Robbar

সচ্ছলতার বিনিময়ে দমবন্ধ করা এক স্বপ্নহীন, স্বাধীনতাহীন জীবন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 4, 2024 7:47 pm
  • Updated:October 16, 2024 5:51 pm  

সবুজ-গোলাপি, নীল ও হলুদ রঙের পরপর সব একরকম দেখতে বাড়ি, বাক্সের মতো। সেখানে যাঁরা থাকেন, তাঁরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, কেউ ডাক্তার, কেই আইনজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। এঁরা প্রত্যেকেই একরকম দেখতে। একরকমের পোশাক পরেন। এঁরা প্রত্যেকে গলফ খেলেন, ড্রাই মার্টিনি পান করেন, তাঁদের সন্তানেরা সুন্দর সুন্দর দেখতে, সবাই ভালো স্কুলে পড়াশোনা করে। তারা সামার ক্যাম্পে যায়, তারপর ইউনিভার্সিটিতে। তারপর ওরাও একরকম হয়ে যায়। তারপর আবার, আবার, আবার।

প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়

৭.

লিটল বক্সেস, মালভিনা রেনল্ডস, ১৯৬২, আমেরিকা

সমাজ বস্তুবাদী। সমাজের কিছু গতে বাঁধা মাপকাঠি আছে। সেই মাপকাঠি দিয়েই সমাজ নির্ধারণ করে কে সফল, কে নয়। আর আমাদের ঠেলে দেয় ইঁদুর দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে, আমাদের অধরা স্বপ্নগুলো পরের প্রজন্মের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে বাধ্য করে। পরের প্রজন্ম আবার সেই ইঁদুর দৌড় শুরু করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্বপ্ন মরে যায়।

কিন্তু আমরা ভাবি। আমরা স্বপ্ন দেখি। এই তো বাড়ি করার স্বপ্ন, বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন, স্বচ্ছল জীবনযাপনের স্বপ্ন। কিন্তু এগুলো কি স্বপ্ন, না প্রত্যাশা? এই স্বচ্ছলতার স্বপ্ন আসলে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই স্বপ্নগুলোই সমাজের তৈরি করে দেওয়া। আমরা তাই স্বপ্ন দেখতে জানি না, জানি না কীভাবে নিজের ডানা মেলতে হয়। সমাজের দেখানো স্বপ্নকেই আমরা ‘নিজেদের স্বপ্ন’ বলে ভাবি।

স্বপ্নের সঙ্গে পেশার সম্পর্ক হয় না– এটাই জানানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। তাই আমাদের অনেকেরই দিন কাটে ভালো-না-লাগার পেশায় যুক্ত থেকে। পেশার সঙ্গে ভালো লাগার দূরত্ব তৈরি হয়। বস্তুবাদের জাঁতাকলে আটকে আমাদের জীবন হয়ে যায় অনেকটা চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’-এর ভেড়ার পালের সেই মন্তাজের মতো।

Malvina Reynolds, a songwriter for these times
মালভিনা রেনল্ডস

একদিকে নিজের প্রতিভা, প্রত্যয়। অন্যদিকে গতে বাঁধা মাপকাঠি– এক চরম সংঘাত।

আজকের গান এই সংঘাতের বিরুদ্ধে। গানের নাম ‘লিটল বক্সেস’। গানের গীতিকার ও সুরকার মার্কিন মুলুকের মালভিনা রেনল্ডস। চট করে আমরা একটু মালভিনার জীবনটা যদি দেখি, আমাদের কাছেও খুব পরিষ্কার হয়ে যাবে, কোন জীবনবোধ থেকে এরকম একটা গান তিনি লিখলেন।

FROM THE VAULTS: Malvina Reynolds born 23 August 1900

মালভিনার জন্ম সোশ্যালিস্ট পরিবারে। যদিও ছোটবেলা থেকে বেহালা শিখেছেন, একটু-আধটু পিয়ানোও বাজিয়েছেন, সমাজের এই গতে বাঁধা স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে ব্যতিক্রমী হতে পারেননি। বার্কলে ইউনিভার্সিটির স্নাতকের ডক্টরেট হতেই জীবনের ৩৮টা বছর কেটে যায়। সংগীতের প্রশিক্ষণ থাকলেও গানবাজনাটা সেভাবে শুরু করতে করতে প্রায় ৫০ ছুঁইছুঁই। সেই সময়ে মালভিনার সঙ্গে লোকসংগীতের পরিচয় ঘটে পিট সিগার এবং অন্যান্য লোকসংগীতকারের মাধ্যমে। মালভিনা বলেছেন, লোকগান শুনেই তিনি তাঁর গানের, সুরের রাস্তা খুঁজে পান। প্রায় ৫০ বছর বয়সে উনি ফিরে যান বার্কলেতে। পড়াশোনা করেন মিউজিক থিওরি নিয়ে। শুরু করেন গান লেখা, সুর করা আর গিটার বাজানো।

Doomed to be unheard: Malvina Reynolds' music retells Cassandra myth at Shotgun Players | Datebook

