টমাটর মুন্ডা বলে– ওরা সব ‘আনপঢ়’ লোক। কিছু জানে না। মানুষকে ‘উচা নিচা’ ভাবতে নেই। ওই যে ‘গাঁধী ভগোয়ান’। উনি কী শিক্ষা দিয়েছিলেন? বলেননি যে সব মানুষ সমান? বলেননি যে ‘সব কো সুমতি দে ভগোয়ান’? ওই যে গাঁধী ভগোয়ান। উনি হলেন ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’।
আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ক্যা বোলা? ফির বোলো ভাই…।’
ও বলে, ‘গাঁধী ভগোয়ান হ্যায় না– উন লোগ বিরসা ভগোয়ান কা পহেলা অবতার হ্যায়।’
১২.
একজন রিকশাওয়ালার কথা বলা হয়েছিল, যার পোশাকের রঙ সাদা, যে বলেছিল দারুর দোকানে নিয়ে যাবে না। তার রিকশায় সেদিন উঠিনি। পরে রাঁচির রাস্তায়, ওরকম রিকশাওলা আরও দেখেছি। তেমনই একজন রিকশাওয়ালার কথা বলি, নাম বলেছিল টমাটোর মুন্ডা! মুন্ডাদের মধ্যে নিজস্ব ভাষার নাম থাকে। যেমন– কারিয়া, সুকুর, বিরসা, বাহা, লগুন। আবার হিন্দু প্রভাবিত নাম– যেমন দয়াময়, রামচন্দ্র কিষান ইত্যাদি দেখেছি। পুলিশ মুন্ডা দেখেছি, সাহেব মুন্ডা, পহেলওয়ান মুন্ডাও পেয়েছি। কিন্তু এর আগে টমাটোর নামে কোনও মুন্ডার নাম পাইনি!
রাঁচি রেলস্টেশন থেকে রেডিও স্টেশন যাব, ওরকম সাদা পোশাকের রিকশাওলা। জিজ্ঞাসা করি, আপনি বুঝি বিরসাইত? লোকটি ‘জী, হাঁ’ বলে। জিজ্ঞাসা করি চা খাবে কি না, লোকটা বলে– ‘চা পিতে হ্যায়, লেকিন দিন মে তিন সে চারবার। ব্যস। যাদা নেহি।’
কাছেই একটা চৌমাথা ছিল। ওখানে একটা গান্ধীমূর্তি। একটা চাতাল মতো আছে ওখানে, একটা চায়ের দোকান, তদুপরি একটা বয়স্ক নিমগাছ ঝিরিঝিরি ছায়া দিচ্ছে। ওখানে বসলাম। লোকটার নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করলাম। জানলাম, ওর নাম টমাটর। ওর দেশ হিরনি জলপ্রপাতের কাছে। ওর বাবা রাঁচি শহরে এসেছিল যখন, ও তখন সাত বছরের। ওর বাবা রিকশা চালাত। এখন টমাটোর রিকশা চালায়। ওর বাবা-মারা গেছে। টমাটর বিয়ে করেছে, ওর ছেলে আছে, ১৪ বছর বয়স, মেয়ে ১০। দু’জনই ইস্কুলে পড়ে। স্টেশনের কাছে একটা ঝোপড়-পট্টিতে ওরা থাকে। বলল, ছেলেমেয়ে দু’জনকেই পড়াবে। ‘অনেক কিলাসতক্ পঢ়াই’ করাবে। ‘বারা, চৌদ্দা, পন্দেরা কিলাসতক্।’
বিরসা ‘ভগোয়ান’ হতে পেরেছিলেন কেন? কারণ তার অনেক ‘পঢ়াই’ ছিল। মিশনারির ‘পঢ়াই’ ছিল, সাধুবাবাদের ‘পঢ়াই’ ছিল, গাবুঢ়াদের ‘পঢ়াই’ ছিল। ও বলছিল– এক একটা বই মানে এক একটা চোখ। ভগবানদের অনেক চোখ থাকে, অনেক মাথা থাকে। অনেক হাত থাকে। আর ভালো ভালো ‘কিতাব’ হল মানুষের আসল সম্পদ। ‘রুপিয়া পইসা’ খরচ হয়ে যায়। ভালো ভালো খাবার– আপেল, আঙুর, গোস্ত, মছলি, রোটি-পরঠা সব ‘টাট্টি’ হয়ে মাঠে পড়ে থাকে। জরির পোশাক ছিঁড়ে যায়, ‘লেকিন কিতাব’ থেকে যা-যা ‘পঢ়াই’ হয়েছে, সব নিজের ভিতরে থেকে যায়। ও বিশেষ লেখাপড়া করেনি, কিন্তু ওর ছেলেমেয়েরা পড়ে। ওরা যখন পড়ে, ও শোনে। কত কী জানতে পারে। নদী কী করে ‘পয়দা’ হয়, ‘পথ্থর’ কী করে বালি হয়, কী করে ভারত স্বাধীন হয়েছে। বিরসা মহারাজার কথাও ওদের ‘কিতাব’-এ আছে।
চা খেতে খেতে বলি– তোমরা তো বিরসাইত, বিরসাইতরা নাকি অন্যের হাতে জল খায় না, নিজেদের উঁচু মানুষ ভাবে, তুমি তো বেশ খেয়ে নিচ্ছ…।
টমাটর মুন্ডা বলে– ওরা সব ‘আনপঢ়’ লোক। কিছু জানে না। মানুষকে ‘উচা নিচা’ ভাবতে নেই। ওই যে ‘গাঁধী ভগোয়ান’। উনি কী শিক্ষা দিয়েছিলেন? বলেননি যে সব মানুষ সমান? বলেননি যে ‘সব কো সুমতি দে ভগোয়ান’? ওই যে গাঁধী ভগোয়ান। উনি হলেন ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’।
মানে? কী বলতে চায় টমেটো মুন্ডা?
আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ক্যা বোলা? ফির বোলো ভাই…।’
ও বলে, ‘গাঁধী ভগোয়ান হ্যায় না– উন লোগ বিরসা ভগোয়ান কা পহেলা অবতার হ্যায়।’
আমি বলি, কী সব উল্টোপালটা বলছ! গান্ধীজির জন্ম হয়েছিল ১৮৬৯ সালের দোসরা অক্টোবর। আর বিরসা মুন্ডার জন্ম হয়েছিল ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর। মানে দাঁড়াচ্ছে, বিরসা যখন জন্ম নিলেন, গান্ধীজির তখন ছ’বছর বয়স। কী করে অবতার হতে পারে? মৃত্যুর পর তো আবার অবতার হয়ে আসার কথা।
টমাটর মুন্ডা বলল– ‘জী। ঠিক বাত। অব বোলো বিরসা ভগোয়ান কো মওত কব হুয়া?’
আমার জানাই ছিল। বললাম, ১৯০০ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ পুলিশ বিরসাকে গ্রেফতার করে, জেলে ভরে রাখে বিচারাধীন রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে, ৯ জুন জেলেই মৃত্যু হয় বিরসার।
টমাটোর মুণ্ডা বলে, ‘ঠিক বাত।’
– ১৯০০ সালে বিরসা মারা যান। তখন গান্ধীজি কোথায়? তখন তো উনি একজন উকিল। তখন ওঁর নাম মিস্টার এম.কে গান্ধী।
– তখন কি উনি ‘গান্ধীজি’ হয়েছিলেন, ‘মহাত্মা’ হয়েছিলেন? গান্ধী ভগোয়ান হয়েছিলেন? কংগ্রেসে ঢুকলেন কবে? ১৯২১ সালে তো। তবে? আমি কোথায় ভুল বললাম? বিরসা ভগোয়ানই তো গান্ধীর উপর ভর করলেন। মহাত্মা গান্ধী হলেন। লেকিন গাঁধী ভগোয়ান যে আজাদি চেয়েছিলেন সেটা তো হল না। বিরসা তাই আবার জনম নিলেন।
তিনি কে? আমি বিস্ময়ে প্রশ্ন করি।
টমাটর মুন্ডা বলেন, ওর নাম হলদি মুর্মু। হলদি বললে কেউ চিনবে না বিছা মুর্মু বললে এখনও অনেকে চিনবে। ও আসলি আজাদির জন্য লঢ়াই করেছিল, পরেশনাথ পাহাড় থেকে। পালামৌ জুড়ে, বেতলা চিনচিনি বিরাট এলাকায়। ফৌজ বানিয়ে ছিল। দু’হাজার সৈন্য ছিল। লেকিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেল লোধাশুলির কাছে। বলেছিল– আদিবাসীরা আর নিচা হয়ে থাকবে না। ক্ষেতি হবে, জমি হবে। এই লোহাভরা পাহাড় আর শাল সেগুন ভরা জঙ্গলের আসলি মালিক হবে। কিন্তু বিরসা ভগোয়ান বলে গেছে উলগুলান থামবে না। উলগুলানের শেষ নাই। মানুষের মধ্যে আবার জনম নেবেন বিরসা ভগোয়ান। তিসরা জনমে হবে আসলি উলগুলান। তিসরা অবতার মুন্ডাদের মধ্যেই আসবেন।
সেদিন এই পর্যন্ত কথা হয়েছিল। এরপরও রাঁচি গিয়েছি, ওর খোঁজ করেছি, কিন্তু দেখা হয়নি। বেশ কিছুদিন পরে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আবার। ও তখন দাড়ি রেখেছে। ও অন্যরকম হয়ে গেছে। চা খাওয়াতে চাইলাম, চা খেল না। বলল এখন শুদ্ধ জীবন পালন করছে। ‘মাছ মাস্’ কিছু খায় না। বিরসা ভগোয়ান স্বপন দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওর ঘরেই তিস্রা জনম নেবেন। ওর স্ত্রী এখন গর্ভবতী। বিরসা ভগোয়ান আসছেন ওরই ঘরে, ওর ঘর থেকেই শুরু হবে অন্তিম উলগুলান। এরপর আসবে আসলি আজাদি।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী