নয়ের দশক এল তার নিজস্ব ধামাকা নিয়ে। এলেন আলেক পদমসি, পূজা বেদি ও মার্ক রবিনসন। এল নতুন কন্ডোম। কিন্তু তার বিজ্ঞাপন টিভিতে দেখাতে দেওয়া হল না। ততদিনে আমরা পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, ম্যাডান স্ট্রিট। জ্বলন্ত নারকোল দড়ি থেকে সিগারেট, কিন্তু আড়চোখে দেখে নিচ্ছি দোকানের পিছনের তাকে রাখা সারি সারি বিদেশি কন্ডোমের প্যাকেট। খাপের ওপর যৌন সম্ভোগের ছবি। চোখ ফেরানো দায়! এসবই তো খোলা রাস্তায়, তবু দেখতে পাব না পূজা বেদী? এক সিনিয়র তাঁর উত্তর কলকাতার চিলছাদের ঘরে ডেকে পাঠালেন কয়েকজন শিষ্যকে।
গায়ে মাখা সাবান, কাপড় কাচার সাবান, নরম পানীয়, চা-কফি ইত্যাদি বিজ্ঞাপনের ফাঁকে অলপ্পেয়ে ড্যাকরার মতো কখন ঢুকে পড়েছে নিরোধ, বয়োজ্যেষ্ঠরা ঠাহর করতে পারেননি। ছোটদের সাদা মনে কাদা নেই। ধাঁই করে জিজ্ঞেস করেছি, ‘কাকু এটা কি?’ উত্তর নেই। সেকালে সারা পাড়া ঝেঁটিয়ে সন্ধেবেলায় কোন টিভিওলা বাড়ির বৈঠকখানায়। পরের দিন আবার– ‘মাসি, এটা কি গো?’ মাসি মুখ ঘুরিয়ে নেন। আমার প্রশ্নের কারণটা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। ওই চকচকে সাবান, যা দিয়ে ঝরনার নিচে গা ঘষছেন সুন্দরী, কিংবা ওই কাপড় কাচার আশ্চর্য গুঁড়ো সাবান যা দিয়ে নিমেষে ফর্সা হয়ে যাচ্ছে কাদামাখা স্কুলের জামা, সেই মহার্ঘ বস্তু আমাদের মধ্যবিত্ত ভাঁড়ারে প্রবেশ করার কোনও সম্ভাবনা নেই। নরম পানীয় বা কফি খাওয়ার বয়স তখনও হয়নি। কাজেই এই বাজারে মাত্র ২৫ পয়সায় যদি একটি গোটা প্যাকেট পাওয়া যায়, মন্দ কী? জলি চ্যাপ আইসক্রিমের দামও ওই ২৫। তৃতীয় দিন আমার প্রশ্নের উত্তরে পাড়ার এক মাতব্বর ধমকালেন, ‘চোপ! বড় হলে জানবে।’ বেজায় সমস্যা! বড় হওয়া একটা লম্বা প্রসেস। কত বড় হলে ব্যাপারটা জানব, সেটাও কেউ বলে দেয়নি। পাড়ার বখাটেদের সঙ্গে মেশা বারণ, ওদিকে বয়েজ স্কুলের অকালপক্বরা ‘ভালো ছেলে’দের এড়িয়ে চলে। আর ভালো ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ফুল-ফল-পাতা ইত্যাদি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করে। মানে শুধুই বোটানি। সেই জঙ্গল থেকে বেরোনোর আগে আলজেবরাও শেখা হয়ে গেল। এতদিনে বুঝলাম, ‘নিরোধ’ একটি প্রোডাক্টের নাম, আসল ব্যাপারটি হল ‘কন্ডোম’, যা পুরুষদের ব্যবহার উপযোগী। এই ইনফরমেশন পেয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল মনে। মেয়েদের জন্যও এই ব্যবস্থা আছে কি না, সে প্রশ্ন জাগেনি। সোমনাথেরও জাগেনি। সে ক্লাস টেন-এ কোচিং সেন্টার যাওয়ার রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল সেই আশ্চর্য প্যাকেট। তারপর ক্লাস শেষ হলে সেগুলো ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ছিল বেলুনের মতো। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে লোফালুফি খেলা হয়েছিল সেই আটের দশকের মাঝামাঝি। অনেক দিন পর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একটি ইটালিয়ান ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী সৈনিকদের গ্রামের রাস্তায় হাতে হাতে ফোলানো কন্ডোম নিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য সোমনাথের কথা মনে পড়িয়েছিল।
নয়ের দশক এল তার নিজস্ব ধামাকা নিয়ে। এলেন আলেক পদমসি, পূজা বেদি ও মার্ক রবিনসন। এল নতুন কন্ডোম। কিন্তু তার বিজ্ঞাপন টিভিতে দেখাতে দেওয়া হল না। ততদিনে আমরা পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, ম্যাডান স্ট্রিট। জ্বলন্ত নারকোল দড়ি থেকে সিগারেট, কিন্তু আড়চোখে দেখে নিচ্ছি দোকানের পিছনের তাকে রাখা সারি সারি বিদেশি কন্ডোমের প্যাকেট। খাপের ওপর যৌন সম্ভোগের ছবি। চোখ ফেরানো দায়! এসবই তো খোলা রাস্তায়, তবু দেখতে পাব না পূজা বেদী? এক সিনিয়র তাঁর উত্তর কলকাতার চিলছাদের ঘরে ডেকে পাঠালেন কয়েকজন শিষ্যকে। মুখে মুচকি হাসি, হাতে ওই কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের ফোটোশুটের ছবি সম্বলিত একটি ম্যাগাজিন। মনে আছে, মার্ক রবিনসনকে দেখেও একইভাবে আপ্লুত হয়েছিলাম। আর ভেবেছিলাম কবে এই ল্যাটেক্স আমার পৌরুষকে ধন্য করবে। কারণ বাড়িতে কোনও দিন এই শব্দটি শুনিনি। বস্তুটিও দেখিনি। রাস্তাঘাটে ইতিউতি জঞ্জালের ধারে পড়ে থাকতে দেখেছি কখনও। আমার দুই বন্ধু পাড়ার ওষুধের দোকানে অ্যান্টাসিড কিনতে গিয়েছিল। পাড়ার মাঝবয়সি কাকু এসে তাদের কুশল জিগ্যেস করে দোকানদারকে এক প্যাকেট দিতে বলেন। এই ঘটনাটি বন্ধুদের এতটাই অবাক করেছিল যে, চা-সিগারেটের ঠেকে বারবার তা বর্ণিত হয়েছে রং চড়িয়ে।
আমেরিকা থেকে প্রথমবার যখন দেশে ফিরি, ধাঁই করে বিয়ে হয়ে যায়। এতদিনের অদেখা মন ও শরীর দুই-ই রাঙিয়ে তোলে, সে কারণেই তাড়াহুড়ো। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে টুথপেস্টের সঙ্গে কন্ডোম যোগ হয়। মানিকতলায় যে ওষুধের দোকানে বীরদর্পে প্রবেশ করি, সেখান থেকে আমার বেবিফুড কেনা হত। মালিক বাবার বয়সি। ওঁর বড় ছেলে আমার দাদার থেকে একটু ছোট। পিছনে বসা এক কমবয়সি কর্মচারীকে ইশারা করি। সে আমার ঠোঁট পড়ে নেয়। ব্রাউন পেপারের খামে পূজা আর মার্ক-কে ঢোকাতে যাবে, বড়দা হাত তুলে থামান– ‘বিয়ে হয়েছে?’ বিয়ের সঙ্গে কন্ডোমের কী সম্পর্ক– সেই বিতর্কে না জড়িয়ে আমি গম্ভীরভাবে বলি, ‘হ্যাঁ।’ উনি ভেঙে পড়েন, ‘আমরা জানতেও পারলাম না?!’ আমি উত্তর না দিয়ে হাত বাড়াই, দাম জিজ্ঞেস করে টাকা মেটাই। তারপর খাম থেকে প্যাকেটটি বের করে উল্টেপাল্টে দেখি। পাঁচজোড়া চোখ আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মারে, সতর্কবাণী কানে আসে, ‘এক্সপায়ারি ডেট দেখে নিও ভাই, ভেজালের যুগ চলছে।’