নতুন চাকরিতে মেয়েরা যখন নানা রকম পরিকাঠামোগত অসুবিধা ও পুরুষদের বিরূপ মনোভাবের সম্মুখীন হন, তখন অফিসে গড়ে ওঠা সখ্যই হয়ে ওঠে তাঁদের নিজস্ব ও বিকল্প ‘পরিকাঠামো’। সমাজবিজ্ঞানী আব্দৌ মালিক সিমন বলেন পরিকাঠামোকে শুধুমাত্র বস্তুর দৃষ্টিকোণ দিয়ে বোঝা যায় না, মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কও পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। বাহ্যিক পরিকাঠামোর অভাবে প্রান্তিক মানুষের কাছে তাঁদের এই সখ্য অপরিহার্য। গীতিকা, কবিতাদের জীবনে ছিল প্রয়োজনীয় পরিষেবার অভাব, সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন অফিসারের অবজ্ঞা, বাড়ির কাজের চাপ, সমাজের বিরূপ মনোভাব। এর মধ্যে তাঁদের বন্ধু সহকর্মীরাই হয়ে উঠেছিলেন যথার্থ সহচরী– হাঁফ ছাড়ার আশ্রয়, সমস্যায় পরামর্শদাতা, বিপদের ভরসা।
দেশভাগের পর সদ্য চাকরিতে ঢোকা মেয়েদের জীবনে বাড়ি, পাড়া, স্কুল-কলেজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরেক পরিসর– কর্মক্ষেত্র। সংসারে অভাব মেটানো বা নিজের পরিচিতির খোঁজে বাড়ির বাইরে কাজ করা, মেয়েদের চাকরির উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তাদের সব সময়ে সদয় চোখে দেখেনি সমাজ। কাজের জায়গায়, যাতায়াতের পথে, নানা বাধা বিপত্তির সঙ্গে যুঝতে হয়েছিল এই মেয়েদের। তবে এই সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন প্রেম-ভালোবাসার আর বন্ধুত্ব।
জ্যোৎস্না সিনহার অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। খুব অল্প বয়সে বিধবা হন তিনি। তখন তাঁর ছেলে ছোট। স্বামীর অফিসেই কাজ পান তিনি। এখানে কাজ করতেন আর মাত্র চারজন মহিলা। তাঁদের আলাদা আলাদা বিভাগে কাজ হলেও দুপুরে তাঁরা খেতেন এক সঙ্গে। কিছুদিন পরে লুসি বলে একজন ভারতীয় চিনা মহিলা তাঁদের অফিসে চাকরি পান। জ্যোৎস্নার ছেলে তাপসেরআজও মনে আছে লুসি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন, মাঝেমাঝে কেক পাঠাতেন। বয়স, অসুস্থতার প্রভাবে অনেক স্মৃতি ম্লান হয়ে গিয়েছে জ্যোৎস্নার, কিন্তু বন্ধুদের কথা, বন্ধুত্বের স্মৃতি যে মনকে আজও আনন্দ দেয়, তা তাঁর হাসি দেখে বেশ বোঝা যায়। দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে, খাবারের সঙ্গে জীবনের সুখ-দুঃখের গল্পও ভাগ করে নিয়ে তিনি হয়ত কিছুটা স্বস্তি পেতেন। আর সেই বন্ধুত্ব ছাপিয়ে যেত ধর্ম, ভাষা বা বর্ণের সীমানা। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা অবতরণিকা গল্পের ভিত্তিতে বানানো সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ সিনেমায় (১৯৬৩) আমরা দেখি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এডিথ সিমনসের ভাঙা বাংলা আর আরতি মজুমদারের সীমিত ইংরাজির সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে গাঢ় বন্ধুত্বের ছবি। বাংলা সিনেমায় অফিসে পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্বের গল্প অনেক দেখেছি, মেয়ে-চাকুরেদের নিজেদের মধ্যে যে সখ্য, তা নিয়ে সিনেমা-সাহিত্য তুলনায় অনেক কম। অটোনিটের অফিসের এই চিত্রের অনুরণনই যেন আমরা পাই জ্যোৎস্না সিনহার গল্পেও।
