সম্পদের অপব্যয় ও সম্পদের সামাজিকতা তা দেশের ফেরে নানা ভাবে ধরা পড়ে। সম্পদের অপব্যয় তাকেও বলে যা ক্ষমতাতন্ত্রকে কায়েম করার জন্য ব্যয় করা হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কৃপণতা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের শক্তির অতিরিক্ত অংশ আমরা খরচ করিয়া আসিতেছি রাষ্ট্রতন্ত্রের জন্য নয়, পরিবারতন্ত্রের জন্য।’ এ-কথাটা পরাধীন ভারতবর্ষে যে অর্থ বহন করত এখন তার থেকে ভিন্ন অর্থ বহন করছে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন মনে করেছিলেন দেশের কাজে যাঁরা টাকা দেন না তাঁরা রাষ্ট্রতান্ত্রিক নন পরিবারতান্ত্রিক। পরিবারের স্বার্থ বাদ দিয়ে তাঁরা দেশের জন্য সম্পদ ব্যয় করেন না।
৩১.
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে প্রিন্স দ্বারকানাথের বংশধর বলে ভাবতে কুণ্ঠা বোধ করতেন। তাঁর অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথের অবশ্য পিতামহ সম্পর্কে কোনও দ্বিধা ছিল না। বিশেষত সত্যেন্দ্রনাথ যখন বিলেত গিয়েছিলেন তখন দ্বারকানাথের ‘উত্তরপুরুষ’ হিসেবে তিনি কোথাও কোথাও বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিলেন। উদ্যোগপতি পিতামহের অর্থ উপার্জনের সামর্থকে উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মী সত্যেন্দ্রনাথ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিচার করতেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের কুণ্ঠা এতখানি প্রবল যে, জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যখন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জীবনকথা লিখতে বসে পূর্বপুরুষ হিসেবে দ্বারকানাথকে অনেকখানি জায়গা দেন তখন রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করেন। প্রভাতকুমার অবশ্য রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মতো দ্বারকানাথের কথাকে পরিশিষ্টে না পাঠিয়ে তাঁর গ্রন্থের গোড়াতেই রেখেছিলেন। দ্বারকানাথের ব্যবসার দ্রব্য ও উপায় সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লোভে বলপূর্বক বিষপান করানো হইল; এমনতরো নিদারুণ ঠগীবৃত্তি কখনো শুনা যায় নাই। চীন কাঁদিয়া কহিল, ‘আমি আহিফেন খাইব না।’ ইংরাজ বণিক কহিল, ‘সে কি হয়?’ চীনের হাত দুটি বাঁধিয়া তাহার মুখের মধ্যে কামান দিয়া অহিফেন ঠাসিয়া দেওয়া হইল; দিয়া কহিল, ‘যে অহিফেন খাইলে তাহার দাম দাও।’ বহুদিন হইল ইংরাজেরা চীনে এইরূপ অপূর্ব বাণিজ্য চালাইতেছেন।” দ্বারকানাথও আফিমের ব্যবসা করতেন।
টাকা উপার্জনে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি নেই, তবে উপার্জনের বিষয় ও উপায় বিচার করে তিনি সেই উপার্জিত অর্থের পাপ-পুণ্য নির্ণয় করতেন। পাপ-পুণ্য তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক বিষয় ছিল না– সামাজিক ও মানবিক নিক্তিতেই কোনটা পাপ কোনটা, পুণ্য তা নির্দেশ করা চলে। যে অমানবিক কাজের শাস্তি দেওয়ার নিয়ম দেশ-কালে নেই তা অপরাধ না হতেই পারে, কিন্তু অমানবিক বলেই তা পাপ। টাকা উপার্জনের ও ব্যয়ের অমানবিক উপায়গুলি দেশের আইনে অপরাধ বলে বিবেচিত না হলেও তা পাপ। রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শাসকদের আয়-ব্যয়ের অমানবিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিকগুলিকে ‘পাপ’ বলেই চিহ্নিত করেছিলেন। বিলেতে বাস্তবধর্মী থিয়েটারের মঞ্চ নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা হত। ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বিলাতের স্টেজে শুদ্ধমাত্র এই খেলার জন্য যে বাজে খরচ হয়, ভারতবর্ষের কত অভ্রভেদী দুর্ভিক্ষ তাহার মধ্যে তলাইয়া যাইতে পারে।’ অমর্ত্য সেনের দুর্ভিক্ষ বিষয়ক গবেষণা পত্র তখন ভবিষ্যৎ গর্ভে। তবে রবীন্দ্রনাথের মতো চিন্তকের বুঝতে অসুবিধে হয়নি ঔপনিবেশিক পর্বে ভারতবর্ষের মানুষের অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষের কারণ প্রশাসনিক অন্যায়, বরাদ্দব্যয়-বণ্টনের অসামঞ্জস্য। বিলেতে স্টেজ সাজিয়ে আমোদ করে টাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই আমোদের অপব্যয় বন্ধ করে সে-টাকা কাজে লাগালে মানুষের জীবন রক্ষা করা যেত। ইংরেজ শাসক তাদের উপনিবেশের দরিদ্র প্রজাদের জন্য অবশ্য সে কাজ করবে না। বেচারা প্রজারাও তাদের শাসকদের এই পাপ থেকে প্রতিহত করার ক্ষমতার অধিকারী নয়।
‘বাজে খরচ’ না করে অর্থ সামাজিক কাজে লাগালে কী হয়, তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে। শ্রাবস্তীপুরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। হাহাকার শুনে বুদ্ধদেব শিষ্যদের আহ্বান করলেন। ক্ষুধিতের অন্নদান সেবা কার্যের দায়িত্ব কে নেবে? সকলেই নীরব। রত্নাকর শেঠ, সামন্ত জয়সেন মাথা নিচু করলেন। শেষে দায়িত্ব নিলেন ‘ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়া’। তার নিজের অর্থ নেই কিন্তু ‘সবাকার ঘরে ঘরে’ তার ভাণ্ডার। রবীন্দ্রনাথ একেই বলেছেন সম্পদের সামাজিকতা– এই সামাজিকতার দায়িত্ব ধনশীলদের গ্রহণ করতে হয়। ‘বাজে খরচ’-এর বিপরীতে সম্পদের এই ‘ভালো খরচ’।
প্রশ্ন হল, মানুষ কোনও মানবিক কাজে তাঁদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করবেন কেন? ব্যয় যাতে করেন তারই জন্য সমাজ মনের প্রস্তুতি চাই। রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ‘সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর জন্য যদি সাধারণের কাছ থেকে মুষ্টিভিক্ষা পেতে হয় তাহলে ‘বিজ্ঞান যাহাতে দেশের সর্বসাধারণের নিকট সুগম হয় সে-উপায় অবলম্বন করিতে ’ হবে। সর্বসাধারণের কাছে নিজের ভাষায় বিজ্ঞান সুগম হলে বিজ্ঞান সভার জন্য টাকা দিতে জনসাধারণ রাজি হবেন। সম্পদের সামাজিকতা কেবল ধনশীলদের পালনীয় নয়, সাধারণেরও পালনীয়।
এই যে সম্পদের অপব্যয় ও সম্পদের সামাজিকতা তা দেশের ফেরে নানা ভাবে ধরা পড়ে। সম্পদের অপব্যয় তাকেও বলে যা ক্ষমতাতন্ত্রকে কায়েম করার জন্য ব্যয় করা হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কৃপণতা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের শক্তির অতিরিক্ত অংশ আমরা খরচ করিয়া আসিতেছি রাষ্ট্রতন্ত্রের জন্য নয়, পরিবারতন্ত্রের জন্য।’ এ-কথাটা পরাধীন ভারতবর্ষে যে অর্থ বহন করত এখন তার থেকে ভিন্ন অর্থ বহন করছে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন মনে করেছিলেন দেশের কাজে যাঁরা টাকা দেন না তাঁরা রাষ্ট্রতান্ত্রিক নন পরিবারতান্ত্রিক। পরিবারের স্বার্থ বাদ দিয়ে তাঁরা দেশের জন্য সম্পদ ব্যয় করেন না। ‘দেশ’ বা ‘রাষ্ট্র’ বলতে তিনি বড় কিছুকে বুঝিয়েছিলেন। এখন এই পরিবারতন্ত্র অন্য আকার নিয়েছে। ব্যবসায়ী পরিবারগুলি অর্থ ব্যয় করেন, তবে দেশের জন্য নয় ‘রাজনৈতিক’ দলগুলির ভোটতন্ত্রের জন্য। ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করার জন্য বহু ব্যয় করতে হয়। ভোটের রঙ্গমঞ্চে নানা খেলা দেখানোর জন্য টাকা চাই। সম্পদশালী ব্যবসায়ী পরিবারগুলি টাকা প্রদান করেন– সেই অর্থ উপার্জনের জন্য প্রশাসনিক স্তরে নানা কৌশল। নানা বন্ড। সে টাকা দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যয় করা হয় না। ব্যবসায়ীরাও জানেন তাঁদের অর্থে ভোটে জয়লাভ করে রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় এলে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাতন্ত্রই সুরক্ষিত হবে। তাই তাঁদের ভোটের জন্য ব্যয়। পরিবারতন্ত্রের জন্যই ব্যয়।
টাকা বড়ো বালাই। রবীন্দ্রনাথের ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধের বাক্য বাঁকিয়ে এখন বলতে ইচ্ছে করে, “এখন নিও-লিবারেল অর্থনীতির কলিযুগ, সুতরাং ভোটের গন্ধমাদন টানিয়া আনিতে এঞ্জিনিয়ারিং চাই, তাহার ব্যয়ও সামান্য নহে, অসামান্য। স্বদেশের এই ভোটের স্টেজে শুদ্ধমাত্র এই খেলার জন্য যে বাজে খরচ হয়, ভারতে কত অভ্রভেদী খাদ্য-সমস্যা, শিক্ষা-সমস্যা তাহার মধ্যে তলাইয়া যাইতে পারে তার খবর সবাই রাখে কিন্তু কেহ কিছুই করে না, করিবেও না। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়িয়াছে।’
(চলবে)
…ছাতিমতলার অন্যান্য পর্ব…
ছাতিমতলা পর্ব ২৯: কলকাতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অপ্রেম রয়েছে যেমন, তেমনই রয়েছে আবছায়া ভালোবাসা
ছাতিমতলা পর্ব ২৮: মনের ভাঙাগড়া আর ফিরে-চাওয়া নিয়েই মধুসূদনের ভাষা-জগৎ– রবীন্দ্রনাথেরও
ছাতিমতলা পর্ব ২৭: বাংলা ভাষা কীভাবে শেখাতে চাইতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ২৬: ‘খানিক-রবীন্দ্রনাথ-পড়া’ প্রৌঢ়ের কথায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম চেনা যাবে না
ছাতিমতলা পর্ব ২৫: সুকুমার রায় যে অর্থে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জন করতে পারতেন, রবীন্দ্রনাথ তা পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২৪: বিশ্বভারতীর ছাপাখানাকে বই প্রকাশের কারখানা শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথ দেশগঠনের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ২৩: ধর্মবোধের স্বাধিকার অর্জনের কথা মনে করিয়ে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক মনকে মুক্ত করতে পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২২: রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল গৌণ বিষয়
ছাতিমতলা পর্ব ২১: রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতেন, চাঁদের আলোয় গান গাইতেন
ছাতিমতলা পর্ব ২০: সুভাষচন্দ্র বসুকে তীব্র তিরস্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
ছাতিমতলা পর্ব ১৯: আবেগসর্বস্ব ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ১৩: পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা রেণুকার স্বাধীন মনের দাম দেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১২: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১১: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
ছাতিমতলা পর্ব ১০: পাশ্চাত্যের ‘ফ্যাসিবাদ’ এদেশেরই সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির প্রতিরূপ, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৯: দেশপ্রেম শেখানোর ভয়ংকর স্কুলের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন স্কুল এখনও কেউ কেউ গড়তে চান
ছাতিমতলা পর্ব ৮: অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই অনুচিত দাবি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও
ছাতিমতলা পর্ব ৭: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
ছাতিমতলা পর্ব ৬: যে ভূমিকায় দেখা পাওয়া যায় কঠোর রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৫: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৪: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
ছাতিমতলা পর্ব ৩: ‘রক্তকরবী’র চশমার দূরদৃষ্টি কিংবা সিসিটিভি
ছাতিমতলা পর্ব ২: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
ছাতিমতলা পর্ব ১: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি
অশোক ঘোষ মনে করতেন, ট্রাম আন্দোলন কলকাতার হকারদের একটি রাজনৈতিক চেতনা জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কেরানি, হকার, আর উদ্বাস্তুদের লড়াই। আর ট্রাম-ডিপো মানেই হকার। এইসব দোকানেই আন্দোলনকারীদের আড্ডা বসত। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কথা আলোচনা হত। সকালে হয়তো কোনও এক চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে খবরের কাগজ পড়া হত।