বিরোধী বলে, শাসকের প্রায় সব কাজেই ভুল হচ্ছে। আর, শাসক বলে, প্রশাসন তো চালাতে হয় না, শুধু বাইরে থেকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা। বিরোধী কালের নিয়মে শাসক হয় একদিন, আবার উলটোটাও। তখন তাদের পারস্পরিক স্বর বদলে যায়। রাজনীতির চলতি ধারা এভাবেই বয়ে চলে। তবে, এই বাইনারি পেরিয়ে আর একটা ভূমিকা থেকে যায়, তা এই অভিভাবকের। সে ভূমিকা মূলত শাসকেরই। শাসক-বিরোধীর চলতি বয়ান পেরিয়ে শাসক কখনও সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মানুষ যা চাইছেন, তা মিটিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না।
অলংকরণ: শান্তনু দে
৫.
শাসন করা তাহার সাজে, সোহাগ করে যে সবার মাঝে।
প্রচলিত, শোনা কথা, সকলেই শুনেছেন। সেই চেনাশোনা কথাটাই আজ আবার নতুন করে পাড়লাম। কেননা, এই ‘শাসন’ শব্দটিকেই আজ নতুন করে দেখতে চাইছি। দেখতে চাইছি, নতুন এক ঘটনার প্রেক্ষিতে। বহুকালের এই চেনা কথাটি সচরাচর বলা হয় অভিভাবকদের সম্পর্কে। ‘অভিভাবক’ শব্দটি বৃহত্তর অর্থে নিয়েই আমাদের সামনে আসে। মা-বাবা, শিক্ষক, গুরু, কোচ সকলেই এই শব্দের অন্তর্ভুক্ত।
সেই অভিভাবকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন? রাজনীতির ভাষা ধার করে বলতে গেলে, খানিক শাসক-বিরোধী সম্পর্কই বটে! শিক্ষক বা সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের অভিভাবকদের আপাতত একটু সরিয়ে রেখে, যদি বৃত্তটি পরিবারে টেনে নিয়ে আসি, তাহলে উদাহরণটি স্পষ্ট হবে। এ কথা সকলেই মানবেন, অভিভাবক বলবেন উত্তর, তো অনুজ যাবে দক্ষিণে। এই ঝামেলা চলতেই থাকে। বলা ভালো, বাড়তেই থাকে। ছোটবেলায় ততটা নয়। যত বড় হওয়া, তত বিরোধ বাড়ে। ‘এটা করবে না’, ‘সেটা কেন করছ!’ ইত্যাদি প্রভৃতি ছোট ছোট নিষেধের ডোর। এদিকে, যে কি না নতুন যৌবনের দূত, যে কি না চঞ্চল এবং অদ্ভুত, সে কেন এত নিষেধ মেনে চলবে! অতএব পদে পদে ঠোক্কর। রাগারাগি। এমনকী, কথা বলা বন্ধ বা মুখ দেখাদেখি অবধি স্থগিত হয়ে যেতে পারে। পরিবারের মধ্যে এহেন ঘটনার সাক্ষী হয়নি, এমন বোধহয় কেউ নেই। আর এ বোধহয় খুব স্বাভাবিক ঘটনাও। অভিভাবকরা, তাঁদের বয়স এবং অভিজ্ঞতার কারণেই নানাবিধ বিধিনিষেধ তথা গাইডলাইন তৈরি করতে থাকেন। আর যাঁরা নতুন দিনের পথিক, তাঁরা স্বভাবতই সবকিছু একবাক্যে মেনে নিতে চান না। এ তো চিরকালীন সত্য বলা চলে।
এই বিরোধে ঘরে কাক-চিল না বসতে পারে, তবে, এর একটা ভালো দিকও আছে। অভিভাবকরা নিশ্চয়ই তাঁর সন্তানদের ভালো চান। চান বলেই, বিপদ-আপদের সম্ভাবনা থেকে আগলে আগলে রাখতে চান। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। অভিভাবকরা যে সময়কে নিজেদের মধ্যে বহন করে নিয়ে যান, তা মূলত অতীত। অন্যদিকে, অনুজরা নতুন সময়কে আহ্বান জানাতে চায়। সে সময় অনাগত, তবে তাতে নতুনের রং ধরেছে। পুরনোর সঙ্গে সেই নতুনের খানিক বিরোধ তা বাধবেই। তা একদিক থেকে সদর্থকই বলতে হবে। কেননা এই সংঘর্ষ বা গ্রহণ-বর্জন না হলে সময়টা একঘেয়ে এক টেমপ্লেটে থেকে যেত। তা হয় না। তা হতে পারে না বলেই এই বিরোধ সঙ্গত, স্বাভাবিক এবং নিরন্তর। অতএব অভিভাবকরা চিরকাল রেগে যাবেন এই ভেবে যে, যাদের বিন্দুমাত্র জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তারা এত অমান্য করার সাহস পায় কী করে! কীসের এত জেদ! অন্যদিকে তরুণদের মনে হয়, অভিভাবকরা যাই-ই করছেন তাই বড্ড গা-জোয়ারি। এবং তাঁদের মত-পথ চাপিয়ে দেওয়ার জোর-ই বা কেন? কেনই বা নতুনকে আপন ভাগ্য জয় করিবার অধিকার দেওয়া হবে না!
এই বিরোধের সূত্রেই এসেছে চিরকালের শোনা ওই কথাটা। শাসন যিনি করেন, সকলের মাঝে সোহাগ করাও তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। এই শাসন অবশ্যই ছোট ক্ষেত্রে, ছোট পরিসরের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে। তবে কথাটার মধ্যে যে একটা ভারসাম্যের ইঙ্গিত আছে, তা খেয়াল করার মতো। শাসন আর সোহাগ যদি পাল্লা দিয়ে চলে, তাহলে হয়তো অসুবিধার তেমন কিছু হয় না। কিন্তু যদি শাসনই প্রকট হয়ে ওঠে তবে সমস্তটাই বিগড়ে যায়। আবার কেবলই সোহাগ, শাসন যদি না-থাকে, তাহলেও ওই বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই সমূহ। অতি আদরে বাঁদর হয়, কে না জানে!
……………………………………………………..
শাসক-বিরোধীর এই চলতি রাজনীতির বাইরে একজন অভিভাবক সব সময়ই থেকে যান এই গণতন্ত্রে। আমরা কখনও তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি, কখনও না পেরে পথ হারাই। রাজনীতিই হয়তো সেই পথ ভুলিয়ে দেয়, বিভ্রান্ত করে। কিন্তু দেখা যায়, যদি এই সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, প্রশাসক আর জনতার মধ্যে এমন সেতুর দেখা মিলতে থাকে, তাহলে স্বার্থের রাজনীতি হালে পানি পায় না।
……………………………………………………..
শুধু পরিবারে নয়। সর্বত্রই একই জিনিস চোখে পড়ে। যেখানে অত্যধিক প্রশ্রয়, সেখানেই নৌকাডুবি। সোহাগকে দুর্বলতা ভেবে যাকে সোহাগ করা হচ্ছে সে যখন কেউকেটা হয়ে উঠতে চায়, তখন সোহাগকর্তার শিরে সংক্রান্তি। সময়ে ঘুম না ভাঙলে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের হাতে মরণ নিশ্চিত। তাই শাসনও হেলাফেলার জিনিস নয়। অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়ার অনুশীলন গোড়া থেকেই চলতে থাকে। নইলে একদিনে সবকিছু শুধরোয় না। এই যে আমাদের চারপাশটা, সে তো রত্ন কিছু নয় যে মন্ত্র পড়ে রাতারাতি শোধন করে নেওয়া যাবে। এই শোধনের গোড়ার কথাই হল, অন্যায়কে আটকে দেওয়া। তা একটা প্র্যাকটিস। সেই অন্যায় যেমন সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রের অন্যায় হতে পারে, তেমনই ব্যক্তির অন্যায় হতে পারে।
একেবারে ছোট করে দেখলে দেখা যাবে, একজন বাচ্চা যখন কোনও অনৈতিক কাজ করে, তখনই যদি তাকে শাসনে শুধরে দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো এই অন্যায় বা অনৈতিকের সিস্টেম, যা পরবর্তী কালে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, তা গোড়াতেই ধাক্কা খায়। যিনি শাসন করছেন তিনি নিঃসন্দেহে অভিভাবক। তবে, যাকে শাসন করছেন, তার ভালো কাজের তারিফ করা বা তাকে স্বীকৃতি দেওয়াও অভিভাবকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
এবার পারিবারিক মিঠেঝাল সম্পর্ক থেকে এই শাসন শব্দটিকে এবার রাজনীতিতেই এনে ফেলুন। কেউ আছেন শাসনের দায়িত্বে। কেউ আছেন বিরোধীর ভূমিকায়। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। বিরোধী বলে, শাসকের প্রায় সব কাজেই ভুল হচ্ছে। আর, শাসক বলে, প্রশাসন তো চালাতে হয় না, শুধু বাইরে থেকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা। বিরোধী কালের নিয়মে শাসক হয় একদিন, আবার উল্টোটাও। তখন তাদের পারস্পরিক স্বর বদলে যায়। রাজনীতির চলতি ধারা এভাবেই বয়ে চলে। তবে, এই বাইনারি পেরিয়ে আর একটা ভূমিকা থেকে যায়, তা এই অভিভাবকের। সে ভূমিকা মূলত শাসকেরই। শাসক-বিরোধীর চলতি বয়ান পেরিয়ে শাসক কখনও সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মানুষ যা চাইছেন, তা মিটিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না। সেখানে রাজনীতি তেমন প্রশ্রয় পায় না। অর্থাৎ শাসক-বিরোধীর এই চলতি রাজনীতির বাইরে একজন অভিভাবক সব সময়ই থেকে যান এই গণতন্ত্রে। আমরা কখনও তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি, কখনও না পেরে পথ হারাই। রাজনীতিই হয়তো সেই পথ ভুলিয়ে দেয়, বিভ্রান্ত করে। কিন্তু দেখা যায়, যদি এই সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, প্রশাসক আর জনতার মধ্যে এমন সেতুর দেখা মিলতে থাকে, তাহলে স্বার্থের রাজনীতি হালে পানি পায় না। অভিভাবকের এই ভূমিকা শাসকের মহত্তর গুণও বটে। যিনি জনতাকে সোহাগ করতে পারেন সবার মাঝে, শাসন করা তারই সাজে। নচেৎ নয়।
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………….
অতএব পরিবার হোক বা রাজনীতি, শাসন আর সোহাগ খুব দূরে-দূরে থাকে না। থাকে পিঠোপিঠি। শুনতে অক্সিমোরনের মতো লাগলেও, এটিই জীবনের ওপেন-সিক্রেট।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ৪. পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে
অশোক ঘোষ মনে করতেন, ট্রাম আন্দোলন কলকাতার হকারদের একটি রাজনৈতিক চেতনা জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কেরানি, হকার, আর উদ্বাস্তুদের লড়াই। আর ট্রাম-ডিপো মানেই হকার। এইসব দোকানেই আন্দোলনকারীদের আড্ডা বসত। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কথা আলোচনা হত। সকালে হয়তো কোনও এক চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে খবরের কাগজ পড়া হত।