মেয়েদের সখ্যকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিছক সময় নষ্ট হিসাবে দেখে, পরনিন্দা- পরচর্চার ক্ষেত্র মনে করে। কিন্তু দেশভাগে বিধ্বস্ত এই মেয়েরা সংসারের নানা টানাপোড়েন সামলে যখন ‘স্ত্রীভূমিকাবর্জিত’ কর্মক্ষেত্রে প্রথম ঢুকলেন, তখন তাঁদের নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বই হয়ে উঠল বিরাট ভরসার জায়গা। ১৯৬৪ সালে শুরু হয় এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে মেয়েদের নিয়োগ করা। এই এক ঝাঁক নতুন মেয়েদের মধ্যে একজন ছিলেন গীতিকা মিত্র। গীতিকার সহকর্মীদের মধ্যে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে অনেকের সঙ্গে তাঁর খুব বন্ধুত্ব হয়। অবসর জীবনেও সে বন্ধুত্ব থেকে যায়। যে সময় গীতিকা চাকরি করেন সেই সময় মেয়েদের ট্রান্সফার হত একই শহরের মধ্যে। এই সূত্রে দক্ষিণ কলকাতার নানা ব্রাঞ্চে বদলি হন তিনি। তাঁর কাছে শুনি–
আমাদের ফার্স্ট ব্যাচের যারা, আমরা যখন অফিসার পোস্টে উঠলাম, কেউ কেউ অন্য ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হলাম। এর (ট্রান্সফারের) পরেও আমাদের মধ্যে দারুণ যোগাযোগ ছিল। কেউ হয়ত একটা নতুন ব্রাঞ্চে গেল, কেউ জানাত ‘খুব সাবধান, অমুক ছেলেটা সুবিধের নয়’। ফোনে ফোনে যোগাযোগ হত, খবরদার তুই এটা সই করবি না, বিপদে পড়বি। প্রত্যেকে প্রত্যেককে খুব প্রটেক্ট করত… ‘‘এ রকম হলে তুই কিন্তু একদম মাথা নোয়াবি না।’’… আজও আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে আইন আসতে তখনও বেশ কিছু দশক দেরি। নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাই এই বন্ধুদের বাঁধন গীতিকার মতো সদ্য চাকরিরতাদের কাছে ছিল আবশ্যক। তবে শুধু গুরুগম্ভীর বিষয়ে চর্চানয়, হাসিঠাট্টা আনন্দও কম ছিল না।
গীতিকার দশ বছর পরে স্টেট ব্যাঙ্কে চাকরি পান বিজয়গড়ের বাসিন্দা মিনতি ঘোষ। অফিস স্ট্র্যান্ড রোডে। তখনও তাঁদের মহিলা খুব কম, এক একটা ফ্লোরে মাত্র দু’-একজন করে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়ে যান মিনতির খুব বন্ধু। সকালে সংসারের কাজ সেরে, ৮:৫২-র বাস ধরতেন তিনি। সারা দিন কাজের পর, বাড়ি ফিরে আবার রান্নাবান্না, বাড়ির কাজ। সারাটা দিন যেন শ্বাস ফেলার সময় নেই। তার মধ্যেও কোনও কোনও শনিবার, হাফবেলা অফিস করে সবাই মিলে চলে যেতেন ময়দানে, কোনও দিন বা সিনেমা দেখতে।
সাতের দশকের একদম শুরুতে এলআইসি-তে চাকরিতে ঢোকেন কবিতা চৌধুরী। ১১১ জনের বিভাগে ১৯ বছরের কবিতা ছিলেন প্রথম মহিলা কর্মী। অসময়ে বাবা মারা যাওয়ায় কমপেনসেটরি গ্রাউন্ডে চাকরি। শুধু তাঁর বিভাগ নয়, অন্য সব বিভাগেও একই অবস্থা! তাঁর কোনও এক পুরুষ সহকর্মী ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে মহিলারা এক একটি ফুলদানি।’ একমাত্র মেশিন বিভাগে ১৯৬০ থেকে মহিলা নিযুক্ত করা হত, ডেটা এন্ট্রির কাজ। সেই সময় ৪০ জন মহিলা কাজ করতেন এই বিভাগে। এখানেই ছিল মেয়েদের বাথরুম। এই বিভাগের দরজা সবসময় বন্ধ থাকত। পুরুষ-প্রধান অফিসে এই বিভাগ ছিল মেয়েদের একান্ত নিজেদের জায়গা– কাজ শেখার, গল্প করার, একটু জিরোনোর, এমনকী, রাজনৈতিক আলোচনারও। কবিতা বলেন,
কীরকম ছিল জানত? এই গল্প করছি, দুপুরবেলা লাঞ্চের বিরতিতে তাস খেলছি, হইহুল্লোড়, তার মধ্যে মিটিং-মিছিল সব আছে।
১৯৭২ এ গ্লোরিয়া স্টাইন্যাম ‘সিস্টারহুড’ প্রবন্ধে বা ১৯৮৪ সালে বেল হুকস ‘সিস্টারহুড: পোলিটিক্যাল সলিডারিটি অ্যামং ইউমেন”-এ মেয়েদের জীবনে নারী-সংহতির গুরুত্বের কথা বলেছেন। একই কথা আমরা পাই অশোকা গুপ্তের লেখাতেও। এই সিস্টারহুডের ধারণা নারীবাদী আন্দোলনের একরকম গোড়ার কথা। শুধু রাজনীতিতেই নয়, আমাদের কাজে আমরা দেখেছি সাধারণ ভাবে দৈনন্দিন জীবনেও মেয়েরা বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছেন । ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০-এর যে সময়টা নিয়ে আমরা কাজ করেছি, সেই সময়ের সাহিত্য সিনেমা ও স্মৃতিকথায় খুঁজলে পাওয়া যায় মেয়েদের বন্ধুত্বের কিছু গল্প। একদিকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আশা ও বাসা’ গল্পে স্কুলের বন্ধু রাখী ও সোমার আপাত সহজ সম্পর্কের মধ্যে পাওয়া যায় হীনম্মন্যতা ও প্রতারণার পরিচয়। অন্যদিকে ১৯৫৮ এ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা দূরভাষিণী-তে আমরা দেখি কমলার কঠিন অসুখে তার সেবা যত্ন করে, আর্থিক সাহায্য করে বীণা, তার বন্ধু ও সহকর্মী।
নতুন চাকরিতে মেয়েরা যখন নানা রকম পরিকাঠামোগত অসুবিধা ও পুরুষদের বিরূপ মনোভাবের সম্মুখীন হন, তখন অফিসে গড়ে ওঠা সখ্যই হয়ে ওঠে তাঁদের নিজস্ব ও বিকল্প ‘পরিকাঠামো’। সমাজবিজ্ঞানী আব্দৌ মালিক সিমন বলেন পরিকাঠামোকে শুধুমাত্র বস্তুর দৃষ্টিকোণ দিয়ে বোঝা যায় না, মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কও পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। বাহ্যিক পরিকাঠামোর অভাবে প্রান্তিক মানুষের কাছে তাঁদের এই সখ্য অপরিহার্য। গীতিকা, কবিতাদের জীবনে ছিল প্রয়োজনীয় পরিষেবার অভাব, সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন অফিসারের অবজ্ঞা, বাড়ির কাজের চাপ, সমাজের বিরূপ মনোভাব। এর মধ্যে তাঁদের বন্ধু সহকর্মীরাই হয়ে উঠেছিলেন যথার্থ সহচরী– হাঁফ ছাড়ার আশ্রয়, সমস্যায় পরামর্শদাতা, বিপদের ভরসা। আমরা প্রায়ই শুনি মেয়েরাই নাকি মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই ধরনের একমাত্রিক ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দেয় প্রথম যুগের চাকুরিরতাদের অফিস পরিসরে সংহতি ও সখ্যের নানা আখ্যান।
সূত্র:
১. Ashoka Gupta, In the Path of Service: Memories of a Changing Century, translated from the Bengali by Sipra Bhattacharya and Ranjana Dasgupta. Kolkata: Stree, 2008
২. Krishna, Bose. Lost Addresses. Calcutta: Niyogi Books, 2015
৩. Gloria Steinam, ‘Sisterhood’, MS Magazine. 1972
৪. Bell hooks, “Sisterhood: Political Solidarity Between Women”, Feminist Review 23. 1986
… পড়ুন চৌকাঠ পেরিয়ে কলামের অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৭: পুরুষ সহকর্মীদের ‘বন্ধু’ ভাবতে অস্বস্তি হত পাঁচ ও ছয়ের দশকের চাকুরিরতাদের
পর্ব ১৬: ট্রামের স্বস্তি না বাসের গতি, মেয়েদের কোন যান ছিল পছন্দসই?
পর্ব ১৫: অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শই শুধু নয়, চৌকাঠ পেরনো মেয়েরা পেয়েছিল বন্ধুত্বের আশাতীত নৈকট্যও
পর্ব ১৪: লীলা মজুমদারও লেডিজ সিট তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন!
পর্ব ১৩: অল্পবয়সি উদ্বাস্তু মহিলারা দেহব্যবসায় নেমে কলোনির নাম ডোবাচ্ছে, বলতেন উদ্বাস্তু যুবকরা
পর্ব ১২: মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবির মিঠুর মতো অনেকে উদ্বাস্তু মেয়েই চাকরি পেয়েছিল দুধের ডিপোতে
পর্ব ১১: প্রথম মহিলা ব্যাঙ্ককর্মীর চাকরির শতবর্ষে ব্যাঙ্কের শ্রমবিভাজন কি বদলে গিয়েছে?
পর্ব ১০: সেলসগার্লের চাকরিতে মেয়েরা কীভাবে সাজবে, কতটা সাজবে, তা বহু ক্ষেত্রেই ঠিক করত মালিকপক্ষ
পর্ব ৯: স্বল্পখ্যাত কিংবা পারিবারিক পত্রিকা ছাড়া মহিলা সাংবাদিকরা ব্রাত্য ছিলেন দীর্ঘকাল
পর্ব ৮: অভিভাবকহীন উদ্বাস্তু মেয়েদের ‘চিরকালীন বোঝা’র তকমা দিয়েছিল সরকার
পর্ব ৭: মেয়েদের স্কুলের চাকরি প্রতিযোগিতা বেড়েছিল উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর
পর্ব ৬: স্বাধীনতার পর মহিলা পুলিশকে কেরানি হিসাবেই দেখা হত, সেই পরিস্থিতি কি আজ বদলেছে?
পর্ব ৫: প্রেম-বিবাহের গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের লেডি ডাক্তাররা স্বাধীনতার নিজস্ব ছন্দ পেয়েছিলেন
পর্ব ৪ : নার্সের ছদ্মবেশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যৌন হেনস্তার কবলে পড়তে হয়েছিল
পর্ব ৩ : উদ্বাস্তু মেয়েদের রোজগারের সুযোগ মিলেছিল টাইপ-শর্টহ্যান্ডের কাজে
পর্ব ২ : পিতৃতন্ত্রের কাঠামোয় কিছু ফাটল নিশ্চয়ই ধরিয়েছিলেন সে যুগের মহিলা টেলিফোন অপারেটররা
পর্ব ১ : দেশভাগের পর ‘চঞ্চল চক্ষুময়’ অফিসে চাকুরিরত মেয়েরা কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
কীভাবে যেন অলৌকিক যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায় প্রতিটি ড্রিবলিংয়ে। রয়ের বয়স বাড়ে না। ৪০ মরশুম খেলার পরেও বয়স দাঁড়িয়ে থাকে মধ্য তিরিশে। গোলের ঠিকানা লেখা অ্যাসিস্ট মুছে দেয় মানচিত্র। দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে এক বেপরোয়া জাদুকর ঢুকে পড়ে বাঙালি পাঠকের ফুটবল-স্বপ্নে।