Robbar

কুকুরেরই জাত ভাই, অথচ শিয়াল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 14, 2025 8:32 pm
  • Updated:September 15, 2025 4:01 pm  

জীববিজ্ঞানে শিয়ালের যুক্তি, বুদ্ধি, আইকিউ মাপা হয় অন্যভাবে। যেমন, শিকার কৌশল। বরফের দেশে শিকার খুঁজে বের করা থেকে পাওয়া গেল তার সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। অভিযোজন ক্ষমতা থেকে বোঝা যায় শহুরে পরিবেশে শিয়াল রাতের আঁধারে মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারও সংগ্রহ করে, এমনকী, ট্রাফিক বোঝে। স্মৃতিশক্তি প্রখর। খাবার লুকিয়ে রাখে এবং পরে তা খুঁজে বের করে সঠিকভাবে। নানা ধরনের ডাক, লেজের ভঙ্গি, গন্ধ ব্যবহার করে জটিল বার্তা আদানপ্রদান করে যোগাযোগ রাখতে পারে শিয়াল।

সমীর মণ্ডল

৪.

যেখানটায় বসে লিখছি, সেটা মুম্বইয়ে আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিক। এলাকাটার ভৌগোলিক অবস্থান, পশ্চিমের একেবারে প্রায় শেষ প্রান্তে, তাই সমুদ্রের কাছে। শহরের ব্যস্ততা, আধুনিকতা, মেট্রোরেল, স্টেশন সবই আছে গায়ে গায়ে, অথচ ব্যালকনি থেকে বিশাল আকাশ দেখা যায়। অনেকটা ফাঁকা জমি সমুদ্র পর্যন্ত, কোনও বাড়িঘর নেই। খুব বড় আকাশ দেখতে পাওয়া এ শহরে ভাগ্যের ব্যাপার আজকাল। আমি ভাগ্যবান।

জল আর জলাভূমিও আমার পিছন ছাড়তে চায় না। এই মুম্বইতেও আমাদের বাড়ির সামনে জলাভূমি। বিস্তীর্ণ জলাভূমির মাঝখানে অনেকটা সবুজ অঞ্চল, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। এককালে এলাকাটা ছিল নুন তৈরির জমি।

শিল্পী: সমীর মণ্ডল

ক’দিন ব্যাপক বর্ষায় ভাসিয়ে দিয়ে গেল। এখন আকাশটা ধরে এসেছে। হালকা সাদা মেঘ, নীল আকাশ। শরতের মেজাজ। এ সময়ে খুব মন খারাপ হয়। কাশফুল কাশফুল মন। সামনের ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে কুবোপাখি আর ডাহুকের ডাক শুনি নিত্য। ছোটবেলায় বাবা বলত, কুবোপাখি নাকি নদী-সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সময়ের সঙ্গে ডাকে। আমাদের প্রকৃতির ঘড়ি। আর একটা ঘড়ি, যেটার শব্দ ক’দিন আগে পর্যন্ত শুনতে পেতাম মুম্বইয়ে, সেটা হচ্ছে শিয়ালের ডাক। শিয়ালও নাকি রাতের প্রহরে প্রহরে ‘হুক্কা হুয়া’ বলে আমাদের জানান দেয়, ‘জাগতে রহো’। এখন খেয়াল করলাম, শিয়ালগুলো আর ডাকছে না। তার মানে কি শিয়ালগুলোকে শহর থেকে তাড়িয়ে দিলাম নাকি আমরা?

এই শহরে অতি দ্রুত ঘরবাড়ি তৈরি এবং প্রচুর পরিমাণে আলো জ্বেলে পশুপাখিদের ঘরছাড়া করা হয়েছে অনেক। তাহলেও মুম্বই শহরের আশপাশে পাহাড় আর জঙ্গল মিলিয়ে নানা রকমের পশুপাখি আছে ভালোই।

ক’দিন ধরে পত্রপত্রিকায় কুকুর নিয়ে রচনার ঝড় বয়ে গেল। আইন-আদালত করে বেওয়ারিশ কুকুর তাড়ানোর গল্প। আমিও ভেবেছিলাম লিখব, কিন্তু লিখিনি। তাই ছোট্ট করে এখানে একটু স্বাদ মিটিয়ে নিই। দেখলাম কুকুরের পক্ষে-বিপক্ষে কত কিছু লেখা। প্রতিবাদ, মন খারাপ । কেউ বললেন, কুকুরের আইডেন্টিটি কার্ড চাই! পশুপ্রেমীরা খুব খেপে উঠলেন। কেউ বললেন, মানুষের সঙ্গে জানোয়ারের তফাত কোথায়! মানুষকে মানুষের কাছে প্রমাণ করতে হবে তুমি মানুষ। নইলে পাঠাব কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। মানে, ‘চলো দণ্ডকারণ্যে– কেন দণ্ড, কারণ নেই’। কেউ বিদ্রোহী। ধ্যুস্। এই কি জীবন? শালা, শিয়াল-কুকুরের মতো জীবন।

শিয়াল তো কুকুরেরই জ্ঞাতি, জাত ভাই অথচ ওদের খবর আমরা রাখি না। বেওয়ারিশ কুকুর আমাদের বাড়ির আশপাশে রাস্তায় প্রচুর এবং তাদের ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ মোটেই মধুর নয়। রাতে ঘুম ভাঙিয়ে পথের পুকুররা এমন হাঁক-ডাক শুরু করে যখন তখন, বড্ড বিরক্তিকর। কারণে-অকারণে গাড়ির পিছনে আওয়াজ করতে করতে ছুটছে, কখনও সাইকেলের পিছনে। এত কুকুর যে তাদের আবার ভাগাভাগি আছে। জমি ভাগ, মানে নিজস্ব মানচিত্র। গ্রামের দিকে কিন্তু এত কুকুর দেখিনি। শহরের মানুষেরও যেমন জনসংখ্যা বেশি, কুকুরেরও। তবুও কুকুর ছাড়া তো ভাবতেই পারি না। ওরা আছেই পায়ে পায়ে পাড়াপড়শির মতো। শিয়ালের ডাক অনেক সুরেলা এবং কবির ছড়ায় আরও মিষ্টি– ‘রাতে ওঠে থেকে থেকে শিয়ালের হাঁক’।

পঞ্চতন্ত্রের ছবিতে শিয়াল

ভাবি, রাস্তার কুকুরকে যদি সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দেওয়া হত তাহলে কোথায় যেত ওরা? কাছাকাছি জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর মতো বসবাস করত? ওদের আসল বসবাস কোথায়? মনে হয়, শিয়ালের মতো মানুষের কাছাকাছি জঙ্গলে থাকত। কারণ দু’টোই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে।

বেওয়ারিশ কুকুর শহর থেকে তাড়ানোর হুজুগ ওঠে মাঝে মাঝে। শহরে অনেকবার ওই কাণ্ডটা দেখেছি কুকুর ধরা গাড়ি এসে ওদের তুলে কোথায় যেন নিয়ে যায়। তবে কুকুর ধরার কাজটা অত সহজ নয়। কারণ নিঃসন্দেহে একটি বুদ্ধিমান প্রাণী কুকুর। গাড়ি এসেছে টের পেলে ওরা যেভাবে পালায়, তা দেখার মতো।

কুকুর ধরে কুকুরের শেলটারে নিয়ে যাওয়ার সময়ে পোষা কুকুর আর পথ কুকুরকে কীভাবে আলাদা করা হবে, তার একটা নিয়ম করে দিয়েছে। যে কুকুরের গলায় বেল্ট থাকবে সেটা পোষা কুকুর, যাদের নেই সে পথের। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায়, ঘরের মধ্যে বেঁধে না রেখে, খাবারদাবার দিয়ে প্রায় পোষা কুকুরের মতো কিছু কুকুর থাকে। তাদের গলায় একটা কাপড়ের টুকরো কিংবা কোনও ফিতে বেঁধে দেওয়া, যাতে ওগুলোকে না ধরা হয়।

…………………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন সমীর মণ্ডল-এর অন্যান্য লেখা

…………………………….

এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। কলকাতায় একবার এমন শহরের কুকুর ধরার খবর হল। আমরা তখন পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে, কলেজের হস্টেলে থাকি। কাছে নিমতলা শ্মশানের আশেপাশে গঙ্গার ধারে আউটডোর স্কেচ করতে যাই। তা ওখানে দেখলাম, শ্মশানের সাধুদেরও আবার পোষা কুকুর আছে। তেমনই একটা কুকুরের নাম ছিল ভোলা। সাধু তার গলায় কাতা দড়ি মানে নারকেল দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হারের মতো সুন্দর একটা বেল্ট বানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ আর ভোলাকে ধরে না। গাঁজা খাওয়ার সময় হলে সাধু ভোলাকে ডাকে। কাছে এলে গলার হার থেকে এক-দু’ইঞ্চি কেটে নিয়ে গাজার কলকে সাজায়। একদিকে কুকুরও পোষ্য হল, আইডেন্টিটি কার্ড পেল গলায়, আর অন্যদিকে সাধুরও হল একটা চলমান জ্বালানির ভাণ্ডার। আইডিয়া চমৎকার।

কুকুরকে নানা অবতারে দেখেছি। একবার এক রাশিয়ান এগজিবিশন দেখতে গিয়েছি। বড় রকমের প্রদর্শনীতে দেখানো হচ্ছে জুয়েলারি, মানে পৃথিবীর বিখ্যাত এবং বহুমূল্য অলংকারের সংগ্রহ। প্রদর্শনীতে ঢোকার মুখে প্রধান গেটে দেখেছিলাম এক অদ্ভুতদর্শন ছবি। ফিল্মস্টার ধর্মেন্দ্রর মতো চেহারা আর ঘন শ্যাওলা সবুজ রংয়ের সুন্দর পোশাকে একজন প্রহরী দরজায় দাঁড়িয়ে। কোমরে রিভলভার। হাতে তার ধরা আছে তেমনই সুন্দর বিশাল সাইজের স্বাস্থ্যবান এক কুকুর। ঠিক যেন কোনও রাজপুত্রের হাতে সাংঘাতিক শক্তিশালী এক সিংহ। কোনও অলংকারের কথা মনে নেই কিন্তু দরজার মূর্তিমান প্রহরী এবং কুকুরের দৃশ্যটি মনে আছে আজও।

রাশিয়া বলতে মনে পড়ছে আমার কর্মজীবনে সায়েন্স মিউজিয়ামে সেবার মহাকাশ মিশনের প্রদর্শনীর ডিসপ্লে করছিলাম। সেখানে একটি কুকুরের ছিল মহাকাশচারী অবতার। আপনারা তার নাম জানেন, ‘লাইকা’। প্রথম মহাকাশচারী কুকুর বলতে প্রধানত তাকেই বোঝানো হয়। ১৯৫৭ সালের সোভিয়েত মহাকাশযান ‘স্পুটনিক-২’-এর পৃথিবীর কক্ষপথে যাওয়ার প্রথম জীবন্ত প্রাণী। সেও ছিল মস্কোর এক রাস্তার কুকুর। দুর্ভাগ্যবশত মহাকাশেই তার মৃত্যু হয়েছিল এবং একটা বিতর্কিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেসময়। বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযানে প্রাণীদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রতিবাদ হয়েছিল তুমুল। তার শোকে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা পালন করেছিলেন সারা পৃথিবীর কুকুর-প্রেমী মানুষ।

লাইকা

আমারও কুকুরপ্রীতি কম ছিল না। বেশ কিছুদিন সাংবাদিক-সাহিত্যিক বন্ধু প্রীতীশ নন্দী এবং শ্রীমতী মেনকা গান্ধীর সঙ্গে ‘পিপ্‌ল ফর অ্যানিম্যাল্‌স’-এর দলে কাজ করেছি। বেওয়ারিশ পথকুকুরদের ধরে নিয়ে গিয়ে স্টেরিলাইজেশন মানে বন্ধ্যাত্বকরণ ইত্যাদি। ব্যক্তিগতভাবে মুম্বই এবং দিল্লিতে একক ছবির প্রদর্শনী করেছি। গায়ে-গতরে খেটে ছবি এঁকে পয়সা তুলেছি পশুর আশ্রম, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স কেনার জন্য।

মানুষের খুবই প্রিয় পোষ্য প্রাণী, কুকুর। তার বুদ্ধিমত্তা, ঘ্রাণশক্তি, শ্রবণশক্তি এবং আনুগত্য ইত্যাদির প্রশংসা সবার মুখে মুখে। তবে এত গুণধর যে কুকুর, সে আবার সাহিত্যে ব্রাত্য। রূপকথা, উপকথার সাহিত্যে শিয়ালের জনপ্রিয়তা কুকুরের চেয়ে অনেক বেশি। সে কথায় আসছি, তার আগে, সত্যিকারের আমার শিয়াল সান্নিধ্য কেমন– সেটা একটু বলি।

শিয়াল আর কুকুর দেখতে অনেকটা একইরকম। শিশু শিয়াল আর কুকুর অনেকটা একইরকম দেখতে। ছোটবেলায় আমাদের প্রশান্তদা খেলতে গিয়ে একবার ঝোপঝাড় থেকে একটি সুন্দর কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এল বাড়িতে। বাড়ির লোকেরা খুঁটিয়ে দেখে বলল, এ কী রে! এ তো শিয়ালের বাচ্চা! এক্ষুনি রেখে আয় জঙ্গলে।

মিশরের শিল্পে শিয়াল

হঠাৎ দেখে শিয়ালে কুকুর-ভ্রম কিংবা কুকুরে শিয়াল-ভ্রম আমার হয়েছে অনেকবার। গ্রামের বাড়িতে বর্ষাকালে অস্পষ্ট আলোয় ঘুম চোখে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম উঠোনে একটা কুকুর আমার দিকে তাকিয়ে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজছে। চোখ কচলে ভালো করে লক্ষ্য করলাম কুকুর নয়, আমার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে একটা শিয়াল।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ ছড়াতে কুকুরে শিয়াল ভ্রম হয়েছে।

লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল
দেখি এক ভিটরে শেয়াল
আরে ধ্যাৎ, শেয়াল কোথা
ভেলোটা দাঁড়িয়ে হোতা
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জুড়লো ছোটা।

আর একবার আমাদের বড় খালের মুখে পাড় থেকে অনেক নিচে জলের কাছাকাছি কাদায় পা আটকে একটি শিয়ালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। বোধহয় কাঁকড়া ধরতে জলের কাছে নেমেছিল। এঁটেল মাটির নরম কাদায় পা ডুবে আটকে আছে। আমার সঙ্গে তখন কেউ ছিল না। ভয়ে নিচে নেমে শিয়ালটাকে বাঁচানোর সাহস হয়নি। শিয়ালটার পরে কী হয়েছিল, বহুকাল সে কথা ভেবে খুব মনখারাপ হয়েছিল।

গ্রামে শিয়াল ছিল আমাদের পাড়ায় মস্ত মুরগি-চোর। এ বাড়ির সে বাড়ির ঘর থেকে খাঁচা থেকে প্রায়ই মুরগি হাওয়া হয়ে যেতে থাকল। কাণ্ডটা যে শিয়ালের সেটা সবার জানা, কিন্তু শিয়ালকে ধরে শাস্তি দেবে কী করে! আমাদের বন্ধুরা– কিশোর, জিতেন, অনন্ত– এরা আবার কারিগর, মস্ত টেকনিশিয়ান। ইঁদুর ধরার কলকবজা বড় করে কাঠের বাক্স বানানো হল, শিয়াল ধরার ফাঁদ। মুরগির কাটা পাখনা রাখা হল বাক্সের মধ্যে। দরজাটার কপাট উপরে তোলা, তার মধ্যে দিয়ে একটা বাঁকা পথ কাঠের। সেইটার ওপর দিয়ে পাখনার কাছে যেতে হবে আর পায়ের চাপে ওপরে আটকানো কলকাঠি খুলে গিয়ে দরজাটা হয়ে যাবে বন্ধ।

শিয়াল একদিন সত্যি সত্যি ধরা পড়ল ওই বাক্স কলে। মুখে বস্তা চাপা দিয়ে শিয়ালটাকে ধরা হলো। সামনের দুটো পা বের করে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে ধরল একজন, পেছনের পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে ধরল আর একজন। তারপরে দু’দিকের দুটো দড়ি, দুটো সাইকেলের সঙ্গে বেঁধে রাস্তায় ঘোরানো হলো শিয়ালকে শূন্যে ঝুলিয়ে। পাড়ার সবাই মনের সুখে শিয়ালকে ঢিল মেরে, পাথর মেরে শাস্তি দিল। মুরগি চুরিতে যতটা মনের কষ্ট, তার চেয়ে আরও বেশি কষ্ট হল এই দৃশ্য দেখে।

কুকুরকে নানাভাবে আমরা দেখেছি সে অন্যের কুকুর বা আমাদের বাড়ির কুকুর। তাকে স্পর্শ, আদর, তার খ্যাতি, বুদ্ধির প্রশংসা এবং তাকে নিয়ে হেলায়ফেলায় নানা রকম অপদস্থ করার অভিজ্ঞতা অনেকের মতো আমারও। ঠিক তেমনই রিয়াল শিয়াল দেখা, একেবারে হাতের কাছে এনে গায়ে হাত বোলানো এমনকী, লেজের লোম কেটে ছবি আঁকার তুলি বানানো পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে।

যা বলছিলাম, সাহিত্যে শিয়ালের জনপ্রিয়তা কুকুরের চেয়ে অনেক বেশি।

মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ, প্রাণীদের চোখ দিয়ে নিজের চরিত্র, কৌশল আর দুর্বলতা বুঝতে চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার সবচেয়ে সুন্দর রূপ দেখা যায় উপকথায়। যেখানে মানুষের চোখে শিয়াল এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। ঈশপের গ্রিক সরল উপকথা হোক বা ভারতের জটিল কাহিনির পঞ্চতন্ত্র– শিয়াল বারবার ফিরে আসে। কখনও চাতুর্যের মুখোশ পরে, কখনও রাজনীতির মঞ্চে উপদেষ্টার আসনে বসে। দুটোতেই শিয়াল আমাদের শেখায় এক চিরন্তন সত্য: শক্তি সবসময় জিততে পারে না, বুদ্ধিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।

গ্রিক ভাস্কর্যে ঈশপের মূর্তি

প্রাচীন গ্রিস থেকে উদ্ভূত ঈশপের গল্প। রচয়িতা হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ঈশপ নামক একজন গ্রিক ক্রীতদাসকে মনে করা হয়। এই গল্পগুলো পশ্চিমি সংস্কৃতির অংশ এবং প্রাচীন গ্রিক দর্শন ও সমাজের প্রতিফলন। পঞ্চতন্ত্র, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের একটি অংশ, যা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর দিকে সংস্কৃতে রচিত বলে মনে করা হয়। এটি বিষ্ণুশর্মা নামক একজন পণ্ডিতের রচনা বলে জানা যায়, এবং ভারতীয় সংস্কৃতি, নীতিশাস্ত্র ও রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক।

লোমশ লম্বা লেজ এবং চোখা চেহারার শিয়াল সত্যি সুদর্শন। শুধু সাহিত্য কেন, চিত্রকলা ভাস্কর্য এমনকী, দেবতার রূপেও শিয়ালকে বেশ মানিয়ে যায়। অন্যদের মতো মিশর আমার কাছে ছোটবেলা থেকেই এক রহস্য। ভাগ্যে জুটেছে জায়গাটা চাক্ষুষ করার। সেখানে উপভোগ করেছি মিশরের হায়ারোগ্লিফিক্‌স যেমন, তেমনি চিত্রকলা,ভাস্কর্য, বিজ্ঞান এবং অত পুরনো হলেও সভ্যতার আধুনিকতা। বিস্মিত হয়েছি শিয়ালকে মিশরের অন্যতম প্রধান দেবতা ‘আনুবিস’ রূপে দেখতে। ছবিতে, মূর্তিতে।

মিশরের শিয়াল দেবতা, আনুবিস

বিজ্ঞান বলছে, শিয়ালের বুদ্ধি মানুষের মতো নয়, তবে তার পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে নেওয়া, সুন্দর বাংলায়, অভিযোজন ক্ষমতা ও কৌশলী আচরণ তাকে টিকে থাকার মাস্টার বানিয়েছে। শিয়াল হল ‘ক্যানিডে’ পরিবারভুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। কুকুর এবং শিয়াল এই পরিবারের। পরবর্তীকালে সুয়োরানি, দুয়োরানির সন্তানের মতো, কারও ঠাঁই প্রাসাদে, কারও বনে। এরা শিকারি এবং সামাজিক, উভয়ভাবে বাঁচতে পারে।

জীববিজ্ঞানে শিয়ালের যুক্তি, বুদ্ধি, আইকিউ মাপা হয় অন্যভাবে। যেমন, শিকার কৌশল। বরফের দেশে শিকার খুঁজে বের করা থেকে পাওয়া গেল তার সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। অভিযোজন ক্ষমতা থেকে বোঝা যায় শহুরে পরিবেশে শিয়াল রাতের আঁধারে মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারও সংগ্রহ করে, এমনকী, ট্রাফিক বোঝে। স্মৃতিশক্তি প্রখর। খাবার লুকিয়ে রাখে এবং পরে তা খুঁজে বের করে সঠিকভাবে। নানা ধরনের ডাক, লেজের ভঙ্গি, গন্ধ ব্যবহার করে জটিল বার্তা আদানপ্রদান করে যোগাযোগ রাখতে পারে শিয়াল।

আজকের পর্ব শেষ করার আগে দুটো গল্প আছে। প্রথমটা কুকুরের বাস্তবতার গল্প আর দ্বিতীয়টা শিয়ালের, কল্পনা-আশ্রয়ী।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ওয়াইনারির মেজাজ-মর্জিই আলাদা। মরুভূমির বুকে ফসল ফলানো আর সবুজ গড়ে তোলার ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের কাজের অন্ত নেই। ওয়াইনারিতে ওয়াইন তৈরির আঙুর চাষের সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং পরম্পরাগত কাজের মধ্যে শিল্প-সম্মত কাজ উপভোগ করার উদাহরণ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তেমনই একটি ওয়াইনারিতে দেখলাম আঙুরের সঙ্গে মাশরুমের চাষ। ট্রাফ্‌ল মাশরুম। খুব দামি, এক-দেড় লক্ষ টাকা কিলো।

ট্রাফ্‌ল মাশরুম চাষ একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। বিশেষ ধরনের গাছ, যেমন ‘ওক’ বা ‘হ্যাজেল’-এর শিকড়ে জন্মায় এই মাশরুম। যেহেতু এটা মাটির নিচে থাকে আর দেখা যায় না তাই এটাকে খুঁজে বের করতে হয় গন্ধ শুঁকে। সেই কাজটা করে পারদর্শী কোনও কুকুর। বিশাল ওই বাগানের গাছ এবং পরিবেশ দেখতে গেলাম আমরা। তবে হ্যাপা অনেক। বাগানটা বেড়া দিয়ে ঘেরা, একটি গেট দিয়ে ঢুকতে হয় ভিতরে। গেটের বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় জুতো খুলে, পা ধুয়ে, খালি পায়ে বাগানে ঢুকতে হবে। কারণ কুকুরের ঘ্রাণশক্তি এতই সূক্ষ্ম যে জমিতে সামান্য অন্য গন্ধে ওদের কাজের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। অতএব বুঝতে পারছেন, সে কুকুরের খাতির যত্ন অনেক, দেমাক অনেক।

ট্রাফ্‌ল মাশরুম অনুসন্ধানের কুকুর

শেষে শিয়ালের গল্প। ঈশপের না পঞ্চতন্ত্রেরও না। বাংলা শিশু-সাহিত্যের অন্যতম, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির গল্প’ থেকে ‘বাঘখেকো শিয়ালের ছানা’র অংশ।

‘‘শিয়াল বললে, ‘এত খুঁজেও তো আর গর্ত পাওয়া গেল না। এখানেই থাকতে হবে।’

শিয়ালনী বললে, ‘বাঘ যদি আসে তখন কি হবে?’

শিয়াল বললে, ‘তখন তুমি খুব করে ছানাগুলির গায় চিমটি কাটবে। তাতে তারা চেঁচাবে, আর আমি জিগগেস করব– ওরা কাঁদছে কেন? তখন তুমি বলবে– ওরা বাঘ খেতে চায়।’

তা শুনে শিয়ালনী বললে, ‘বুঝেছি। আচ্ছা, বেশ!’ বলেই সে খুব খুশি হয়ে গর্তের ভিতরে ঢুকল। তখন থেকে তারা সেই গর্তের ভিতরেই থাকে।

এমনি করে দিন কতক যায়, শেষে একদিন তারা দেখলে যে ওই বাঘ আসছে। অমনি শিয়ালনী তার ছানাগুলোকে ধরে খুব চিমটি কাটতে লাগল। তখন ছানাগুলি যা চেঁচাল, তা কী বলব! শিয়াল তখন খুব মোটা আর বিশ্রী গলার সুর করে জিগগেস করলে, ‘খোকারা কাঁদছে কেন?’

শিয়ালনী তেমনি বিশ্রী সুরে বললে, ‘ওরা বাঘ খেতে চায়, তাই কাঁদছে।’

বাঘ তার গর্তের দিকে আসছিল। এর মধ্যে ‘ওরা বাঘ খেতে চায়’ শুনে সে থমকে দাঁড়াল। সে ভাবলে, ‘বাবা! আমার গর্তের ভিতর না জানি ওগুলো কী ঢুকে রয়েছে। নিশ্চয় ভয়ানক রাক্ষস হবে, নইলে কি ওদের খোকারা বাঘ খেতে চায়!’

তখুনি শিয়াল বললে, ‘আর বাঘ কোথায় পাব? যা ছিল সবই তো ধরে এনে ওদের খাইয়েছি!’

তাতে শিয়ালনী বললে, ‘তা বললে কি হবে? যেমন করে পার একটা ধরে আনো, নইলে খোকারা থামছে না।’ বলে সে ছানাগুলোকে আরো বেশি করে চিমটি কাটতে লাগল।”

সাহিত্যের অলংকরণে শেয়াল

এমন চমৎকার সরল সুন্দর, চাতুর্যপূর্ণ গল্প শুনে আমি এখনও ছোটদের মতো মুগ্ধ হই। শিয়ালের এই কৌশলী কর্মকাণ্ড তো মানুষেরই তৈরি। যেখানে বুদ্ধির চমক আর সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অপূর্ব মিশেল। এই ধরনের গল্প আমাদের শেখায়, জীবনের জটিল পথে বুদ্ধির সঙ্গে সতর্কতার মেলবন্ধন কতটা জরুরি। শিয়ালের কাছে আমরা শুধু শিক্ষাই পাই না, একই সঙ্গে সজাগ হই, সাবধান হই।

অল্পবিজ্ঞান-এর অন্যান্য পর্ব…

৩. অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনওদিন!

২. বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আমাদের চিরকালের নায়ক হয়ে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন

১. বস্তু নাকি ভাবনা, শিল্পকলায় কী খোঁজেন?