৬২ বছর বয়সে উনি লিখলেন ‘লিটল বক্সেস’। পরিবারের সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে দেখলেন পাহাড়ের গায়ে সারি সারি ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। সব ক’টাই এক রকম দেখতে, স্বতন্ত্র কোনও ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র নেই বাড়িগুলোর। ঠিক যেন অনেকগুলো ছোট ছোট কাঠের বাক্স। ভাবনা এসে গেল এক কালজয়ী গানের, এই বাক্সগুলো যেন আমাদের সমাজের নিয়মের দাস হয়ে যাওয়া মানুষ। সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল। সবাই এক। সবাই ‘লিটল বক্সেস’।

Little boxes on the hillsideLittle boxes made of ticky tackyLittle boxes on the hillsideLittle boxes all the same
There’s a green one and a pink oneAnd a blue one and a yellow oneAnd they’re all made out of ticky tackyAnd they all look just the same
And the people in the housesAll went to the universityWhere they were put in boxesAnd they came out all the same
And there’s doctors and lawyersAnd business executivesAnd they’re all made out of ticky tackyAnd they all look just the same
And they all play on the golf courseAnd drink their martinis dryAnd they all have pretty childrenAnd the children go to school
And the children go to summer campAnd then to the universityWhere they are put in boxesAnd they come out all the same
And the boys go into businessAnd marry and raise a familyIn boxes made of ticky tackyAnd they all look just the same
There’s a pink one and a green oneAnd a blue one and a yellow oneAnd they’re all made out of ticky tackyAnd they all look just the same.
যে গ্রেট আমেরিকান ড্রিম-এর স্বপ্ন মার্কিন মুলুক থেকে দেশান্তরে পাড়ি দিয়েছিল, সেই স্বপ্নকেই আঘাত করলেন মালভিনা। একটা স্বপ্ন, যা সবাই দেখে– সেই স্বপ্নে আঘাত করা সহজ ছিল না সে সময়ে দাঁড়িয়ে। যে পুঁজিবাদী সময় এই স্বপ্ন নির্মাণ করছে, সেই সময়ে এই স্বপ্নকে অস্বীকার করা।
The Great American Dream, Still Deferred - The New York Times
সবুজ-গোলাপি, নীল ও হলুদ রঙের পরপর সব একরকম দেখতে বাড়ি, বাক্সের মতো। সেখানে যাঁরা থাকেন, তাঁরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, কেউ ডাক্তার, কেই আইনজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। এঁরা প্রত্যেকেই একরকম দেখতে। একরকমের পোশাক পরেন। এঁরা প্রত্যেকে গলফ খেলেন, ড্রাই মার্টিনি পান করেন, তাঁদের সন্তানেরা সুন্দর সুন্দর দেখতে, সবাই ভালো স্কুলে পড়াশোনা করে। তারা সামার ক্যাম্পে যায়, তারপর ইউনিভার্সিটিতে যায়। তারপর ওরাও একরকম হয়ে যায়। তারপর আবার, আবার, আবার।
File:Saul-Heller-Panhandle PICT0241 Malvina-Reynolds-singing-at ...

গানটি লেখার পরের বছরই পিট সিগার গানটি গেয়ে রিলিজ করেন। ১৯৬৩-’৬৪ সালে গানটি জনপ্রিয়তা পেল এবং হিট গানের লিস্টে অন্তর্ভুক্ত হল। এই গানটি তো তথাকথিত স্বচ্ছল এক জীবনযাপনের কথা বলে। কিন্তু স্বচ্ছলতার বিনিময়ে কী পাওয়া যায়? এক দমবন্ধ করা, স্বপ্নহীন, স্বাধীনতাহীন এক জীবন। যেখানে জীবনের স্পর্শ নেই।

পিট সিগার ও মালভিনা রেনল্ডস

এই গান ব্যঙ্গাত্মক। গানের সুরে নার্সারি রাইমের ছোঁয়া, যা এই ব্যঙ্গকে আরও তীব্র করে তোলে। উডি গাথরির অনেক গানেই এই নার্সারি রাইমের সুরে প্রতিবাদের কথা আমরা পাই। মালভিনাও সেই পথেই হেঁটেছেন। এই গানের কটাক্ষ, তির্যক উপমা আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, প্রশ্ন জাগায়, গতে বাঁধা নিয়ম আর বস্তুবাদের ঘেরাটোপ থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে নিজের শর্তে বাঁচার প্রেরণা জোগায়।

 

…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ৬। তিনটি মানুষ ও একটি কারাগার

পর্ব ৫। কাব্যিক অভিপ্রায় ছাপিয়ে যে গান রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় মিশে যায়
পর্ব ৪। যে সৈনিক কবর খোঁড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে
পর্ব ৩। যে প্রশ্ন শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়, উত্তর পাওয়া যায় না
পর্ব ২। আহা ফুল, কবরের ফুল, মাটিকে অমন ভালোবেসে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থেকো না
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন