ফি সন্ধেয় মজিদ এসে বসতেন! আবিদুর সাহেব নিজেও ফুটবল খেলতেন এককালে। মজিদের সঙ্গে সখ্য জমতে তাই সময় লাগেনি। আট কিংবা নয়ের দশকে নিউ ক্যাথের চিনে খাবারের বেজায় নামডাক হয়েছিল। ‘শরাব’ ছুঁতেন না মজিদ। কিন্তু চিনে খাবার পছন্দ করতেন। ভূপেন হাজারিকা আবার ঢুকতেন রাত আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ। সদলবলে। পেটে তিন-চার পাত্র পড়লে গলা ছেড়ে ধরতেন, ‘মানুষ, মানুষেরই জন্য…।’ অজয় বিশ্বাস-রাখী বিশ্বাসরাও আসতেন ‘নিউ ক্যাথে’-তে পরের দিকে।
৪.
কালে কালে মাছে-ভাতে বাঙালি হয়ে গেলে কী হবে, ‘এসপ্ল্যানেড’ শব্দটার মধ্যে বেশ একখানা বিলিতি পরশ আছে। শব্দের উৎপত্তি ধরলে তো নিঃসন্দেহে। এসপ্ল্যানেড বস্তুটি কী? কাহারে এসপ্ল্যানেড কয়? অভিধান বলে, নদী পার্শ্ববর্তী দীর্ঘ রাজপথ। দিলখোলা এক হাওয়া-মোড়। ফিনফিনে বাতাস সহযোগে যা ধরে দুলকি চালে হাঁটা যায়! তা, স্বাধীনতা-উত্তর কলকাতার এসপ্ল্যানেডে আলসেমির উপায় নেই মোটে। বাইকের গোলযোগ, প্রাইভেট বাসের হাঁকডাকের পাল্লায় পড়ে সমস্ত গোল্লায় গিয়েছে। তবু গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে এসপ্ল্যানেড ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না। কেমন গম্বুজওয়ালা বাড়ি। গথিক দালান-খিলান। গ্র্যান্ড হোটেলের লাটসাহেবি। ও চত্বরে আজও গিয়ে দাঁড়ালে, দু’ চোখ বন্ধ করলে, ইংরেজ আমলের ছায়াছবি দিব্য দেখা যায়। ছায়া-ছায়া, কালো-সাদা। হাল্লা গাড়ি। পাগড়ি-পুলিশ। এক্কা-ফিটন। গ্যাসের বাতি। ডাকবাক্স। হ্যাট-কোট। ‘জাগতে রহো…।’ এবং এক বিদ্রোহী রেস্তোঁরা-কাম-বার! নিউ ক্যাথে রেস্তোঁরা অ্যান্ড বার!
আধুনিক নিউ ক্যাথের কাচের কেতাদুরস্ত দরজা দেখে, তার পুরাতন প্রস্তরলিপি আন্দাজ করা বড় শক্ত। রেস্তোঁরা অধুনা চালান যিনি, সেই ধোপদুরস্ত-কেতাদুরস্ত আবিদুর রহমান সাহেবের (এতটাই ফিটফাট যে, ‘সাহেব’ নামক সম্ভ্রম সম্বোধনই সমীচীন) থেকে আড্ডা মারফত শুনলাম যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এ রেস্তোরাঁর দরজায় অত্যন্ত অসম্মানজনক একখানি বোর্ড সাঁটানো থাকত– ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস আর নট অ্যালাওড!’ সে বহু বছর পূর্বের কথা। এসপ্ল্যানেড থেকে লাইটহাউস সিনেমার (এখন উঠে গিয়েছে) রাস্তাকে নাকি তখন বর্ণবাদের বিষুবরেখা দু’ ভাগে চিরে রাখত। রাস্তার বাঁদিক, নেটিভদের। হেঁজিপেজি কালা আদমিদের সেথা যত্রতত্র যাতায়াত। ডানদিকের দখলদাররা আবার ‘ব্লু ব্লাড’। যাহা অভিজাত নীল রক্ত-বৃন্দের। আবিদুর সাহেব সে সময় ছোট। পঁয়তাল্লিশ সালের আশপাশের কথা। সবেমাত্র চিনে মালিকের হাত থেকে রেস্তোরাঁর হস্তান্তর হয়েছে, ‘ক্যাথে’ থেকে নাম ‘নিউ ক্যাথে’ হয়েছে। বাপ-দাদাদের থেকে আবিদুর সাহেব শুনেছিলেন যে, দরজার বোর্ড দেখে গা ঘিনঘিন করলেও তখন কিছু করার ছিল না। বুটের ভয় ছিল, ব্যবসা চৌপাট হয়ে যেতে পারত। কিন্তু একবার মুক্তি সূর্য ওঠার পর, সাতচল্লিশের ১৫ অগাস্টের পর, সর্বাগ্রে সে বোর্ড ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়! অবিকল একদলা থুতুর মতো!
‘ব্লা., আমাদের দেশে থাকছে, আমাদের খাচ্ছে, আবার আমার দেশের মানুষকেই কি না ঢুকতে দেবে না’– রাগে রি-রি করে ওঠে আবিদুর সাহেবের শরীর। আজও। স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পরেও। পাশে উপবিষ্ট কন্যা আমরিন মওকা বুঝে পিতাকে খোঁচান, ‘রেখে দিতে পারতে তো বোর্ডটা। ভাবতে পারছ, আজকের দিনে কত দাম উঠত?’ কন্যার রসিকতা না-বুঝে, ক্ষেপে যান আবিদুর সাহেব। কুপিতভাবে বলে ওঠেন, ‘কী বলছিস তুই! দাম? দাম, মাই ফুট। ও সব জঞ্জাল বিদায় করেছি, বেশ করেছি!’
কলকাতার বার-চরিত নিয়ে লেখার সবচেয়ে বড় ঝঞ্ঝাট হল, এতই বর্ণময় তার ইতিহাস, এতই তার বৈচিত্র্য-বিলাস যে, অর্ধেক সময় সেই বার-বাহাদুরদের খাওয়াদাওয়া, মদিরা-মাহাত্ম্য নিয়ে লেখার অবকাশই পাওয়া যায় না। যৌবন থেকে আমি হুইস্কি নয়, রামের পূজারি। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ওল্ড মঙ্ক ভরসা! তার বাইরেও নানান সময়ে বাকার্ডি-ক্যাপ্টেন মর্গ্যান-মালিবু–দিশি-বিদেশি বিবিধ রাম, তাহাদের বিবিধ দোষ-গুণ চেখে দেখেছি, আজও দেখি। তা সেদিন নিউ ক্যাথের বার মেনু উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে, ‘শর্ট স্টোরি’ বলেও যে এক প্রজাতি রয়েছে (জানা থাকলে এ শর্মার অজ্ঞতা মাফ করবেন) জানতে পারলাম। লেখালেখির ঝকমারি না-থাকলে ‘প্রন চিলি’ কিংবা ‘ফিশ লিভার জিন’ (নিউ ক্যাথের হেরিটেজ ডিশ। পরতায় পোষায় না। কিন্তু এতই চলে যে, দাম বাড়ানোর দুঃসাহসও কেউ দেখান না) নিয়ে ‘শর্ট স্টোরি’-র গল্পখানা সংক্ষেপে জিহ্বা-কোষ দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করতাম নিশ্চিত। কিন্তু ফাটা বাঁশের কপাল নিয়ে কতদূর আর এগোনো সম্ভব? ‘কী করি, কী করি’ ভাবতে-ভাবতে কখন যে মজিদ বাসকর থেকে ভূপেন হাজারিকা গল্পের ডালপালা বেয়ে এসে হাজির হয়েছেন, খেয়াল করিনি। এবং মাঝদুপুরে ‘সুরা’-বর্দি সাজার অপচেষ্টার সেখানেই বেঘোরে মৃত্যু!
আবিদুর সাহেবের সঙ্গে যে ঘুপচি ঘরে (এই বেলা বলে রাখি, নিউ ক্যাথের একখানা খাসা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হল, সিগারেটে সুখটান দিতে দরজার বাইরে বেরোতে হয় না। ভেতরেই ছোট একটা চৌখুপিতে মন দিয়ে ধম্ম-কম্ম করা যায়) বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, শুনলাম সেখানেই ফি সন্ধেয় মজিদ এসে বসতেন! আবিদুর সাহেব নিজেও ফুটবল খেলতেন এককালে। মজিদের সঙ্গে সখ্য জমতে তাই সময় লাগেনি। আট কিংবা নয়ের দশকে নিউ ক্যাথের চিনে খাবারের বেজায় নামডাক হয়েছিল। ‘শরাব’ ছুঁতেন না মজিদ। কিন্তু চিনে খাবার পছন্দ করতেন। ভূপেন হাজারিকা আবার ঢুকতেন রাত আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ। সদলবলে। পেটে তিন-চার পাত্র পড়লে গলা ছেড়ে ধরতেন, ‘মানুষ, মানুষেরই জন্য…।’ অজয় বিশ্বাস-রাখী বিশ্বাসরাও আসতেন ‘নিউ ক্যাথে’-তে পরের দিকে।
‘‘ভূপেনবাবু, মজিদরা নিজেদের মতো থাকতেন। আসল বিড়ম্বনায় পড়তাম, ময়দানে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা পড়লে’’– পুরানো সেই দিনের কথায় ফিরে যান আবিদুর সাহেব। কিছু কিছু শুনছিলাম। কিছু জিনিস দেখছিলাম। নিউ ক্যাথের একতলাটা বড় সুন্দর। দেওয়ালে-দেওয়ালে ছবি। বার কাউন্টারে বসা হ্যাট-কোট পরা সাহেব। হাতে টানা রিক্সা। গঙ্গার ঘাট। কলেজ স্ট্রিটের বইওয়ালা। রীতিমতো আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে আঁকানো সব– সমস্ত তৈলচিত্র। এক মাস রাত জেগে তৈরি করা। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, নিউ ক্যাথের এক তলায় সব আছে, শুধু শীতাতপ যন্ত্র বাদে! শৈত্য-অভিলাষী যাঁরা, তাঁদের জন্য দোতলায় আলাদা ‘ইন্তেজাম’। কিন্তু নিচে বসলে, বছরভর চার ঋতু মদের গেলাসের বন্ধু হবে! যুক্তিখানাও বেড়ে। পানশালা কর্মীরা বললেন যে, এক তলায় এসি বসাতে গেলে দৈত্যাকার উঁচু সিলিং, পেল্লায় পাখা, টিমটিমে আলোর যে পুরাতনী লালিত্য আছে, তার পূর্ণাঙ্গ বারোটা বাজবে। আশি বছরের বার-কাম-রেস্তোঁরার আত্মাই তখন চলে যাবে, পানশালা পড়ে থাকবে শুধু। তাই বাতানুকুল যন্ত্র বাতিল!
জানি না, এ মাগ্যি-গণ্ডার বাজারে এ হেন দুঃসাহস ভারতবর্ষের ক’টা বার-কাম-রেস্তোঁরা দেখাতে পারবে! কিন্তু নিউ ক্যাথে দেখিয়েছে। দেখাচ্ছে। দেখাবে। কী করা যাবে, বনেদিয়ানা যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেশা! অবিশ্যি, ‘সাহস’ শব্দটা নিউ ক্যাথের তন্ত্রীতে, শিরা-উপশিরায়। না হলে সামাজিক পিটপিটানিকে সে এমন সজোর কানমলা কখনও দিতে পারে? মানব-সমাজ যতটা পুরুষশাসিত, মদিরা-সমাজ বোধহয় তার চেয়েও এক কাঠি উপরে! কিন্তু আবিদুর সাহেব ঠিক করে ফেলেছেন, মেরেকেটে আর ক’বছর। তার পর নিউ ক্যাথের দায়ভার পুরোটাই ছেড়ে দেবেন এমবিএ পড়া, উচ্চশিক্ষিত কন্যা আমরিনের হাতে! ইতিমধ্যে আমরিন কাজকর্ম বুঝে নিয়েছেন। প্রথম-প্রথম সুরা-ব্যবসায় পুরুষ-শাসনের ‘তোরণ’ ভাঙতে গিয়ে ঈষৎ অসুবিধেয় পড়তে হয়েছিল। কারণ, একজন মহিলার থেকে নির্দেশ গ্রহণে এখনও লোকের আঁতে লাগে। তবে সে সমস্যা, আজ আর হয় না। বরং বার-কাম-রেস্তোঁরা চালাতে যা-যা জ্ঞানগম্যি দরকার, আমরিন জেনে নিয়েছেন একে একে। পানশালার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ– সমস্ত। পরে গিয়ে যাতে নতুন করে কিছু শিখতে না হয়। বলুন না, অক্ষম শুচিবায়ুগ্রস্ত সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নারী স্বাধীনতার ঝাণ্ডা এর চেয়ে ভালোভাবে ওড়ানো সম্ভব?
‘আপনি শুনছেন, আমার কথা?’– আবিদুর সাহেবের প্রশ্নে চটক ভাঙে। সম্বিৎ ফেরে। শশব্যস্তে বলি, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলুন না।’ বুঝলাম, রেস্তোঁরা ব্যবসায়ী হলেও ময়দানকে বড় ভালোবাসেন ভদ্রলোক। ফুটবল নামক চর্মগোলককে ভালোবাসেন। সহাস্য বলতে চান, এক ফেলে আসা আবছা সময়ের কথা, বড় ম্যাচ পড়লে নিউ ক্যাথেয় বসে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের পারস্পরিক হল্লার কথা। ‘সে এক দিন ছিল বটে। দু’ দলের সমর্থকদের চিৎকারে কাক-পক্ষী বসতে পারত না। মারামারি লেগে যেত প্রায়’ অস্ফুটে বলে চলেন ভদ্রলোক। আনমনে। পাশের লোকের প্রতি দৃক্পাত না করে। একবার বিড়বিড় করে যেন বলতেও শুনলাম, ‘আচ্ছা, মজিদের সঙ্গে ইরানের ওই প্লেয়ারটার নাম কী যেন ছিল? আরে, একসঙ্গে এসেছিল। উঁ… ইয়েস ইয়েস… খাবাজি, খাবাজি! আহা, সেই সময় নিউ ক্যাথে এক টুকরো ময়দান ছিল জানেন, ময়দান!’
আবিদুর সাহেবকে প্রত্যুত্তরে বলতে পারলাম না যে, তাঁর নিউ ক্যাথে রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বার এ প্রপঞ্চময় পৃথিবীতে আজও অনেক কিছু। গড়ের মাঠের ঘ্রাণ। ইতিহাসের ঠাকুমার ঝুলি। ভূপেন হাজারিকার গান। নারীর ‘শক্তিরূপেন সংস্থিতা’-র মঞ্চ। সর্বোপরি, দেশাত্মবোধের তূর্যধ্বনি। পরাধীনতার ‘প’ না-জানা এক অজ্ঞ প্রজন্মকে, যা দেশ-বিদ্যা দেয়। শেখায় প্রকৃত প্রেম, নাম যার দেশপ্রেম।
নাহ্, নিউ ক্যাথে-তে নতুন বোর্ড বসানোর সময় এসেছে। বেরিয়ে আসার আগে, আবিদুর সাহেবকে তার লেখাটাও বলে এলে হত: ‘প্রাউড অ্যান্ড ওনলি প্রাউড ইন্ডিয়ানস আর অ্যালাওড!’
চিত্রগ্রাহক: কৌশিক দত্ত
… পড়ুন বারবেলা-র অন্যান্য পর্ব…
৩. ‘চাংওয়া’-র কেবিনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাসরঘর!
২. মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম ‘আস্তাবল’ ডিউক
১. তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ‘বার’ থেকে ‘রেশন সেন্টার’ হয়ে উঠেছিল ব্রডওয়ে