলিশ। ভাগীদার বাড়ল, ফলে জিনিসের দাম আরও বাড়ল। শহরের জঞ্জালও বেড়ে চলল।
……………………………………..
স্থানীয় একটা চুটকি মনে পড়ে গেল। পেরেস্ত্রৈকার প্রথম দিককার কথা। গর্বাচ্যোভ্ একবার এক কারখানা-শ্রমিককে প্রশ্ন করেন এক-বোতল বোদ্কার দাম ২০ রুবল হলে সে ভোদ্কা খাবে কিনা। উত্তর : ‘অবশ্যই খাব।’ ‘যদি ৬০ হয়?’ ‘খাব’। ‘১০০ হলে?’ – ‘তাও খাব’। ‘১৫০ হলে?’ ‘না, খাব না?’– ‘কেন?’ ‘কেননা আমার মাইনে ১০০-র বেশি নয়’– শ্রমিকের উত্তর।
……………………………………..
ঈশ্বরের ওপর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৬ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে বেরিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ঘন ঘন তুমুল করতালিধ্বনিতে অভিনন্দিত হল তাঁর ভাষণ। ইয়েল্ৎসিন ঘোষণা করলেন: ‘পৃথিবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। কমিউনিজমকে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে হচ্ছে না।’ কিন্তু বলতে ভুলে গেলেন যে তাঁর নিজের দেশে কমিউনিস্টরা রয়েই গেছে। বুশকে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়ে এলেন, পার্লামেন্টে কমিউনিস্টদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে তার কতদূর কী শেষ পর্যন্ত পালন করা সম্ভব হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ থেকেই গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনি জয় করলেন, কিন্তু নিজের দেশকে এখনও তিনি বশে আনতে পারেননি। ফিরে এসে তিনি কী দেখতে পেলেন? মাত্র কয়েক দিনের অনুপস্থিতি– কিন্তু এরই মধ্যে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতর আকার ধারণ করেছে। মল্দোভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ স্লাভ জনগোষ্ঠীর সার্বভৌমত্বের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে রাশিয়া। জর্জিয়ার সঙ্গেও যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে রাশিয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত মেলানোর অতিরিক্ত উৎসাহে একের পর এক যে সমস্ত ঘোষণা তিনি সেখানে করলেন দেশের মাটিতে কমিউনিস্ট, দেশপ্রেমী ও জাতীয়তাবাদী– সকলের কাছেই সেগুলি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ আখ্যা পেল। সাংকত্ পেতের্বুর্গ ও মস্কোর টেলিভিশন কেন্দ্রের সামনে, প্যালেস স্কোয়ার আর রেড স্কোয়ারে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে নিত্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ– কমিউনিস্ট, অ-কমিউনিস্ট, কমিউনিস্টবিরোধী ও জাতীয়তাবাদীদের ভেদাভেদ লোপ পেয়েছে সেখানে। স্বাধীন বাজার ব্যবস্থা চালু হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও পণ্যসামগ্রীর দাম ক্রমাগত এমনই ঊর্ধ্বগামী হয়ে চলেছে যে লোকের মাইনে তার ধারে কাছে যেতে পারছে না। ফলে বহু মানুষেরই খাবার এবং অন্যান্য কিছু কিছু জিনিস কেনার অভ্যাস পাল্টাতে হচ্ছে। সীমিত হয়ে পড়ছে মানুষের চলাফেরার অভ্যাসও। গত বছরের ১ এপ্রিল সরকারি পরিবহনের ভাড়া ৫ কোপেক থেকে বেড়ে হয়েছিল ১৫, জানুয়ারিতে ৫০, কিন্তু গত ২৪ জুন আগে থেকে কোনও ঘোষণা ছাড়াই রাতারাতি বেড়ে হয়ে গেল ১ রুবল। এক বছরে ২০ গুণ বৃদ্ধি। আকাশছোঁয়া দামের ফলে দুধ ও চিনির মতো দুষ্প্রাপ্য বস্তু বাজারে পাওয়া অবশ্য অনেকটা সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় মাসের মধ্যে বাজারে জিনিসের দাম বেড়েছে ১০৩ শতাংশ, অথচ লোকের গড়পড়তা বেতন বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। ইয়েল্ৎসিন যখন অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেন তখন জনসাধারণের গড়পড়তা মাসিক বেতন ছিল ৯০০ রুবল, এখন বেড়ে হয়েছে ১৯৫০ রুবল। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চিনির দাম। বাজারে নিয়মিত চিনি আসতে শুরু করে মাত্র জুন মাস থেকে। ইয়েল্ৎসিনের সংস্কারের আগে এক কিলোগ্রাম চিনির দাম ছিল ২.৪০ রুবল। এখন তার ন্যূনতম দাম ৬৮ রুবল। ২ জানুয়ারির আগে এক পাউন্ডের একটা রুটির দাম ছিল ৬০ কোপেক– এত সস্তা যে গর্বাচ্যোভ একবার অভিযোগ করেছিলেন যে রুটি দিয়ে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। সে নয়নাভিরাম দৃশ্য অবশ্য আমার দেখার সুযোগ কোনও দিন হয়নি, তবে এক বছর আগেও রুটির দাম যখন ১৮ কোপেক ছিল তখন টুকরো টুকরো করে গুঁড়িয়ে পায়রাদের খাইয়ে অনেককে তৃপ্তি পেতে দেখেছি, শুনেছি গ্রামদেশ পশুখাদ্যের অভাবে বস্তা বস্তা কিনে শুয়োরকেও খাওয়ানো হত।
স্থানীয় একটা চুটকি মনে পড়ে গেল। পেরেস্ত্রৈকার প্রথম দিককার কথা। গর্বাচ্যোভ্ একবার এক কারখানা-শ্রমিককে প্রশ্ন করেন এক-বোতল বোদ্কার দাম ২০ রুবল হলে সে ভোদ্কা খাবে কিনা। উত্তর : ‘অবশ্যই খাব।’ ‘যদি ৬০ হয়?’ ‘খাব’। ‘১০০ হলে?’ – ‘তাও খাব’। ‘১৫০ হলে?’ ‘না, খাব না?’– ‘কেন?’ ‘কেননা আমার মাইনে ১০০-র বেশি নয়’– শ্রমিকের উত্তর। সেই ভোদ্কার একচেটিয়া কারবার সরকারের হাতে থাকায় তা থেকে মোটা লাভের অঙ্ক সরকারের তহবিলে আসত। এখনও সরকারের হাতে আছে, তবু তা তার একচেটিয়া অধিকারে আছে এমন কথা বলা যায় না। বিদেশি ভোদ্কা বাজারে ছেয়ে গেছে। ফ্রান্সের রাস্পুতিনের পাশে দিব্যি শোভা পাচ্ছে জার্মানির গর্বাচ্যোভ্– অবশ্য শোনা যায় সেরা জার্মান গর্বাচ্যোভের সম্মানে এই ব্র্যান্ড নয়– ইনি নাকি জারের আমলের কোনও এক জেনারেল গর্বাচ্যোভ্। আছে মার্কিন দেশে তৈরি স্মিরনফব্র্যান্ড ভোদ্কা। শুনেছিলাম নেপোলিয়ানকে যিনি তাঁর রণকৌশলে রুশ দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন সেই রুশ সেনানায়ক কুতুজভ সম্মানে ফরাসি দেশে প্রচলিত নেপোলিয়ান ব্র্যান্ড অনুকরণে রাশিয়া কর্তুজভ্ ব্র্যান্ডি দেখতে পাচ্ছি না। রুশি ভোদকার তুলনায় এগুলির দাম সামান্য বেশি। কিন্তু আরও সস্তায় অর্ধেক দামে পাওয়া যায় বেলজিয়াম অ্যালকোহল– এক লিটারের বোতল ৪০০ রুবল। অর্ধেক জল মেশালেই খাঁটি ভোদ্কা– ১০০ রুবলও পড়ছে না একবোতল ভোদ্কা। রুশিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, কিন্তু টনক নড়ছে না।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংস্কারের অন্যতম প্রত্যক্ষ ফল রাশিয়ায় বেকার সমস্যার দ্রুত বৃদ্ধি। অন্যান্য বহু সমস্যার মধ্যে এটাও এদেশের এক নতুন সমস্যা। সবচেয়ে আশাবাদী যে-পূর্বাভাস তাতেই বলা হয়েছে ১৯৯২ সালে রাশিয়ার প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু বাজার-অর্থনীতি যদি ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে উৎপাদনের হার ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে, ফলে ৮ কোটি ৬৩ লক্ষ কর্মরত মানুষের মধ্যে দেড় থেকে দুই কোটি পর্যন্ত বেকার হবে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেকার সমস্যা আরও দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাবে।
রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী গাইদার কিছুকাল আগে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমাদের সংস্কারের ধাক্কা সকলে সহ্য করতে পারবে না।’ বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক রয় মেদ্ভিয়েদেভ্ এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন: ‘পশ্চিমের এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলেন, আমাদের দেশের কোনো সরকারি আমলা এরকম মন্তব্য করলে তাঁর ওপর বিরূপ সমালোচনার এমন ঢেউ এসে পড়ত যে ওখানেই তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটত। কিন্তু রাশিয়ায় তা হয় না।’
বাস্তবিকই অর্থনৈতিক সংস্কারের এই ধাক্কা অনেকের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। সম্প্রতি রাশিয়ায় আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দারিদ্রের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পরিবারের সকলকে হত্যা করে আত্মহত্যার বা সপরিবারে আত্মহত্যার ঘটনাও আজকাল শোনা যাচ্ছে। দুই শিশুসন্তানের হাত ধরে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে মহিলার আত্মহত্যা, পরিবারের সকলে মিলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা– এগুলি ইদানীং কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দরিদ্র দেশের সাধারণ চিত্র।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। রাশিয়ার উত্তরে ছোট একটি শহর মিনুসিন্স্ক। ঋণে জর্জরিত যুবতী মা, বয়স ৩০-এর কাছাকাছি, দুই সন্তানের জননী। ছেলের বয়স এগারো, মেয়ের দশ– ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাদের গলা টিপে হত্যা করে নিজে বিষপানে আত্মহত্যা করে। মেয়ের স্কুলের খাতারই এক পাতায় লিখে গেছে কোথায় কত দেনা আছে, কীভাবে শোধ করতে হবে তার নির্দেশ! শেষ কথা– ‘জানি আমার মৃত্যুর পর কারও প্রয়োজনে লাগবে না আমার সন্তানরা, তাই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি তাদের।’ এই কিছুদিন আগেও আশা ছিল আগামী কাল বাঁচা সহজ হবে। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে বিনামূল্যে আহার পাচ্ছিল, গরমের ছুটির সময় নামমাত্র মূল্যে হলিডে হোমে যেতে পারত, অবসর সময়ে শখের ক্লাবে বা আসরে যাওয়ার সুযোগ পেত, নতুন ফ্ল্যাট পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এল অন্য সময়। এখন আর তার সন্তানদের প্রয়োজন নেই কারও। এখন সবই নির্ধারণ করছে অর্থ, যা তার নেই।
১৯৮৫ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ১,০০,০০০ মানুষ পিছু ২৪.৫ টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পরে ১৯৮৭ সালে সেই সংখ্যা নেমে আসে ৯.১৩– তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচ্যোভের পুনর্গঠন নীতির ফলে। বর্তমানে একমাত্র রাশিয়াতেই আত্মহত্যার হার প্রতি এক লক্ষে ২৪.৮ অথবা দৈনিক একশো জনেরও বেশি।
প্রতিটি আত্মহত্যার পিছনে আছে দশটি করে আত্মহত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা– এটা মনে রাখলে সমস্যা যে কতদূর গভীর, তা অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না।
পেনশনভোগী, বিধবা এবং পঙ্গু বা অশক্তদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। ১৫-১৯ এবং ৫৫-৫৯ বয়ঃসীমার লোকদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। ৭০ অথবা তদূর্ধ্বদের মধ্যে আত্মহত্যার সম্ভাবনা ৩.৫ গুণ বেশি। এসবই সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের সাক্ষ্য বহন করছে।
ভবিষ্যতে আমরা কী আশা করতে পারি? সমাজতত্ত্ববিদদের কথায়– অর্থনৈতিক সংকট এবং জীবনযাত্রার মানের নিম্নগামিতার ফলে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এমন মনে করারও কোনও কারণ নেই। বিশেষজ্ঞ মহলে এটা সুবিদিত যে যুদ্ধ, রাষ্ট্রবিপ্লব, মহামারী এবং অন্যান্য সামাজিক দুর্বিপাকের সময় আত্মহত্ম্যার সংখ্যা তীব্রভাবে হ্রাস পায়। এটা এ দেশের পক্ষে আশার বাণী না নিরাশার বাণী?
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’