রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের ছবি আকারমাত্রিক, সেখানে রঙের প্রবেশাধিকার তেমন ছিল না। কবিতার কাটাকুটি তাঁর ‘লে-আউট’-এর খাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে সেসব ছবি অনেকটা মনোক্রোম ঘেঁষা, টিনটেড ড্রয়িঙের মতো। সাদা-কালোর পাশাপাশি সেখানে যাদের উপস্থিতি চোখে পড়ে, তাদের মধ্যে ঘন বাদামি, পোড়া লাল অন্যতম। ছবির ভাষায় এই পোড়া লাল রংকে কেউ কেউ ‘ডার্টি রেড’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর পটে রঙের আরও উজ্জ্বল উপস্থিতি এসেছে দ্বিতীয় পর্যায়ে।
১৯.
রবীন্দ্রনাথের ছবির রঙের প্যালেট ঠিক কী ধরনের? অর্থাৎ কোন জাতীয় রঙের প্রাধান্য সেখানে? একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। এই ভাবনার সূত্রে তাঁর লেখার দিকেও আমাদের নজর দিতে হয়। ভুললে চলে না যে, তিনি প্রথমে লেখক, তারপর চিত্রকর। স্বাভাবিকভাবে সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন উঠে আসে, সাহিত্যে তাঁর রঙের ব্যবহারে কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে কি? আর থাকলে তা কেমন?
প্রথমে কবিতার দিকে তাকাই। রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রচনা ‘সন্ধ্যাসংগীত’ ও ‘প্রভাতসংগীত’ ছাড়িয়ে ‘ছবি ও গান’-এর দিকে এগিয়ে আসি। খেয়াল করলে দেখব, আগের দুটো বইয়ের চেয়ে ‘ছবি ও গান’– কাব্যগ্রন্থে ছবির চিত্রকল্প অনেক স্পষ্ট। চিত্রময় বর্ণনার পাশাপাশি বারবার এসেছে ছবি-আশ্রিত ভাবনার সচেতন ব্যবহার। কবিতায় এখানে ফিরে আসে এক চিত্রকরের ব্যাকুলতা। ‘কে যেন রে এঁকে রেখেছে’, ‘ছবির মতন কুঁড়েগুলি’, ‘যোগী যেন চিত্রে লিখা’, আকাশে আঁধার মুরতি আঁকা’, ‘স্তব্ধ সব ছবির মতন’, ‘নীল শূন্যে ছবি আঁকা’, ‘কত ছবি মনে আসে’ ইত্যাদি অজস্র শব্দবন্ধ ছবির অনুষঙ্গে বারবার উঠে আসে। তবে কোনওটাই পুরোপুরি ছবি হয়ে উঠতে পারছে না। ‘ছবি’, ‘চিত্র’, ‘মুরতি’ এই শব্দেরা এখানে যেন মোটিফের মতো ঘুরে ঘুরে দেখা দিচ্ছে। ‘ছবি ও গান’ রচনার সময় নিজের কথা বলতে গিয়ে রবি ঠাকুর বলছেন– ‘নানা জিনিসকে দেখিবার যে দৃষ্টি সেই দৃষ্টি যেন আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল। তখন একটি একটি যেন স্বতন্ত্র ছবিকে কল্পনার আলোকে ও মনের আনন্দ দিয়া ঘিরিয়া লইয়া দেখিতাম।… সে আর কিছু নয়, এক-একটি পরিস্ফুট চিত্র আঁকিয়া তুলিবার আকাঙ্ক্ষা। চোখ দিয়া মনের জিনিসকে ও মন দিয়া চোখের দেখাকে দেখিতে পাইবার ইচ্ছা। তুলি দিয়া ছবি আঁকিতে যদি পারিতাম তবে পটের উপর রেখা ও রঙ দিয়া উতলা মনের দৃষ্টি ও সৃষ্টিকে বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতাম কিন্তু সে-উপায় আমার হাতে ছিল না। ছিল কেবল কথা ও ছন্দ। কিন্তু কথার তুলিতে তখন স্পষ্ট টান দিতে শিখি নাই, তাই কেবলই রঙ ছড়াইয়া পড়িত।’
রবীন্দ্রনাথের শিল্পীসত্তার প্রসঙ্গে এখানে ছবির দু’টি প্রধান উপাদান রং ও রেখার কথা আলগোছেভাবে এল, তেমন স্পষ্ট হয়ে উঠল না। পরবর্তী পর্বে রঙের প্যালেট খানিক স্পষ্ট। তবে সে উজ্জ্বল ও ঝলমলে হয়ে প্রথম দেখা দিয়েছে ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পর্বে। রঙের বিভিন্ন পর্দা সেখানে কীভাবে বিস্তার পেয়েছে, একটু বুঝতে চেষ্টা করি।
সন তারিখের নিরিখে ‘ছিন্নপত্রাবলী’র সময়পট ১৮৮৭ থেকে ’৯৫, অর্থাৎ এর বিস্তার প্রায় বছর সাত-আটেক। তরুণ রবীন্দ্রনাথের কলমে ভাষার চিত্রময়তা এমন তীব্রভাবে আর কোথাও ধরা পড়েছে কি না, বলা শক্ত! শিলাইদহের সেই নির্জন প্রকৃতির মধ্যে প্রতিদিনের প্রভাত ও সূর্যাস্ত তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এক আশ্চর্য পত্রধারা! এই পর্বের লেখা এমন পিকচারেস্ক হয়ে উঠেছে যে, একে ‘ছিন্নপত্রাবলী’র পরিবর্তে ‘ছিন্নচিত্রাবলী’ বলতেই ইচ্ছে করে। এবারে দেখি সেই চিত্রাবলিতে রঙের উপস্থিতি কীভাবে দেখা দিয়েছে?
আগে বলেছি, জনহীন ধু-ধু মাঠের মধ্যে, গাছপালার প্রান্তে, পদ্মাপারের সেই সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় তাঁর শিল্পীমনকে বারবার বিহ্বল করে তুলেছে– প্রত্যেক বারই যেন প্রথম দেখার মতো বিস্মিত অভিভূত হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ! সেই মুগ্ধতার পাশাপাশি প্রকৃতির বর্ণনায় তাঁর প্যালেট অধিকার করেছে যে সব রং, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে নীল। কত বিচিত্র বিশেষণে ভরে উঠেছে নীলের বিবরণ– নীলাভ, ঈষৎ নীল, পাণ্ডু নীল, পরিষ্কার নীল, সুনীল নীল, গাঢ় নীল, নিবিড় নীল, নির্মল নীল, আর্দ্র নীল, স্নিগ্ধ নীল, সুকোমল নীল, কাজলের নীল, সুরমার নীল, আকাশের নীল, নদীর নীল, সমুদ্রের নীল, পাহাড়ের নীল, বনরেখার নীল, মেঘস্তূপের নীল, নীলকান্তমণির পেয়ালার নীল, নীল স্ফটিকের স্বচ্ছ পেয়ালার নীল ইত্যাদি ইত্যাদি।
নীলের পরেই যে রঙের কথা উঠে আসে, সে হল সোনালি– প্রকৃত পক্ষে তা হলুদের একটা টোন, যা মাঝে মাঝে আলো হয়ে ফুটে ওঠে। হলুদের সমান্তরাল সেই রঙের বর্ণনায় ধরা পড়েছে– অজস্র আলো, সুকোমল আলো, মদের মতো সোনালি আলো, উদাস আলো, চোরা আলো, গোধূলির বিবর্ণ ধূসর আলো, কোমল পাণ্ডু আভা, কাঁচা সোনালি রোদ্দুর, সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর, সোনালি মেঘ, সোনার লাবণ্য, সোনার মদ, রৌদ্রের সোনা, ‘সন্ধ্যাবেলাকার সোনালি’, সোনালি অন্ধকার, ‘সূক্ষ্মতম সোনালিতম সুদূরতম’, আকাশের স্বর্ণপট, সোনালি রেখা, সোনার আঁচল, সোনার-চেলি পরা বধূ, সোনার মেখলা, বাসন্তি আঁচল, বালির চরের হলদে রং, ভ্রমরের হলদে কোমরবন্ধ, হলদে ধানের খেত, পাকা ধান, বিকশিত সরষে-খেত ইত্যাদির মতো বিবরণ। আলোর আভাস মাখানো এই হলুদ আর সোনালি রং– সংখ্যার দিক থেকে হয়তো নীলের চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছে। ভেবে দেখলে, নীল আর হলুদের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ যেমন উচ্ছ্বসিত তেমনটা আর কোনও রঙের বেলায় ঘটে না। লক্ষ করলে বোঝা যায় ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে নীল আর হলুদের কথা এসেছে বারে বারে। তাঁর প্যালেটের প্রধান অংশ এদেরই অধিকারে। বাকি যেসব রং এসেছে সেগুলো এই প্রধান রং দু’টির আশপাশে ছড়িয়ে আছে। অনেকটা প্রান্তিক শ্রেণির মতো তাদের ম্লান উপস্থিতি। এই রঙের মধ্যে আছে সবুজ, গেরুয়া, ধূসর আর সাদা ও কালো। সবচেয়ে করুণ উপস্থিতি লাল রঙের– যা ‘রাঙা’ রঙের আড়ালে প্রায় গা-ঢাকা দিয়েছে। তুলনায় সবুজের বিশেষণে অনেক ব্যপ্তি। এটাও ভেবে দেখার, সবুজ রং নীল আর হলুদের মিশ্রণে গড়ে ওঠে। তাঁর সবুজের শেডগুলো যথাক্রমে– গাঢ় সবুজ, নিবিড় সবুজ, সরস সবুজ, গাছের সবুজ, ঘাসের সবুজ, মাঠের সবুজ, শৈবালের সবুজ, বিচিত্র সজীব সবুজ, সবুজের হিল্লোল, সুনবীন শ্যামল, সজল শ্যামল ইত্যাদি। এমনই সবুজের নানা ভেরিয়েশন এখানে ছড়িয়ে আছে। এছাড়া প্যালেটের এক ধারে টিম টিম করে জানান দিচ্ছে গেরুয়া আঁচল, জলের গেরুয়া, গাঢ় গেরুয়ার পাশাপাশি ধূসর বালির চর, ধূসর পৃথিবী এবং রবি ঠাকুরের ‘রাঙা’ রং। সে রং কখনও মেঘের অনুষঙ্গে– রাঙা মেঘ, কোথাও বা রাঙা বাঁকা রাস্তার উপমায়। সাদা আর কালো রঙের মধ্যে কালোয় বৈচিত্র কম, মেঘের কালো কার্পেট বা ঘন কালির মতো অন্ধকার– এইটুকু মাত্র! তবে সাদা রঙে অনেক ব্যঞ্জনা আছে। দৃশ্যতার চেয়ে সেখানে বড় হয়ে উঠেছে সাদা রঙের অর্থবহ দিক। যেমন সাদায় মিশেছে স্বচ্ছতা, নির্মলতা। আবার সাদা হয়ে উঠেছে অলৌকিক জ্যোতি, আলোর প্লাবন, জ্যোৎস্নার আলোর মৃদুতা থেকে ধূ ধূ সাদা বালির চরের মৃত্যুর রক্তহীনতা, জ্যোৎস্নালোকিত মাঠের ‘উদাস মৃত শূন্যতা’ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকী, সাদায় মিশেছে ‘বিশ্বব্যাপী বিচ্ছেদশোকের ভাব’। অথচ দিনের পর দিন মুগ্ধ হয়ে দেখা সূর্যাস্ত সূর্যোদয়ের বর্ণনায় লাল রঙের ব্যবহার নিতান্ত অপ্রতুল এবং সীমাবদ্ধ। প্রভাত বা সন্ধ্যার অনুষঙ্গে আকাশের সেই দীপ্র লাল কি ‘রাঙা’ রঙের সমার্থক হতে পারে? তবে কি লাল রঙের তীব্রতা তাঁর চোখে সেভাবে ধরা দিত না? এই আলোচনায় আমরা এখন যাচ্ছি না। সাহিত্যের এলাকা ছাড়িয়ে এবারে তাঁর ছবির জগতে প্রবেশ করি।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের ছবি আকারমাত্রিক, সেখানে রঙের প্রবেশাধিকার তেমন ছিল না। কবিতার কাটাকুটি তাঁর ‘লে-আউট’-এর খাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে সেসব ছবি অনেকটা মনোক্রোম ঘেঁষা, টিনটেড ড্রয়িঙের মতো। সাদা-কালোর পাশাপাশি সেখানে যাদের উপস্থিতি চোখে পড়ে, তাদের মধ্যে ঘন বাদামি, পোড়া লাল অন্যতম। ছবির ভাষায় এই পোড়া লাল রংকে কেউ কেউ ‘ডার্টি রেড’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর পটে রঙের আরও উজ্জ্বল উপস্থিতি এসেছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। সে অনেকটা বিদেশে প্রদর্শনীর পরে শিল্পী হিসেবে অভিনন্দিত, প্রত্যয়ী ছবি ঠাকুরের তুলি থেকে প্রকাশিত। তবুও স্বীকার করতে হয়, রং যেখানে প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে সেখানেও শিল্পী যেন চেনাবৃত্তে চলতে পছন্দ করেন। লক্ষণীয়, ছিন্নপত্রাবলীর সেই আশ্চর্য নীলের সমারোহ তাঁর ছবিতে বিরল। কখনও কখনও নীলের জোরালো উপস্থিতি থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে সবুজের সহযোগী হয়ে ওঠে, তার হাত ধরে দাঁড়াতে চায়। তবে সোনালি হলুদের অসামান্য দীপ্তি তাঁর নিসর্গের ছবিতে যে ইন্দ্রজাল রচনা করেছে– বিশেষ করে সূর্যাস্তের চিত্রমালায়– সেখানে ভাষা স্তব্ধ, অক্ষরের দল পরাজিত। সে ছবি কেবল চেয়ে দেখার! এ ছবি বুঝি গীতবিতানের পাতা থেকে সন্ধ্যার গানগুলিকে দৃশ্যরূপের এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে চায়।
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮: ছবি আঁকিয়ে রবিঠাকুরও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন
পর্ব ১৭: রবীন্দ্রনাথের নারী মুখমণ্ডলের সিরিজ কি কাদম্বরী দেবীর স্মৃতিজাত?
পর্ব ১৬: ট্যাক্স না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আটক করেছিল কাস্টমস হাউস
পর্ব ১৫: বাইরে সংযত রবীন্দ্রনাথ, ক্যানভাসে যন্ত্রণাদগ্ধ ছবিঠাকুর
পর্ব ১৪: অমৃতা শেরগিলের আঁকা মেয়েদের বিষণ্ণ অভিব্যক্তি কি ছবিঠাকুরের প্রভাব?
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি