কুকুরের সঙ্গে মাতৃকাদেবীদের যোগ ঘনিষ্ঠ। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে অর্জুন-কৃত দুর্গাস্তবে দেবী দুর্গাকে ‘কোকামুখী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ‘কোকা’ বা ‘কোক’ শব্দের অর্থ বন্য কুকুর বা নেকড়ে। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি মশাই লিখেছেন দুর্গার মুখ ‘কুক্কুরী তুল্য’। গুজরাটের হদকাই মাতা কুকুর-কেন্দ্রিক মাতৃকাদেবী। তিনি কুকুর-বাহনা। চতুর্ভুজা দেবীর চার হাতে থাকে তলোয়ার, ত্রিশূল, ডমরু ইত্যাদি। দেবী কুকুর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে দেবী কুত্তাম্মাচণ্ডীর মন্দিরও আছে।
ভয়াবহ কাণ্ড! নিষ্ঠুর ঘটনা!
শুরু হয়েছে নির্বিচারে কুকুর হত্যা। রাজার আদেশ। কার হিম্মত আছে সেই রাজাজ্ঞা লঙ্ঘন করে!
পথেপ্রান্তরে গ্রামগঞ্জে নগরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কুকুর হত্যার বীভৎসতা। প্রাণে বাঁচতে ভীত সন্ত্রস্ত কুকুরের দল ছুটে গেল তাদের দলপতির কাছে।
দলপতি শ্মশানবাসী কুকুরটি স্থিতপ্রজ্ঞ, বিচক্ষণ। সবকিছু শুনে স্বজাতিদের বলল, ‘চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি।’
রাজা বসে আছেন বিচারাসনে। সভা গমগম করছে। এমন সময় সকলকে এড়িয়ে গিয়ে রাজার সম্মুখে দাঁড়াল দলপতি কুকুরটি। বলল, ‘মহারাজ আমার আর্জি আছে’।
রাজা বললেন, ‘কী তোমার আর্জি?’
–আপনি কুকুর হত্যার আদেশ দিয়েছেন কেন?
–তুমি শোন নাই, আমার বহুমূল্য রথের চর্মসজ্জা কুকুররা খেয়েছে। তাদের শাস্তি পেতেই হবে।
–আপনি সকল কুকুরকেই কি হত্যার আদেশ দিয়েছেন?
–হ্যাঁ। তবে রাজকুকুরগুলি এই নিয়মের বাইরে। কেননা ভৃত্যরা জানিয়েছে, বাইরের কুকুর নর্দমা দিয়ে প্রবেশ করে এই মারাত্মক অপকর্মটি করেছে।
দলপতি কুকুরটি সবিনয়ে জানাল, ‘রাজার কুকুর মারা হচ্ছে না। কিন্তু দুর্বল কুকুরদের হত্যা করা হচ্ছে বিনা বিচারে?’
‘কী বলতে চাও তুমি?’ রাজা বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করলেন।
–আজ্ঞে মহারাজ। আপনার কুকুর যে এ কাজ করেনি তার নিশ্চিত প্রমাণ কি পেয়েছেন?
–না, মানে!
–অনুগ্রহ করে আপনি পরীক্ষা করুন। আপনার কুকুরদের ঘোল আর কুশঘাস খাওয়ান। তারপর নিশ্চিন্ত হন। বিচার সঠিক হোক।
রাজা ইঙ্গিতটি বুঝতে পারলেন। রাজার আদেশ মতো তাঁর পোষা কুকুরদের নিয়ে এসে ঘোল আর কুশ খাওয়াল ভৃত্যরা। কুকুরগুলি কিছুক্ষণের মধ্যে বমি করতে শুরু করল। রাজা অবাক হয়ে দেখলেন, কুকুরের বমিতে ছড়িয়ে পড়েছে চর্মসজ্জার টুকরোগুলি।
রাজা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে অন্যায় আদেশ ফিরিয়ে নিলেন। অনুতপ্ত বিচারক-রাজার অন্তঃকরণে জাগ্রত হল করুণা আর দয়ার সঙ্গে অভূতপূর্ব সারমেয় প্রেম।
এমন কাহিনি বৌদ্ধ ‘কুক্কুর জাতকে’ রয়েছে। যুগে যুগে মানুষ কুকুরকে ভুল বুঝলেও শেষ পর্যন্ত অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছে। এই আখ্যানটি তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। কুকুরকে নিয়ে প্রবল সমস্যা তৈরি হলেও মানুষ তাকে অস্বীকার করতে পারেনি তার বিচিত্র স্বভাবের জন্য।
কেননা কুকুর প্রভুভক্তি ও বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক। তার রক্তে নেই বিশ্বাসঘাতকতা। সেই সঙ্গে সে অতন্দ্র প্রহরী বা রক্ষী। অনেকসময় বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে কুকুর নিজের জীবন বাজি রাখে। কুকুরের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ক শুধু একালের নয়। যুগ যুগ ধরে মানুষ আর কুকুরের ভালোবাসার বৃত্তটি পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হয়ে উঠেছে।
মানুষের শিকার-জীবন পর্যায়ে কুকুর সম্ভবত তার অন্যতম সঙ্গী হয়ে ছিল। অন্তত ১০০০০ বছরের পুরাতন ভীমবেটকা গুহাচিত্রে মানুষের শিকার-জীবনের চিত্রমালায় কুকুর স্থান পেয়েছে। কাশ্মীরের বুরজাহোম প্রত্নক্ষেত্র থেকে নিওলিথ পেন্টিং-এ কুকুরকে দেখা যায়। হরপ্পা সংস্কৃতিতেও কলার যুক্ত পোড়ামাটির সারমেয় আবিষ্কৃত হয়েছে। গোলাকার চক্ষুদ্বয়, প্রলম্বিত কান আর বাঁকানো লেজ। বাংলায় একসময় পঞ্চাননের থানে পোড়ামাটির গোরু-ঘোড়া্র সঙ্গে কুকুরমূর্তি দেওয়ার প্রচলন ছিল।
ভারহুত স্তূপে মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসাবে কুকুরকে দেখা যায় খোদাই রিলিফে। প্রাচীন শিল্পচর্চায় কুকুর যে স্থান পেয়েছে তার মূলে আছে পশুটির উপরোক্ত স্বভাব আর সেই সূত্রে মানুষের নিবিড় ভালোবাসার প্রকাশ।
শুধু শিল্পচর্চায় নয়, ভারতীয় আদি সাহিত্যেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। ঋকবেদের প্রথম মণ্ডলের ১৬৩-র ১৩ ঋকে বলা হয়েছে– সবিতার গৃহে ঋভুগণ নিদ্রাগত হয়েছিলেন, একটি কুকুর তাদের জাগিয়ে দিল। কোথাও বলা হয়েছে, ‘অশ্বিদ্বয় আমাদের তনুকে কুকুরের মতো রক্ষা করুন’। কুকুরের এই স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যগুলির নিরিখে ধীরে ধীরে বাংলা তথা ভারতীয় লোককাহিনি, ধর্মীয় সংস্কৃতি, প্রাচীন সাহিত্য ও দেব পরিকল্পনায় অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে। ভারতীয় সভ্যতায় এইজন্য সারমেয় সংস্কৃতি বিশেষ বৈচিত্রময়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর জৈন লেখক হংসদেব রচনা করেছিলেন ‘মৃগপক্ষী শাস্ত্র’। কুকুর প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে গায়ের রং, স্বভাব, শিকার করা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে কুকুরের ছয়টি শ্রেণিবিভাগ করেছেন রচনাকার; যথা– শ্বান, কুকুর, শুনক, মৃগদংশক, সারমেয় ও গ্রাম্যমৃগ। তিনি এ প্রসঙ্গে এ-ও লিখেছেন, যারা জীবজন্তুকে রক্ষা করে না তারা খ্যাতি, পুণ্য এবং আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন।
তবে কুকুর নিয়ে মানুষ সমস্যাও ভোগ করেছে আদিকাল থেকে। বিড়ালের তুলনায় কুকুর অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন প্রাণী। পাগলা কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে। তবু মানুষের সান্নিধ্য আর ভালোবাসা থেকে কুকুর কখনও বঞ্চিত হয়নি। বরং কুকুর-কেন্দ্রিক সমস্যা এড়াতে মানুষ বিচিত্র কুকুর-দেবতার কল্পনা করেছে। ব্রতচর্যাতেও কুকুর উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে।
পুরাণসাহিত্য অনুসারে কুকুর জাতির উদ্ভব দক্ষকন্যা সরমা থেকে। এই কারণে কুকুরকে ‘সারমেয়’ বলে। ঋকবেদে সরমা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সে ইন্দ্রের বিশ্বস্ত দূতী হিসাবে স্থান পেয়েছিল। দশম মণ্ডলের ১০৮ সূক্তে ইন্দ্রদূতী সরমা ও পণি দস্যুদের কথোপকথন কুকুরের প্রভুভক্তি এবং বিশ্বস্ততাকে মনে করায়। পণিরা ইন্দ্রের গাভী হরণ করলে ইন্দ্রের নির্দেশে গাভী খুঁজতে সরমা গিয়েছিল তাদের কাছে। সরমা পণিদের প্রলোভন সামলে দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন বলে তাঁর সন্তানদের লালন-পালনের ভার ইন্দ্র নিয়েছিলেন।
জাতকের মতো রামায়ণে রামচন্দ্রের কাছে কুকুরের ন্যায়বিচার চাওয়ার গল্প আছে। ভরতের কুকুর-প্রীতির কথাও জানা যায়। অবশ্য ‘কুকুর’ নামে মানুষের কথা আছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। হরিবংশের ৩৮-তম অধ্যায়ে কুকুর বংশের বর্ণনা আছে। মহাভারতে ভীষ্মপর্বের নবম অধ্যায়ে ‘কুকুর’ নামের মানুষের কথা ধ্রতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় বলেছিলেন। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, কুকুর ছিল তাদের টোটেম। মহাভারতের কাহিনি অনুসারে যুধিষ্ঠির যখন স্বর্গদ্বারে পৌঁছন, তখন ইন্দ্র তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দিলেও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী কুকুরটিকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কুকুরের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে স্বর্গ গমনের অনিচ্ছাপ্রকাশ করলে ইন্দ্র বাধ্য হয়ে কুকুরটিকেও স্বর্গযাত্রার অনুমতি দিয়েছিলেন।
কুকুর ক্রমশ মৃত্যুদেবতা যমরাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সরমার দুই পুত্র শর্বর ও শবল যমপুরীর প্রবেশদ্বারের পাহারাদার। এদের চারটি চোখ। ভয়ংকর দর্শন। ঋকবেদের যমসূক্তে এদের কথা আছে। অথর্ববেদে কুকুরকে যমদূত বলা হয়েছে। লোকবিশ্বাস হল, কুকুর যখন কাঁদে তখন অমঙ্গল বা বিনাশের ইঙ্গিত করে। অনেকে কুকুরের সুপার ন্যাচারাল পাওয়ারে বিশ্বাসী।
যমরাজ ব্যতিরেকে কুকুরের সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ককে কয়েকটি ভাগে বিভাজিত করা যেতে পারে। যেমন ভাস্কর্যে দেবতার সঙ্গী হিসাবে কুকুর। দেবতার বাহন হিসাবেও কুকুর উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কুকুর-কেন্দ্রিক দেবতা আছেন। আরও রয়েছে কুকুর-কেন্দ্রিক ব্রত ও কুকুর-সম্পর্কিত মন্দির।
হিন্দুধর্মে সূর্যপুত্র রেবন্ত শিকারীদের দেবতা হিসাবে মান্য। বনপথে ভয়, ভূতের ভয় ইত্যাদি নিবারণকারী দেবতা রূপে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাতেও একসময় পূজিত হতেন। মেদিনীপুরে, মালদহে, বাংলাদেশে, পূর্ব বর্ধমান জেলার কুরুম্বা গ্রামে রেবন্ত মূর্তি আজও পূজিত হচ্ছে।
ভাস্কর্যে রেবন্ত ঘোড়ার পিঠে চড়ে আছেন। শিকার বা মৃগয়ার সাজে তিনি সজ্জিত। রেবন্ত যক্ষদের মতো সুপার ন্যাচারাল পাওয়ারের অধিকারী গুহকদের অধিপতি ছিলেন। সেই কারণে তাঁর শিকার যাত্রায় গুহকরা কেউ ছত্রধারী, কেউ মদের বা জলের পাত্র নিয়ে সঙ্গী। কেউ শাঁখ বাজাচ্ছে। কারও কাঁধে রয়েছে শিকার করা হরিণ। রেবন্ত ভাস্কর্যে বিশ্বস্ত এক শিকারী কুকুরকে অবশ্যই দেখা যায়।
এই কুকুরটি সম্ভবত জৈন লেখক হংসদেব কথিত ‘মৃগদংশক’। এরা মূলত বাদামি বর্ণের হয়। মৃগদংশক, হরিণ ও ছাগল ইত্যাদি পশু শিকার করতে ওস্তাদ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পারস্যের সম্রাট ভারত থেকে আমদানি করা কুকুর নিয়ে শিকার বা মৃগয়া করতে ভালোবাসতেন।
কুকুরের সঙ্গে শিবের ভৈরবের যোগ গভীর। কালভৈরবের বাহন কুকুর। বটুক ভৈরবের সঙ্গেও কুকুর জুড়ে আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস হল, কালো কুকুরকে আগ্রহ সহকারে খাওয়ালে ভৈরবের কৃপা পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে শিবাবতার ক্ষেত্রপালের বাহন কুকুর। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেবতার সমন্বয়কারী জনপ্রিয় দেবতা ‘দত্তাত্রেয়’। ষড়ভুজ দত্তাত্রেয়ের হাতে থাকে কমণ্ডলু, শঙ্খ, ত্রিশূল, গদা ইত্যাদি। দেবতার সঙ্গী চারটি কুকুর ও একটি গাভী। চারটি কুকুর যেমন চতুর্বেদের প্রতীক, তেমনই গাভীমাতাকে ধরিত্রী হিসাবে সনাক্ত করা হয়।
কেরালার মালাবার উপকুলের অন্যতম শিকারী দেবতা মুত্থাপ্পনের বাহন কুকুর। আজও ভক্তরা দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে কুকুরের ছলন মানত করেন। মহাভারতের সভাপর্বের একাদশ অধ্যায় থেকে জানা যায়, সরমা ছিলেন ব্রহ্মা উপাসক। বনপর্বের ২৩০-তম অধ্যায় থেকে জানা যায়, সরমা বালগ্রহের অপদেবী রূপে পূজিত হতেন সেকালে। বিশ্বাস করা হত, সরমা অসন্তুষ্ট হলে গর্ভবতী মহিলার গর্ভের ভ্রুণ চুরি করবেন।
সরমা বা কুক্কুরী মাতৃকাদেবী হিসাবেও পূজিত হতেন একসময়। মৎস্যপুরাণের মতে, শিব যখন অন্ধকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত হয়েছিলেন, তখন অন্ধকাসুরের শরীরের রক্ত পান করানোর জন্য অন্যান্য মাতৃকাদেবীদের সঙ্গে মহাদেব সরমা দেবীকে সৃষ্টি করেন।
গুজরাটের হদকাই মাতা এমনি এক কুকুর-কেন্দ্রিক মাতৃকাদেবী। তিনি কুকুর-বাহনা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, দেবীর কৃপা হলে পাগলা কুকুরে কামড়াবে না। দেবী কুকুরের উপরে বসে আছেন। চতুর্ভুজা দেবীর চার হাতে থাকে তলোয়ার, ত্রিশূল, ডমরু ইত্যাদি। দেবী কুকুর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকতে ভালোবাসেন।
কুকুরের সঙ্গে মাতৃকাদেবীদের যোগ ঘনিষ্ঠ। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে অর্জুন-কৃত দুর্গাস্তবে দেবী দুর্গাকে ‘কোকামুখী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ‘কোকা’ বা ‘কোক’ শব্দের অর্থ বন্য কুকুর বা নেকড়ে। নেকড়ে আর কুকুর আদিতে একই ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, ১৫ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে বুনো কুকুরদের একটা অংশ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে নেকড়েদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। ‘মৃগপক্ষী শাস্ত্র’ বই থেকে জানা যায়, নেকড়ে বা বুনো কুকুর দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ ‘বৃক’– এরা কালো রঙের, ভয়ংকর শিকারী। আর দ্বিতীয় ভাগ, ‘কোকা’ হল আকৃতিতে ছোট। এদের লম্বা জিভ দেখার মতো।
যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি মশাই তাঁর ‘পূজা পার্বণ’ গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন দুর্গার মুখ ‘কুক্কুরী তুল্য’। বিদ্যানিধি মশাই জানিয়েছেন, বাঁকুড়া জেলার রাইপুরে দুর্গার কোকামুখীর একটি পাথরের প্রতিমা পূজিত হচ্ছে।
কোকামুখী দুর্গা বা কালীর বিরল টেরাকোটা ফলক দেখা যায় পূর্ব বর্ধমান জেলার দাঁইহাটের আট চালা শৈবমন্দিরে। দেবী চতুর্ভুজা। সামনের দিকে তিনটি হাতের মধ্যে উপরের হাতে কৃপাণ। মাঝের হাতে ছিন্ন মুণ্ড, যার চুলের অগ্রভাগ দেবীর মুখমণ্ডলে। নিচের হাতে বরদ মুদ্রা। পিছনের হাতে কাটা মুণ্ড।
দেবীর দেহের মধ্যাংশ সর্পাকৃতি কিংবা গোধাতুল্য। মুখমণ্ডল কোকাসদৃশ। সামনের দিকে দাঁতের পাটি দেখা যাচ্ছে। জিভটি একপাশে ঝুলছে। দেবীর হাতে অলংকার। মাথায় লতাপাতা-খোদিত শঙ্কু আকৃতির মুকুট। শরীরের নিম্নাংশে শাড়ি। গলায় ও কোমরে যথাক্রমে মুণ্ডমালা ও নরকর মালা। শিব জাগ্রত। তাঁর লিঙ্গভাগ যৌন উত্তেজনায় খাড়া হয়ে আছে। অসুরনাশিনী দুর্গার সঙ্গে কোকা বা কুকুরের যোগের মূলে আছে হয়তো বৈদিক সাহিত্যে উল্লিখিত সরমা কর্তৃক পণি অসুরদের কাছ থেকে গাভী ছিনিয়ে আনার প্রসঙ্গটি।
সাধারণত কোনও হিন্দু মন্দিরে কুকুরের প্রবেশ নিষিদ্ধ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে শ্রীমন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে দেবী কুত্তাম্মাচণ্ডীর মন্দির আছে। জগন্নাথদেবের ভোগ কোনও কারণে অশুচি হলে ভক্তদের বিশ্বাস হল– চণ্ডী দেবী কুকুরের রূপ ধরে বাইশপাহাড় সিঁড়ির কাছে ঘোরাঘুরি করেন। যা দেখে সেবকরা ভোগ অশুচির বিষয়টি জানতে পারেন। একসময় কুত্তাম্মাচণ্ডী শ্রীমন্দিরেই পূজিত হতেন। পরে স্থানান্তরিত হয়েছে্ন। কুত্তাম্মাচণ্ডীর ভোগ হয় বলরামের প্রসাদে।
পশ্চিমবাংলার অন্যতম প্রাচীন বাউড়ি জনগোষ্ঠী বাউড়ি বা সর্দার। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে বাউড়িরা আসলে প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত ‘বরুড়’ জনজাতি। এঁদের কুল প্রতীক বা টোটেম হলো কুকুর। কুকুর তাঁদের চোখে আরাধ্য ধর্মরাজ বা যমরাজের প্রতীক।
রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য ‘ধর্মমঙ্গল’। ধর্মঠাকুরকে যমরাজ হিসাবে অনেক স্থানে পূজা করা হয়। বীরভূমের সিউরি থানার ইঁদগাছা, সাঁইথিয়া থানার অজয়কোপা, বোলপুরের সুপুর, কাটোয়া থানার সুয়োগাছি, ভাতার থানার রামচন্দ্রপুর প্রভৃতি গ্রামের ধর্মরাজ যমরাজ রূপে পূজিত হন। ধর্ম-ধ্যানে উচ্চারণ করা হয়– ‘নমস্তে বহুরূপায়, যমায় ধর্মরাজায়’। ধর্মরাজের আদি উপাসক হলেন ডোম ও বাউড়ি জনগোষ্ঠী।
ধর্মরাজের প্রতীক হিসাবে কুকুর মহাভারতেই মান্যতা পেয়েছিল। বেদ-উপনিষদ-পুরাণ সাহিত্যে কুকুর প্রাণের প্রতীক হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। যমদূত হিসাবে কুকুর পৃথিবী ঘুরে ঘুরে মুমূর্ষুর প্রাণকে যমের কাছে নিয়ে যায়– এমন কথা লেখা হয়েছে ঋকবেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১৪ নম্বর সূক্তে। ছান্দ্যোগ্য উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ খণ্ডটির নাম ‘শৌব উদগীথ’ অর্থাৎ কুকুরদের সামগান। এখানে শ্বেত কুকুরের বর্ণনা আছে যা ধর্মঠাকুর ভাবনায় জড়িত। শূন্যপুরাণে বলা হয়েছে ধর্মভক্ত্যাকে যম কখনও স্পর্শ করে না।
এই সূত্রে কাটোয়া থানার শুয়োগাছি গ্রামে ধর্মরাজ মন্দির প্রাঙ্গণে অনেক কুকুরের সমাগম ঘটে প্রতি রবিবারে। এদিন সেবাইতরা ধর্মরাজের স্বপ্নে দেওয়া ওষুধ দান করেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভক্তবৃন্দকে। ভক্তরা ওষুধ গ্রহণ করে উপস্থিত কুকুরদের ভক্তি সহকারে খাবার দেন। তাঁদের বিশ্বাস– এর ফলে ধর্মরাজ সন্তুষ্ট হন।
প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে কুকুর দেবতা হিসাবে যেমন পূজিত হত, তেমনই কুকুরকে নিয়ে ব্রতাচর্যাও গড়ে উঠেছিল। যাঁরা সেই কুকুর ব্রত পালন করতেন তাঁদেরকে ‘কুকুর বতিক’ অর্থাৎ কুকুর-ব্রতী বলা হত। বৌদ্ধ ‘মজ্ঝিমনিকায়’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, যাঁরা কুকুর ব্রত বা কুকুর দেবতার পুজো করতেন– তাঁদের সাধন চর্যায় কুকুরের দৈনন্দিন জীবন প্রণালীর অনুকরণ থাকত। আদি বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাগীতির কবিদের তালিকায় কুক্কুরীপাদের নাম পাওয়া যায়। নামকরণে স্পষ্ট ইনিও কুকুর দেবতার উপাসক ছিলেন। কুক্কুরীপাদের লেখা বিখ্যাত চর্যাপদটি নিশ্চয়ই মনে পড়ে–
দুলি দুহি পিটা ধরণ না যাই
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ।।
কুকুর-কেন্দ্রিক সবচেয়ে পুরাতন মন্দিরটি রয়েছে মধ্যপ্রদেশের দিনদারির ঋণমুক্তেশ্বর শৈবালয়ে। মন্দিরটি দশম শতকে এক স্থানীয় রাজা নির্মাণ করেন। কথিত আছে, একটি কুকুরকে ভুলবশত হত্যা করেছিলেন বলে অনুশোচনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে তার সমাধির উপর তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত এই শিবের মন্দিরটি। কুকুরের মন্দির রয়েছে ছত্রিশগড়ের রাজনন্দ গ্রামে। আরও অনেক স্থানে রয়েছে কুকুরের মন্দির।
নেপালে হিন্দুরা কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে কুকুর পুজো করেন। এর নাম ‘কুকুর তিহার’। তাঁদের বিশ্বাস, কুকুর প্রসন্ন হলে মৃত্যুর পর নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না। সেই কারণে সেদিন কুকুরকে তাঁরা পুজো করেন। পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়। বাংলায় এই ধরনের কোনও পুজো না থাকলেও মন্দির ফলকে চৌরি রীতির মাটির বাড়ির দারু ভাস্কর্যে কুকুর স্থানলাভ করেছে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved