‘যোগাযোগ’ উপন্যাস যখন লিখছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই ১৯২৯-এর আশেপাশে বিশ শতকের আধুনিকতার নানা চিহ্ন নিয়ে কলকাতা প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। বিপ্রদাস বলেছে, কলকাতাকে ‘হৃদয় দিয়ে ঘিরে নিতে পারি নি রে বোন, পারি নে।’ বিপ্রদাস পারেনি, রবীন্দ্রনাথও পারেননি বিশ শতকের কলকাতাকে মন দিয়ে ঘিরে নিতে। তবে কেউ কেউ পারতেন। যেমন পেরেছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
কলকাতাকে রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন না। ভালো যে বাসতেন না তার নমুনা ইতি-উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ‘যোগাযোগ’ নাটকে বিপ্রদাস আর কুমুদিনীর কলকাতা বিষয়ক সংলাপ মনে পড়বে। বিপ্রদাস বোন কুমুকে বলেছে, ‘এই কলকাতাটা কোন্ দৈত্য-ইস্কুলের ক্লাসে ময়লা আকাশের বোর্ডের উপর জিয়োমেট্রির খোঁচা-ওয়ালা আঁক-কাটা প্রব্লেম।’
‘যোগাযোগ’ উপন্যাস যখন লিখছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই ১৯২৯-এর আশেপাশে বিশ শতকের আধুনিকতার নানা চিহ্ন নিয়ে কলকাতা প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। বিপ্রদাস বলেছে, কলকাতাকে ‘হৃদয় দিয়ে ঘিরে নিতে পারি নি রে বোন, পারি নে।’ বিপ্রদাস পারেনি, রবীন্দ্রনাথও পারেননি বিশ শতকের কলকাতাকে মন দিয়ে ঘিরে নিতে। তবে কেউ কেউ পারতেন। যেমন পেরেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ঢাকা শহর থেকে চলে এলেন কলকাতায়। সে কলকাতার প্রেমে পড়লেন তিনি– শুধু প্রেমে পড়লেন তাই নয়, বোদলেয়রের কবিতার অনুবাদক বুদ্ধদেব বসু অভিযোগ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তেমন করে কলকাতাকে কোনওদিনই ভালোবাসতে পারেননি। এ কথা মিথ্যে নয়, তবে সত্যও নয় সমগ্রত। আধুনিক বিশ শতকের কলকাতাকে রবীন্দ্রনাথ অপছন্দ করলেও বয়স যত এগোচ্ছিল, তত তাঁর মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ‘আরেকটা কলকাতা’। স্মৃতির পথে পদচারণা করতে করতে সে কলকাতাকে একরকম করে মন দিয়ে ঘিরে ফেলছিলেন তিনি।
তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে কলকাতার চিত্রময় উপস্থিতি না থাকলেও ‘ছেলেবেলা’-র মধ্যে ছিল তা। জীবনের একেবারে শেষবেলায় ১৯৪০-এ প্রকাশিত হল সেই স্মৃতিচিত্র। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে কথা-প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘সংস্কৃত ঘেঁষা সাধুভাষা ছেড়ে সোজা বাংলায় ভরিয়ে দিয়েছি বইখানিকে… প্রাকৃতের রসে মন টেনেছে আজ শেষ বেলায়।’ এই প্রাকৃতের টানে যে কলকাতার বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি, সেই কলকাতা বিশ শতকের তরুণ কবিদের প্রেমের দর্পণে ধরা-পড়া জটিল আধুনিক নগরী নয়। লিখেছিলেন, ‘আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্ছড়্ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথ কি এভাবেই তাঁর মনে জাগিয়ে তুললেন না আরেকটা কলকাতা? ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থখানি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তরুণ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। তরুণ কবিকে উৎসর্গ করা বইতে উঠে এল সেকালের কলকাতার ভৌগোলিক বিবরণ। ছেলেবেলায় স্কুল-পালানে রবির প্রিয় ছিল একখানি অনভিজাত বাগান। সে বাগানে কোকিল, দোয়েল, টিয়া আসত না। আসত কেবল কাক আর চড়ুই। দশটা বেলার রোদ সেই কাক আর চড়ুইয়ের ডাকের সঙ্গে মিশে নারিকেল ডালে দোলা খেত উদাস হাওয়ার তালে তালে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিশ শতকে কলকাতার চেহারা গিয়েছিল বদলে। সে শহরের পথে নেমেছিল আধুনিকারা। উনিশ শতকের মতো ‘পার্বণের দিনে গিন্নিকে বন্ধ পালকি-সুদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে আনা’ হত না। রবীন্দ্রনাথ সেকেলে কলকাতার এই নারীবন্দীকরণ পছন্দ করতেন না। তাঁর কাব্যে বিশ শতকের কলকাতার স্বাধীনা-মেয়েদের চকিত উপস্থিতি। ‘ছুটির আয়োজন’ কবিতার কথা মনে নেই?
‘ভবানীপুরের তেতালা বাড়িতে
আলাপ চলছে সরু মোটা গলায় –
এবার আবুপাহাড় না মাদুরা
না ড্যাল্হৌসি কিম্বা পুরী
না সেই চিরকেলে চেনা লোকের দার্জিলিঙ।’
এই সরু গলাটিকে অবশ্য সবাই গৃহে সসম্মানে ঠাঁই দিতে পারে না। নিজের সে অক্ষমতা ঢাকা দেওয়ার জন্য শহর কলকাতার মধ্যে একান্ত উদাস মনখারাপের সন্ধে যাপন করে। সদাগরি আপিসের পঁচিশ টাকা বেতনের কনিষ্ঠ কেরানি সন্ধেটা শেয়ালদা ইস্টিশনে কাটিয়ে দেয়। আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে। ধলেশ্বরী নদীর তীরে তার পিসিদের গ্রাম। পিসির দেওরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের ঠিকঠাক। তবু সেই ধলেশ্বরী নদীলাগা মেয়েটিকে শহর কলকাতায় নিয়ে আসার সাহস দেখাতে মন চায়নি। কলকাতায় বসে নিজের মনের ভেতরে আলো-হাওয়ার মতো বাঁচিয়ে রাখে সেই পাত্রীকে।
‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া –
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।’
মনে মনে ছেলেটি ভাবে, কলকাতার এই অভাবলগ্ন ভাড়া-বাড়িতে থাকতে হল না বলে মেয়েটি রক্ষা পেল।
রবীন্দ্রনাথের বিশ শতকের লেখায় এই যে কলকাতার নানা কথা তা কি অন্য কিছু বলছে? আধুনিক নগরের অপ্রাকৃতিক ভিড় কবিকে পীড়িত করে এ-কথা সত্য, তাই বলে কলকাতার মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষের মনের আকাশ ও অবকাশকে তো তিনি অস্বীকার করতে চান না। সেই অবকাশের এক রূপ ‘ছুটির আয়োজন’-এ ধরা পড়েছিল। পুজোয় কোথায় যাবে? সেই পরিকল্পনায় বেজে উঠেছিল অবকাশময়ীর রিন-রিনে গলা। ভবানীপুরের তেতলায় যা সম্ভব কিনু গোয়ালার গলিতে, পথের ধারের ঘরের বাসিন্দার জীবনে তা সম্ভব নয় বলে ধলেশ্বরীবাসিনীকে মনের নিত্য জগতে রেখে দিল ‘বাঁশি’ কবিতার মানুষটি। তার শরীর রইল কলকাতায়, মন রইল নদীতীরে।
রবীন্দ্রনাথ কি এভাবেই তাঁর মনে জাগিয়ে তুললেন না আরেকটা কলকাতা? ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থখানি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তরুণ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। তরুণ কবিকে উৎসর্গ করা বইতে উঠে এল সেকালের কলকাতার ভৌগোলিক বিবরণ। ছেলেবেলায় স্কুল-পালানে রবির প্রিয় ছিল একখানি অনভিজাত বাগান। সে বাগানে কোকিল, দোয়েল, টিয়া আসত না। আসত কেবল কাক আর চড়ুই। দশটা বেলার রোদ সেই কাক আর চড়ুইয়ের ডাকের সঙ্গে মিশে নারিকেল ডালে দোলা খেত উদাস হাওয়ার তালে তালে। এই যে বিশ শতকের নগর কলকাতায় বসে সেকালের কলকাতাকে মনের অবকাশে স্মৃতিপথে ছবির মতো দেখছেন পরিণত রবীন্দ্রনাথ, এও কি কলকাতার প্রতি, আরেক রকম কলকাতার প্রতি ভালোবাসা নয়!
‘এ রিক্ত বাগানটিরে দিয়েছিল বিশেষ কী দাম।
দেখিতাম, আবছায়া ভাবনায় ভালোবাসিতাম।’
কলকাতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়ার মধ্যে যেমন অপ্রেম রয়েছে তেমনই রয়েছে আবছায়া ভালোবাসা। কলকাতা এক রকম নয়। যে কলকাতার মধ্যে আধুনিক পণ্যময়তা নেই, প্রকৃতির নিজত্ব আছে সেই কলকাতা রবীন্দ্রনাথের আবছায়া ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছে। আর রবীন্দ্র অনুরাগের স্পর্শ পেয়েছেন সেই সব কলকাতাবাসী, যাঁরা অর্থ-বিত্তহারা হয়েও মনের মধ্যে বইয়ে দিতে পেরেছেন নিত্যদিনের ধলেশ্বরী।
রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে হেঁটে দেখতে শিখলে তা টের পাওয়া যাবে।
…ছাতিমতলা-র অন্যান্য পর্ব…
ছাতিমতলা পর্ব ২৮: মনের ভাঙাগড়া আর ফিরে-চাওয়া নিয়েই মধুসূদনের ভাষা-জগৎ– রবীন্দ্রনাথেরও
ছাতিমতলা পর্ব ২৭: বাংলা ভাষা কীভাবে শেখাতে চাইতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ২৬: ‘খানিক-রবীন্দ্রনাথ-পড়া’ প্রৌঢ়ের কথায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম চেনা যাবে না
ছাতিমতলা পর্ব ২৫: সুকুমার রায় যে অর্থে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জন করতে পারতেন, রবীন্দ্রনাথ তা পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২৪: বিশ্বভারতীর ছাপাখানাকে বই প্রকাশের কারখানা শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথ দেশগঠনের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ২৩: ধর্মবোধের স্বাধিকার অর্জনের কথা মনে করিয়ে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক মনকে মুক্ত করতে পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২২: রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল গৌণ বিষয়
ছাতিমতলা পর্ব ২১: রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতেন, চাঁদের আলোয় গান গাইতেন
ছাতিমতলা পর্ব ২০: সুভাষচন্দ্র বসুকে তীব্র তিরস্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
ছাতিমতলা পর্ব ১৯: আবেগসর্বস্ব ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ১৩: পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা রেণুকার স্বাধীন মনের দাম দেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১২: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১১: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
ছাতিমতলা পর্ব ১০: পাশ্চাত্যের ‘ফ্যাসিবাদ’ এদেশেরই সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির প্রতিরূপ, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৯: দেশপ্রেম শেখানোর ভয়ংকর স্কুলের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন স্কুল এখনও কেউ কেউ গড়তে চান
ছাতিমতলা পর্ব ৮: অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই অনুচিত দাবি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও
ছাতিমতলা পর্ব ৭: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
ছাতিমতলা পর্ব ৬: যে ভূমিকায় দেখা পাওয়া যায় কঠোর রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৫: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৪: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
ছাতিমতলা পর্ব ৩: ‘রক্তকরবী’র চশমার দূরদৃষ্টি কিংবা সিসিটিভি
ছাতিমতলা পর্ব ২: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
ছাতিমতলা পর্ব ১: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি