আইসল্যান্ডের এক অশীতিপর বৃদ্ধার ছবি। যিনি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নিঃশেষ করে চলে এসেছেন বিভুঁইয়ে, হাজার-হাজার কিলোমিটার দূরে, দেশের টানে। বিশ্বমঞ্চে তাঁর পুঁচকে দেশ ছুটছে যে, ওই দ্যাখো কেমন উল্টে দিচ্ছে পাশা, ইউরোর রাউন্ড অফ সিক্সটিনে আছড়ে ফেলছে ইংল্যান্ড নামের পরাশক্তিকে।
ছবিটা ফোনে কোথাও না কোথাও আছে ঠিক। পুরনো ছবিদের অচেনা জটলায়। সবুজ-সাদা ডোরাকাটা টি-শার্ট পরা বছর তিরিশের এক পর্তুগিজ যুবকের ছবি। নিজের দেশ নিয়ে যে বিরক্ত, দেশের রাজনীতি নিয়ে অতিষ্ঠ। দেশের আর পাঁচটা খবরাখবরে প্রায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে যে, অনন্ত বিবমিষা দেখায়। দু’-মুঠো শান্তির তাড়নায় উদভ্রান্ত ছুটে বেড়ায় সারা দিন, আর সব শেষে মেদেইরা-জাত এক গ্রহান্তরের ফুটবলারের পদতলে ফিরে পায় নিজের দেশ!
ছবিটা ফোনে কোথাও নেই। তোলাই হয়নি কখনও। আইসল্যান্ডের এক অশীতিপর বৃদ্ধার ছবি। যিনি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের শেষ ভরসাটুকু নিঃশেষ করে চলে এসেছেন বিভুঁইয়ে, হাজার-হাজার কিলোমিটার দূরে, দেশের টানে। বিশ্বমঞ্চে তাঁর পুঁচকে দেশ ছুটছে যে, ওই দ্যাখো কেমন উল্টে দিচ্ছে পাশা, ইউরোর রাউন্ড অফ সিক্সটিনে আছড়ে ফেলছে ইংল্যান্ড নামের পরাশক্তিকে। কাঁপা-কাঁপা হাত ‘ভাইকিং ক্ল্যাপ’-এর বোল তুলবে না এরপর? কান্নার কাচ-গুঁড়ো দোল খেয়ে মিশে যাবে না বাতাসে, অহঙ্কারের খরবায়ু নিয়ে? ভদ্রমহিলা কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে হাসছিলেন। পাগলপারা হলে মানুষ করে যেমন!
দুই দৃশ্যই বছর সাত আগের, ফ্রান্স ইউরো (২০১৬) কভার করতে গিয়ে প্যারিসে দেখা। নাম একটা মনে আছে, একটা নেই। পর্তুগিজ যুবকের নাম ছিল আন্দ্রে গোমস। ভারতে ক্রিকেট সাংবাদিকতা করার বিপত্তি হল, প্রথম দিন থেকে খেলাটার গুণকীর্তন এমনই অষ্টপ্রহর চলবে যে, কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। এই পৃথিবীতে যে আরও পাঁচটা খেলা আছে, রূপ-মোহের মাদকতায় তারাও যে কিছু কম নয়, তারা যে ক্রিকেটের মতো দশ-বারোটা দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকে না, খেয়ালই পড়বে না। পাঁচের ঘরের নামতার মতো প্রতিনিয়ত শেখানো হবে, এই জগতে জীবনমুখী খেলা একটাই– ক্রিকেট! জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে যার একমাত্র সাযুজ্য আছে। তাকে জীবনসঙ্গী করতে পারলে, এগোবে তুমি। নইলে ফুটবল-হকির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির রেলকামরা অপেক্ষা করছে হরিমটর-সহ, উঠে পড়ো! কার্ডাস পড়লে তো আরও গেল। ক্রিকেট মরশুমের মাধুর্য ব্যাখ্যায় বিখ্যাত ক্রিকেট-লিখিয়ে একবার লিখেছিলেন: ‘দ্য অ্যারোগ্যান্স অব ফুটবল’স অ্যাডভেন্ট, দ্য সাডেন অ্যাকটিভিটি অ্যান্ড কনকোয়েস্ট, ইট ইজ অল শিওরলি আ লিটল ব্রেজেন, ইভন ভালগার– রিমাইন্ডিং আস অফ দ্য পার্সন হু পুটস অন অল হার জুয়েলারি অ্যাট ওয়ান্স। ক্রিকেট কামস ইনটু হার ওন স্লোলি, অ্যাজ দো বাই আ পেশেন্ট, অ্যাফেকশনেট উয়িইং অফ দ্য ইয়ার্স প্লে টাইম। দ্য গেম মে অলমোস্ট বি সেড টু শো ইটসেলফ উইথ আ ব্লাশ ইন দ্য আর্লি মে ডে’জ।’ শব্দ প্রতি তরজমার পাঁচালিতে না ঢুকে যার সহজবোধ্য সারাংশ বলে, ফুটবল আদতে টম ক্রুজের অ্যাকশন ফিলম আর ক্রিকেট মরশুম ডি’ক্যাপ্রিও-র রোম্যান্টসিজম। বুঝলে হে, নিটোল প্রেমের সঙ্গে ঘর করতে গেলে ক্রিকেট বাছো!
তাই কি? তা হলে কী ব্যাখ্যা হয় লেখার মুখবন্ধে ব্যবহৃত দুই চরিত্রের আবেগ-ফল্গুধারার? তাঁরা তো কেউ সেদিন ক্রিকেট মাঠে যাননি! ছবি-টবি তোলা শেষে আন্দ্রে গোমসের শেষের কথাটা কানে আজও বাজে, ‘আমাদের দেশে চাকরি নেই, জীবন নেই, মর্যাদা নেই। আমাদের শুধু একটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আছে!’ চকিত মনে পড়ে যায়, বিজাতীয় ভাষায় সেই বৃদ্ধার অশেষ আশীষ, অচেনা এক ভিনদেশির প্রতি, তিনি সেদিন যা বর্ষণ করেছিলেন সস্নেহ চুম্বন সমেত, তাঁর টিমের হয়ে গলা ফাটানোর প্রতিদানে। কী ব্যাখ্যা হয়, সেই ইউরোতেই দুই পদ্মাপার যুবকের সঙ্গে ফ্যান-জোন সাক্ষাতের, যাঁরা ভিটেমাটি ছেড়ে প্যারিসে পড়ে রয়েছেন পাচকের চাকরি আর উদ্বাস্তু পরিচয় নিয়ে, অথচ দিমিত্রি পায়েতের গোল ঘিরে রাক্ষুসে উল্লম্ফনে যাঁদের এতটুকু অসুবিধে হচ্ছে না! কী ব্যাখ্যা হয়, গত জুনেই বিশ্ব টেস্ট ফাইনাল কভার করার ফাঁকে ওয়েম্বলিতে খুঁজে পাওয়া সেই শীর্ণকায় ‘রেড ডেভিলস’ দর্শকের, কর্কট রোগের দংশন ভুলে যিনি ছুটে এসেছেন মাঠে, যাওয়ার আগে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের শেষ বার রাঙিয়ে দেওয়া দেখতে, এফএ কাপ ফাইনালে? এই প্রেম জান্তব হলে, জান্তব। এই প্রেম বিদ্রোহী হলে, বিদ্রোহী। সব প্রেমেই যে ঘাসের উপর প্রেমিকার আঙুল ধরে বসে থাকতে হবে, কে বলেছে? সব ভুলে কখনও কখনও ঠোঁটের উষ্ণতায় ডুবে তো যাওয়াই যায় (২০১৬ ইউরো ফাইনাল পর্তুগাল জেতার পর সেটাও দেখা), ফুটবলের উষ্ণতাকে জড়িয়ে। সর্বসমক্ষে। পারিপার্শ্বিক ভুলে। বেপরোয়া জঙ্গির মতো।
কী, এখনও জীবন খুঁজছেন? এত কিছুর পরও? এ জীবনেও সাধ না মিটলে মৃত্যুই ভাল!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved