সৌমিত্রদা বসে আছেন। বললেন আজ কোনও কাজ নেই। মুহূর্তে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল সংবাদ– সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে কোনও কাজ নেই। কোনও কাজ নেই? ভাবা যায় না। বললাম, চলুন বসে না থেকে একটা উদ্দেশ্যহীন, কোনও পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়াতে যাই। উনি কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলেন। মুহূর্তে মনে মনে ঠিক করলাম অন্নপূর্ণার বাড়িতে যাই। অন্নপূর্ণা তামিল গৃহবধূ, শখে ছবি আঁকেন। কিন্তু সেই ছবি একটি বিশেষ ধরনের। চাইনিজ পেইন্টিং।
৮.
কোনওরকম ভণিতা না করে সরাসরি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বলে ফেলাই ভালো যে, আমি এখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখতে বসেছি।
এক একজন বিশাল মাপের মানুষ এমনই হয় যাঁদের সম্পর্কে কোনও কিছু বলতে গেলে, লিখতে গেলে বুক কাঁপে, হাত কাঁপে, ভয় হয়। অথচ সত্যিকারের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কথা বলেছেন আমার সঙ্গে, হাতে হাত ছুঁয়েছি। আমার বাড়িতে এসেছেন, বউয়ের হাতের বানানো চা-ও খেয়েছেন। গোলমাল অন্যখানে! যে মানুষটাকে আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি পুরস্কৃত করছেন, পৃথিবীর শিল্পকলার বাজারে মাস্তান দেশ, ফ্রান্স যখন তাদের সবচেয়ে সেরা পুরস্কার লিজিয়ঁ দ্য’নর দিচ্ছেন, দাদাসাহেব ফালকে, সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি ইত্যাদি শব্দগুলোর মানে যখন শুধু ঘরের দেওয়ালে শোকেসে সাজানো ট্রফি বা মেডেল নয়, তখন ভয় হয় বইকি। সত্যজিৎ রায়ের মতো কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতার সারা জীবনের যত ছবি তার অর্ধেকের বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। তেমনই একজন মানুষ, যাঁকে মনে একটা বিশিষ্ট আসনে বসিয়েছি, তিনি যখন শান্ত, স্মিতহাস্য মুখে বলেন– ‘আপনাকে চিনি তো! দীপাকে দেওয়া আপনার আঁকা ছবিটা আমাদের বাড়ির দেওয়ালে এখনও রয়ে গিয়েছে।’ তখনই মনে হয়, তাঁর সান্নিধ্যে ধন্য আমি। সেকারণেই বারবার মনোসংযোগ হারাচ্ছি, হারাচ্ছি হাতের আর কলমের সচলতা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই আমার। এ লেখা রচনা না, কেবলমাত্র স্মৃতিচারণা।
তখন আমার তরুণ বয়স। আর্ট কলেজে পড়ছি অথবা সেখান থেকে সবেমাত্র বেরিয়ে অচেনা জগতে সন্তর্পণে পা রাখছি। দীর্ঘকালের কলেজ জীবনের নিশ্চিত পরিবেশ থেকে অনিশ্চিত জগতে পা রাখা। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখি, মঞ্চে নাটক। বাণিজ্যিক থিয়েটারে কলকাতায় তখন দুটো নাম সমস্ত বিজ্ঞাপনে আর পোস্টারে সর্বক্ষণ দেখা যেত। যেন জুটি বেঁধে কাজ। মঞ্চ: সুরেশ দত্ত, আলো: তাপস সেন। দু’জনের সঙ্গে আলাপ আমার মূকাভিনয়ের গুরু যোগেশ দত্তের বাড়িতে। যোগেশদার মেজদা সুরেশ দত্ত। তাই পারিবারিকভাবেই এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি করে বেড়াই। সুরেশদার চ্যালা হয়ে মঞ্চসজ্জার কাজে কিংবা পুতুল নাটকের সেটে হাত লাগাই মাঝে মাঝে। ভাঙা বাড়ি, ফাটা দেওয়াল, পাহাড়-পর্বত-গুহা, আকাশ। এই ধরনের ছোটখাটো রং-তুলির কাজ। কাজ না থাকলে শুধু দেখতেই যেতাম। মঞ্চের পরিবেশটা টানত আমাকে।
কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। উত্তর কলকাতার মানিকতলার খালপুলের পাশে এই থিয়েটারটি। অভিনীত হল ‘মল্লিকা’। প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিচালনা, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। মল্লিকা চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাছাড়াও জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, সাধনা রায়চৌধুরী অসাধারণ অভিনয় করেন। সেই জুটি, আলোক সম্পাতে তাপস সেন, মঞ্চ নির্মাণে সুরেশ দত্ত। আট-এর দশকের পর থেকে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে এখানেই আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘নামজীবন’। নাট্যকার ও পরিচালক– সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সেই মঞ্চসজ্জা। সে তো ছুঁয়ে দেখা সেট। একটা ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ি, সামনে রাস্তা-ঘরের উঠান-কলঘর– একটা মাত্র সেট। আলোর সুন্দর ব্যবহারে তারই বিভিন্ন অংশ নির্দিষ্ট করে ভাগে ভাগে নাটকটি অভিনীত হত। মঞ্চ ব্যবহারের এই নতুন পরীক্ষা খুবই প্রশংসা পেয়েছিল। অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র এবং লিলি চক্রবর্তী। কাহিনির গুণ, অভিনয়ের কৃতিত্ব এবং বাস্তব জীবনভাবনায় ‘নামজীবন’ বাংলা রঙ্গমঞ্চে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি মাইলফলক।
১৯৬০-এর দশকে সিনেমায় আচ্ছন্ন ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরের দশকে মাথা জুড়ে থিয়েটার। আর সময়টা ছিল কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পক্ষে ভীষণ অনুকূল। পরে জেনেছি, থিয়েটারের শো-ডেট বাঁচিয়ে তবেই শুটিং শিডিউল ঠিক করতেন সৌমিত্র। তাঁর সঙ্গে যুক্ত টালিগঞ্জ চলচ্চিত্রশিল্পের সব প্রযোজক-পরিচালকের এ ব্যাপারটা জানা ছিল। তাঁরা বুঝতেন, যে থিয়েটারের কাছে একেবারে আত্মসমর্পণ করেছেন তিনি। শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লার শুটিংয়ের সময় সংক্ষেপ করে রাজস্থান থেকে তড়িঘড়ি কলকাতার স্টেজে এসেছিলেন। সে সময়েই দল গড়ে নাটক করার তোড়জোড় করছিলেন সৌমিত্র। অভিনেতৃ সঙ্ঘের নেতৃত্বে চলে আসার পর এই উদ্যোগ আরও জোরদার হয়। আর তখন আমরা পেলাম রবীন্দ্রসদনে ‘রাজকুমার’। বিদেশি নাটকে বাংলা আবেগ মেশানো রূপান্তরে সৌমিত্র হয়ে উঠলেন স্বতন্ত্র। মঞ্চে আসবাবপত্রের আয়োজন, জানালার পর্দা ঠিক করা কিংবা ঘরের একপাশে অর্কিড সাজানো চুলোয় যাক। তাপস সেনের আলো সাজানোর খেলাও আকর্ষণীয় নয়। চরম প্রাপ্তি যেটা, সেটা হল স্বপ্নের দেশের রাজপুত্র। তদারকিতে রক্তমাংসের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখছি সামনাসামনি হাঁ করে। পরে শুনেছি সেই প্রবাদ– তিনি মঞ্চে থাকাকালীন অন্য কারও দিকে তাকায় না কেউ। ভয়ে কোনও দিন কথা বলার সাহস হয়নি। সে অনুভূতি এখনও বুকে করে বয়ে বেড়াচ্ছি।
পুরনো দিনের আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। কন্ট্রিভান্সের শো। আমরা তখন ‘কন্ট্রিভান্স’ নামে দল করে ছবির প্রদর্শনী করি। দলগতভাবে ছবির প্রদর্শনীর নতুন কী রূপ দেওয়া যায়, তার জন্য আমরা প্রতি শো-তে এক একটা নতুন কিছু করছিলাম। সেবার ঠিক করেছিলাম যে, আমরা লোককে ছবি বোঝাব। তাই ছবির পাশাপাশি রেখেছিলাম ছবির ডায়েরি। তাতে থাকবে আমাদের এই ছবির বিষয়, তার টেকনিক, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, কতটুকু পেরেছি না পেরেছি নিজের মতো করে লেখা। সেটা খুব প্রশংসা পেয়েছিল সেবার, দল করার এই এক মজা। সেই প্রদর্শনীতে এসেছিলেন দীপা চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী। দীপা চট্টোপাধ্যায় শুধুমাত্র যে সৌমিত্রর আলোতে আলোকিত ছিলেন তা নয়, ছিলেন তখনকার দিনে নামকরা দারুণ ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার! চিত্রকলা প্রদর্শনীতে খেলোয়াড় মানে তো অবাক হওয়ার ব্যাপার! উনি আমাদের প্রদর্শনীর মন্তব্যের খাতায় অনেক বড় করে একটা লেখা লিখেছিলেন, যেখানে আমার ছবির প্রশংসা আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। মন্তব্যের খাতা খুলে সে লেখা দেখেছি বারবার। সে-ও এক শিহরন।
লক্ষ করেছি, কলকাতার বাইরে আলাপ হলে বাঙালিদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং স্মৃতিতে দীর্ঘদিন থাকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার গুছিয়ে আলাপ পরিচয় হয় বেঙ্গালুরু বসবাসকালে। কে সি দাশ মিষ্টির দোকানের মালিক, শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বীরেন দাসের বাড়িতে। কোনও পেশাগত কারণে নয়, উনি বেঙ্গালুরুতে এসেছিলেন একটি বিশেষ হাসপাতালে ওঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য। বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা বেঙ্গালুরু এলেই বীরেনদার বাড়িতে এসে ওঠেন। এখানেই তনুশ্রীশংকর, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মতো গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কী আশ্চর্য! অল্পদিনের আলাপেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কেমন সৌমিত্রদা বলতে পারছি। একদিন ঘটল ছোট্ট একটি ঘটনা কিন্তু সেটাই হয়তো এই লেখার প্রাণ বলা যায়। একজন বিশেষ ব্যক্তির এক বিশেষ আচরণ। সহজ, সরল, শিশুসুলভ বা ছেলেমানুষি– যাই বলা যাক না কেন, এমন একটি ব্যবহার বা এমন একটি ঘটনা যা দুর্লভ, কল্পনার অতীত।
বীরেনদার বাড়িতে একদিন খুব ঝকঝকে রোদ্দুরের সকাল। সৌমিত্রদা বসে আছেন। বললেন, ‘আজ কোনও কাজ নেই।’ মুহূর্তে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল সংবাদ– সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে কোনও কাজ নেই। কোনও কাজ নেই? ভাবা যায় না। যেন শরতের ঝকঝকে রোদ্দুরের নীল আকাশ বিরাট হয়ে উঠল আরও। ভাবখানা এমন– চলো যাই রোদ মেখে এলোমেলো ঘুরে শ্রান্ত হই নাতিশীতোষ্ণ উদ্যান নগরীর পথে পথে। কাব্বন পার্কের কোনও বিশাল গাছের ছায়ায় গিয়ে বসি বা দাঁড়াই। কিংবা খুব ছোট্ট ছিপ নিয়ে কিছু পুঁটি মাছ ধরি কোনও ডোবা পুকুরে। নয়তো শুয়ে থাকি অকারণে। খাটের যেদিকে মাথা করে শুই সেদিকে নয়, বালিশটা নিই পায়ের দিকে। একটা হাত খাটের বাইরে ঝুলিয়ে খানিকটা আধো ঘুমে শুয়ে থাকি এরকম অলস দুপুরে। যেন এমনই সে কর্মহীন ফাঁকা মুহূর্ত।
বললাম, চলুন বসে না থেকে একটা উদ্দেশ্যহীন, কোনও পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়াতে যাই। উনি কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলেন। মুহূর্তে মনে মনে ঠিক করলাম অন্নপূর্ণার বাড়িতে যাই। অন্নপূর্ণা তামিল গৃহবধূ, শখে ছবি আঁকেন। কিন্তু সেই ছবি একটি বিশেষ ধরনের। চাইনিজ পেইন্টিং। স্বামীর কর্ম সুবাদে আমেরিকা থাকাকালীন অন্নপূর্ণা শিখেছিলেন চাইনিজ পেইন্টিং এবং তার খুঁটিনাটি একদম গুরু ধরে। ওদের ছবি, চাইনিজ খাবারের মতোই আমাদের একটা পছন্দের শিল্প। বিশেষ করে ব্রাশ স্ট্রোক এবং ক্যালিগ্রাফিক ব্রাশচালনা আর মিনিমালিস্টিক রংয়ের ম্যাজিক। অন্নপূর্ণার স্বামী, সীতারাম। উচ্চশিক্ষিত, অসম্ভব ভালো মানুষ। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে দীর্ঘদিন কাজের সুবাদে কলকাতায় কাটিয়েছেন। আর সেই সময় ওঁর একমাত্র বিনোদন, বাংলা সিনেমা দেখা। সবচেয়ে প্রিয় ফিল্ম ডিরেক্টর, সত্যজিৎ রায়। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, সত্যজিৎ রায়ের ছবি মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আমার স্ত্রী মধুমিতাও সঙ্গে ছিল সেদিন। বীরেনদাও যাবেন। সৌমিত্রদাকে নিয়ে চারজনে বেরিয়ে পড়লাম। বীরেনদা নিজেই গাড়ি চালালেন। শিল্পপ্রেমিক হিসেবে ওই পরিবারের সঙ্গে বীরেনদার পরিচয় আগেই আছে। পৌঁছে গেলাম। ছোটখাটো একটা ভাড়াবাড়ি, পরিপাটি করে সাজানো। ঘরে ঢোকাটাই একটা সাংঘাতিক দৃশ্য। কলিং বেল শুনে দরজা খুললেন সীতারাম। খুলেই সামনে দেখলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যিকারের। কল্পনা করতে পারেননি যে, এমন একজন বিরাট মাপের খ্যাতনামা মানুষ, দুষ্প্রাপ্য, মনের মানুষ, যার কি না গ্রেট ফ্যান সীতারাম, সে রকম একজন বেল বাজিয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়ছেন এই ছোট্ট বাড়িতে। এ যে কী মূল্যবান অভিজ্ঞতা সেটা সীতারাম জানেন আর আমি জানি। কারণ, এই খেলাটা সৌমিত্রদাকে না বলেই আমি সাজিয়েছিলাম। কী করবেন, কোথায় বসাবেন– সব গুলিয়ে যাচ্ছিল সীতারামের। হাত থেকে কী একটা যেন পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে, সৌমিত্রদা নিজেই সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পাশের টেবিলে রাখলেন।
ছবি দেখা হল, চাইনিজ তুলি চালনার ম্যাজিক দেখা হল। আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, শিশুর মতো সরল, বড় বড় চোখ করে প্রতিটি ছবির খুঁটিনাটি দেখছিলেন সৌমিত্রদা। আলাদা আলাদা মানুষ কীভাবে আলাদা আলাদা ধরনের ছবি আঁকেন, সেটা দেখার ওর একটা নির্ভেজাল আগ্রহ সেদিন দেখেছিলাম। পরে জেনেছিলাম যে, উনি নিজে ছবি আঁকেন এবং অনেক ছবি এঁকেছেন। সে কথায় পরে আসছি। অদ্ভুতভাবে সীতারামের সঙ্গেও অন্যান্য অনেক বিষয়ে কথা হচ্ছিল এবং কোনও বিষয়েই উনি চুপ করে বসে থাকছিলেন না। সংযতভাবে তার উত্তর দেওয়া বা অংশ নেওয়াতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মানুষটার বিভিন্ন বিষয়ে কত আগ্রহ। ইংরেজিতে সেই কথোপকথনের অনেকটাই মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে সৌমিত্রদার সময়টা নষ্ট হয়নি মনে হল যেমন, তেমনই একজন মহান মানুষের আচরণের মাহাত্ম্য দেখে মাথা নত হয়ে এল।
সৌমিত্রদা এসেছিলেন আমার বাড়িতেও, ছবি দেখতে। আসা তো নয়, সে যেন তাঁর পদধূলিতে ধন্য হলাম আমরা। একটা মজার ব্যাপার হল, দেখলাম তাঁর জনপ্রিয়তার যে চাকচিক্য, যে উজ্জ্বলতা সেটা কিন্তু কোনও কারণেই চাপা দেওয়া যায় না। গাড়ি থেকে উনি যখন নেমে ঘরে ঢুকছিলেন তখন পাশের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে ফেললেন আমার ভাড়াবাড়ির বাড়িওয়ালি। তিনিও বাঙালি। ফোনে ফোনে তাড়াতাড়ি আরও কিছু লোককে খবর দিয়ে দিলেন। যা হওয়ার তাই হল। সবাই ঘরে ঢোকেনি কিন্তু ঘর থেকে বেরনোর সময় তাঁকে দেখার যে ঘটনাটা সেটা চিরকালীন। শুটিংয়ের পরে, মঞ্চ থেকে বেরনোর সময়, সিনেমা হল থেকে বেরনোর মুখে কিংবা বইয়ের দোকানে যেমন ভিড় হয়ে যায় তেমনই ছোট্ট একটা ভিড় জমে গিয়েছিল আমার বাড়ির সামনে সেদিন।
অনেকেই জেনে গেল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বেঙ্গালুরু আছেন। আমাকে তাই চেনাশোনা বন্ধু-বান্ধব, যাঁরা সংস্কৃতিমনস্ক তাঁরা অনুরোধ করল কীভাবে ওঁর সান্নিধ্য পেতে পারি। সৌমিত্রকে বললাম কথাটা, আপনার একটু সময় থাকলে একটা সন্ধে এখানকার বাঙালিদের ক্লাব, বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন খানিকক্ষণের জন্য আসবেন? আমার মুখরক্ষা হল, উনি রাজি হলেন। তড়িঘড়ি যে যাকে পারে ফোনে ফোনে। ভাগ্যিস তখনও মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু হয়নি। সদস্যদের মধ্যে খবর চলে গেল এবং সৌমিত্র দর্শনে ধন্য হতে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। একটা ঘরোয়া পরিবেশের মতো আমরা একসঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছিলাম। সঙ্গে করে কেউ কেউ ‘সঞ্চয়িতা’ আনতে ভোলেনি। সেই সঞ্চয়িতা থেকে পর পর অনেক কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। নিজে তৃপ্ত, আমরাও তৃপ্ত। কেউ গান গাইল, কবিতা পড়ে ওঁকেও শোনানো হল। আমি যেহেতু মূকাভিনয় করতাম তাই একটা ছোট্ট অংশ করে দেখালাম, মেকআপ, কস্টিউম ছাড়া। ওঁর জ্ঞানভাণ্ডারে মধ্যে কী কী আছে, তার কিছু কিছু এভাবেও জানা হয়ে যায় সেটাই অদ্ভুত। উনি আমাকে একটা গল্পের প্লট দিয়ে সেটা মাইমে করা যায় কি না চেষ্টা করতে বললেন। গল্পটা হচ্ছে, একটি মুখোশ বিক্রেতা। তার হাতে ভয়-হাসি-খুশি-বিরক্ত নানা ভঙ্গিমায় সব মুখোশ। যখন যেটা পরছে তখন তেমন মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে যাচ্ছে। একসময় সে একটা হাসির মুখোশ পরল। এবার মুখোশ পাল্টানোর সময় বিপত্তি। হাসির মুখোশটা মুখ থেকে খুলতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করল, কিছুতেই খুলতে পারছে না। মুখোশটা অদ্ভুতভাবে আটকে গিয়েছে মুখের সঙ্গে। চেষ্টা, শেষে ভীষণ ভয়। সারা শরীরে ভয় আর মুখের অভিব্যক্তিতে হাসি। এইটা উনি আমাকে করে দেখাতে বললেন। এখানে আমি ধরে ফেললাম যে, এই গল্পটা উনি নিজে রচনা করেননি। কিন্তু বোঝা গেল তিনি দেশ-বিদেশের নানা শিল্পীর কাজের বিভিন্ন ধরনের খবরও রাখেন। এটা আসলে পৃথিবী বিখ্যাত মূকাভিনেতা, ফ্রান্সের মার্সেল মার্শোর খুবই জনপ্রিয় একটি কম্পোজিশন। এখানে পরিষ্কার বোঝা গেল, উনি বিশেষ করে মঞ্চে অভিনয় করার সময় যে শারীরিক অভিনয় করেন, শরীরের কন্ট্রোল এবং শরীরের সঞ্চালনা বজায় রাখার যে অভ্যেস সেটা কোত্থেকে আসে।
অনেকটা সময়ের ব্যবধানে এখন আমার বাসস্থান মুম্বইতে সৌমিত্রদার সঙ্গে দেখা হয়েছে বারকয়েক। থানের কাশীনাথ ঘেনেকার হলে দেখেছিলাম ‘ফেরা’। কন্যা, পৌলোমী, দেবশঙ্কর এবং সৌমিত্রদার সঙ্গে অনুষ্ঠানের পরে দেখা হয়েছে। দেখেছি ‘নীলকণ্ঠ’ আর ‘কিং লিয়ার’। দুটো নাটকেই তাঁর শরীরের ভাষা, দক্ষতা এবং এই বয়সেও শরীরকে নিজের বশে রাখার ক্ষমতা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছি। রঙ্গ সারদা অডিটোরিয়ামে ওঁর আরেকটা ম্যাজিক দেখলাম। ‘কিং লিয়ার’ নাটকের মঞ্চসজ্জায় সেই কাঠের স্ট্রাকচারের মধ্যে শরীরের ভারসাম্য রেখে যেভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তার তুলনা হয় না। আর সেই সঙ্গে স্থিরবস্তু এবং চঞ্চলতা মিলিয়ে যে দৃশ্য তৈরি হয়েছিল, তা জীবনেও ভুলব না।
রবীন্দ্র নাট্যমন্দিরে আর একটি অভিনব প্রযোজনা দেখেছিলাম। সেটার শিরোনাম ‘ফেলুদা’, অর্থাৎ ফেলুদা চরিত্রে এ যাবৎ যাঁরা যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁরা মঞ্চে। তাছাড়াও তোপসে ও কিছু প্রধান পার্শ্ব-চরিত্রের অভিনেতা মঞ্চে ছিলেন সেদিন। সুপরিকল্পিত আলোচনা আর কথোপকথনের অনুষ্ঠান। সঞ্চালনা করেছিলেন আমাদের আর একজন প্রিয় সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শংকরলাল ভট্টাচার্য এবং তার স্ত্রী, দূরদর্শনের সংবাদ পাঠিকা ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানের পরে সেদিনও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল রবীন্দ্র নাট্যমন্দিরের উঠোনে দাঁড়িয়ে। মুম্বইয়ে যতবার দেখা হয়েছে তাঁর চেহারার আকর্ষণ কিছু কম দেখিনি। অল্প সময়ের জন্য হলেও কথা বা আলাপের মধ্যে তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হইনি কোনও দিন।
ওঁর জীবনের সায়াহ্নে আমার শেষ সৌমিত্র দর্শন এবং সান্নিধ্য ভুলব না। সে পরম সৌভাগ্যের। শেষ সাক্ষাৎ যে কত মূল্যবান, তা বোঝানোর ভাষা নেই। আমার ৬০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষ করে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম কলকাতায়। আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে। শুরুর দিনে গুরু স্থানীয় শিল্পীদের এবং অনেক গুণী ব্যক্তির তো পেয়েই ছিলাম সে প্রদর্শনীতে, সবচেয়ে বড় পাওনা সৌমিত্রদার সপরিবার উপস্থিতি। পৌলমী আমাদের, ছবি আঁকিয়েদের বন্ধু। ও বাবা, মা, দাদাকে রাজি করায়। অতএব দীপাদি, সৌগত সমেত পুরো সংসার শুদ্ধ সৌমিত্রদা এসেছিলেন সেদিন। প্রদর্শনী শুরুর পরে আমরা জড়ো হয়েছিলাম পাশে স্যাটারডে ক্লাবে। অনেক রাত অবধি আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম। প্রাজ্ঞ, পরিণত, কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেদিনের সান্ধ্য আড্ডায় পেয়েছিলাম অনেক ভালো মানুষদের। ছিলেন চিত্রশিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদি
পরের বছর ২০১৪ সালে ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আর এখন চমক। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, পদ্য-গদ্য-প্রবন্ধ, কবিতা, পত্রিকা, নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে ‘এক্ষণ’, আবৃত্তি-ভাষ্যপাঠ-শ্রুতিনাটক-প্রযোজনা-রেডিও নাটক। তাঁর মনের মণিকোঠার নাটক-রচনা-মঞ্চ-নাট্যরূপ-রূপান্তর-পরিচালনা। এ সমস্ত ছাপিয়েও সবাইকে অবাক করে তার শেষ বিস্ময়, চিত্রকলার একক প্রদর্শনী। প্রথম একক প্রদর্শনীটি কলকাতায় আইসিসিআর-এর অবনীন্দ্র গ্যালারিতে। কিউরেটর জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের কথায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছবি আঁকতেন ডায়েরির পাতায়। উনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন এবং তাতেই ছবিও আঁকতেন। মূলত জলরং ব্যবহার করতেন আর পেন অ্যান্ড ইঙ্ক। কাগজেই আঁকতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন।
জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের আর একটি বিশেষ আয়োজন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ৮০ বছরের জন্মদিনে বিভিন্ন শিল্পীর ছবির প্রদর্শনী। সৌমিত্রদার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা না হলেও আমার শেষ যোগাযোগ এবং শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ হয়েছিল কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সেই প্রদর্শনীতে অংশ নিতে পেরে। যেতে পারিনি। মুম্বই থেকে ওঁর প্রতিকৃতি এঁকে পাঠিয়েছিলাম, তিনি সেটা খুঁটিয়ে দেখেছিলেন এবং খুশি হয়েছিলেন। এ আমার পরম আনন্দ। আমার অন্তরের অন্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৬: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৫: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল