রিহার্সালে, পি. এল. রাজ দেখলেন, ঢ্যাঙা ঠ্যাং দুটো ছন্দে ফেলতে হিমশিম নবাগত বচ্চন। পরদিন সকালে শুট, ‘দেখা না হায় রে, সোচা না হায় রে…’; অথচ, স্টেপস তুলতে পারছেন না নায়ক! কী করলেন পি. এল. রাজ? পায়ে বেত মেরে মেরে, প্র্যাকটিস করাতে শুরু করলেন। আপনি যত বড় ফ্যানই হন না কেন, নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্নেও দাবি করবেন না, অমিতাভ বচ্চন নাচতে পারেন।
আপনি যত বড় ফ্যানই হন না কেন, নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্নেও দাবি করবেন না, অমিতাভ বচ্চন নাচতে পারেন। এদিকে, খাওয়ার পাতে আলু আর মেনস্ট্রিম সিনেমায় নাচাগানা– দুটোই এ দেশের প্রাণ। মেহেমুদের ছেলে আনোয়ার আলির সঙ্গে অমিতাভের বন্ধুত্ব তখন থেকে, যখন তিনি বম্বেতে স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরছেন। ছেলের বন্ধুকে ভালোবাসতেন মেহেমুদ, নাম রেখেছিলেন ‘ডেঞ্জার ডায়াবলিক’ (এর অর্থ কী, তা একমাত্র তিনিই জানতেন)। মেহেমুদ তাঁকে পাঠালেন ‘বম্বে টু গোয়া’-র অডিশনে। কাজটা পেয়ে গেলেন স্ট্রাগলার অমিতাভ। মুশকিলে পড়লেন, যখন জানতে পারলেন এই চরিত্রে ধুমধাড়াক্কা নাচতেও হবে, তাও অরুণা ইরানীর সঙ্গে!
‘বম্বে টু গোয়া’-র কোরিওগ্রাফার, পি. এল. রাজ। সে যুগে, তাঁদের বলা হত ‘ড্যান্স মাস্টার’; অনেককেই সম্বোধন করা হত ‘গুরুজী’ বলে। বড় বড় অ্যাক্টর বা স্টার, সেটে ঢুকে, তাঁদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেন। রিহার্সালে, পি. এল. রাজ দেখলেন, ঢ্যাঙা ঠ্যাং দুটো ছন্দে ফেলতে হিমশিম নবাগত বচ্চন। পরদিন সকালে শুট, ‘দেখা না হায় রে, সোচা না হায় রে…’; অথচ, স্টেপস তুলতে পারছেন না নায়ক! কী করলেন পি. এল. রাজ? পায়ে বেত মেরে মেরে, প্র্যাকটিস করাতে শুরু করলেন। হাঁটু কেটে রক্ত গড়াল, রুমাল বেঁধে ঘা লুকিয়ে রাখলেন অমিতাভ। ভয়ে কাউকে কিছু জানালেন না, পাছে কাজটা হাত থেকে চলে যায়।
রাত্তিরে জ্বরই এসে গেল তাঁর। খোঁজ নিতে এসে মেহেমুদ দেখলেন, অমিতাভ কাঁদছেন, ‘মুঝ সে নেহি হোগা…’। সান্ত্বনা দিলেন মেহেমুদ, ‘যে হাঁটতে পারে, সে নাচতেও পারে।’ পরদিন, একটু বুদ্ধি খাটালেন তিনি। পি. এল. রাজকে বললেন, ‘বকাঝকা না করে, ছেলেটার প্রশংসা করুন… যেমনই নাচুক, হাততালি দিন…’ ফার্স্ট শটে অমিতাভ যা নাচলেন, সে আর কহতব্য নয়। তবু, গোটা ইউনিট ফটাফট হাততালি দিল। সেকেন্ড শট, থার্ড শট… উফ! হাততালি, হাততালি… একটু-একটু করে, বাড়তে থাকল তাঁর আত্মবিশ্বাস। ধীরে ধীরে, ‘ওকে’ হতে থাকল শট। হ্যাঁ, রিটেক করা হল আগের ‘এনজি’-গুলো।
আরও পড়ুন: মেনস্ট্রিম হিরোদের ঘায়েল করেছিল শাকিলার ঢেউ
‘যো জিতা ওহি সিকন্দর’-এর কাল্ট গান, ‘পেহেলা নশা…’। পরিচালক মনসুর খান ভাবলেন, গানটা পিকচারাইজ করবেন স্লো মোশনে; কিন্তু, কথায় ঠোঁট পড়বে নিখুঁত। কীভাবে হবে? শুটিংয়ে অ্যাক্টররা পারফর্ম করবেন স্বাভাবিক ছন্দে; যদিও, গানে লিপ দেবেন দ্বিগুণ গতিতে। পরে, এডিটে যখন ছবিটা স্লো করা হবে, তখন লিপ মিলবে পারফেক্ট। এর আগে, একই টেকনিক কাজে লাগিয়েছিলেন প্রভুদেবার বাবা, মুগুর সুন্দর; মণি রত্নমের ‘গীতাঞ্জলী’-তে। নবাগতা গিরিজা শেট্টারকে ওইভাবে নাচিয়েছিলেন তিনি।
এ দুটো নাচের অনেক আগে, ১৯৭১-এ, পি. এল. রাজ ট্রাই করেছিলেন এই টেকনিক। সিনেমা, ‘লাখোঁ মে এক’। ড্রিম সিকোয়েন্সের গান, ‘যোগী ও যোগী…’। ছবিটা স্লো মোশন করার জন্য, শুটিংয়ের সময়ে, গান চালানো হল খুব স্পিডে। লিপ মেলালেন মেহেমুদ আর রাধা সালুজা। পরে, মেহেমুদ বলেছিলেন, অত দ্রুত ঠোঁট নাড়তে গিয়ে, ঘেমে-নেয়ে, ঘাবড়ে জ্বর এসে গেছিল রাধার।
আরেক হার্টথ্রব, দেব আনন্দ। প্লিজ, আবার কেউ দাবি করবেন না, তিনি নাচতে পারতেন। হাড়ে হাড়ে তাঁকে চিনতেন তাঁরই ‘গাইড’, ছোটো ভাই, বিজয় আনন্দ। বলতেন, ‘দেব আনন্দের জন্য গান বানালে, প্রথমেই মনে রাখবেন ইউ কান্ট মেক হিম ড্যান্স।’ দেব আনন্দ নিজেও স্বীকার করতেন নিজের খামতি; স্পষ্টই বলতেন, ‘নেহি ইয়ার, ডোন্ট মেক মি ড্যান্স!’ ধরুন, ‘কালা বাজার’। সুপারহিট গান, ‘খোয়া খোয়া চান্দ…’। সিকোয়েন্সটায়, প্রেমে হাবুডুবু নায়ক। দেব আনন্দ কী করলেন? আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে, টলমল পায়ে নামতে থাকলেন, দু’হাত পেন্ডুলামের মতো দোলাতে দোলাতে। বাজি ধরে বলা যায়, অন্য কেউ এই কাজ করলে, আপনি হেসে গড়াগড়ি দেবেন। কিন্তু, ম্যাজিকের নাম দেব আনন্দ। ঠিকই বলতেন বিজয়, ‘মাঝেমাঝে ওঁকে ওঁর মতো ছেড়ে দিতে হয়, কখন কী করে ফেলবেন কেউ জানে না।’
এহেন দেব আনন্দ গাড্ডায় পড়লেন ‘জুয়েল থিফ’-এ। গান, ‘রাত আকেলি হ্যায়…’। ওই দৃশ্যে, নায়কের সঙ্গে ছলাকলা করছে তনুজার চরিত্র। অতএব, নাচের সিংহভাগ খাটনিটা তনুজারই। কিন্তু, কোরিওগ্রাফার সোহনলাল চাইলেন, দেব আনন্দকেও কিছু বেসিক স্টেপস করতে হবে। যথেষ্ট চেষ্টাচরিত্র করেও, হালে পানি পেলেন না তিনি ও নায়ক। ডিরেক্টর বিজয় সমেত সকলে যখন ভাবছেন সিনটা অন্য কোনওভাবে দেখানো যায় কি না, তনুজা একটা আইডিয়া দিলেন। বললেন, ‘নাচটা যদি শুধু আমিই করি, আর দেব আনন্দ জাস্ট সঙ্গে থাকবেন, ক্যামেরায় লুক দেবেন– তাহলে কেমন হয়?’ আবার সকলে আলোচনায় বসলেন। সোহনলাল তনুজাকেই বললেন দেব আনন্দকে একটু হেল্প করতে। তনুজার ইচ্ছা-মতোই গানটাকে কোরিওগ্রাফ করা হল। শেষমেশ, দেব আনন্দ পর্দায় যেটা করলেন, সেটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন: লকআপে বসে স্টোরিটেলিংয়ের জোরে পুলিশকে বন্ধু বানিয়েছিলেন রাম গোপাল বর্মা
উটিতে শুটিং, ‘ফর্জ’-এর। গান, ‘মস্ত বাহারোঁ কা ম্যাঁয় আশিক…’। ডিরেক্টর রবিকান্ত নাগাইচ সিকোয়েন্সের ব্রিফ দিলেন অরুণা ইরানীকে। বললেন, ‘ওয়েস্টার্ন স্টাইলের প্রচুর মুভমেন্ট আছে, ভীষণ এনার্জি দরকার…।’ পোক্ত নর্তকী অরুণার কনফিডেন্সে কমতি নেই; কিন্তু, তিনি একটু সন্দিহান নায়ক জিতেন্দ্রকে নিয়ে। এর আগে কোথাও নাচতে দেখা যায়নি তাঁকে। ওদিকে, যে মুহূর্তে ডিরেক্টর হাঁকলেন, ‘রোল ক্যামেরা, স্টার্ট মিউজিক…’, হাঁ হয়ে গেলেন নায়িকা। এমন সাংঘাতিক নৈপুণ্যে কোনও ভারতীয় নায়ক নাচবেন, এ তিনি কল্পনাও করেননি।
আসলে, প্রত্যেকটা স্টেপ পাখি-পড়া করে জিতেন্দ্রকে শিখিয়েছিলেন হিরালাল। জিতেন্দ্র নিজেই বলতেন, ‘আমি টোটাল তোতাপাখি, কেউ কিছু দেখিয়ে দিলেই কপি করতে পারি।’ এক-একটা গান শুটের আগে, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে, দিনরাত মহড়া দিতেন তিনি। ‘ফর্জ’ সুপারহিট হওয়ার পরই, ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর ডাকনাম হয়েছিল, ‘জাম্পিং জ্যাক জিতু’।
হিন্দি সিনেমায়, প্রথমদিকে, নাচ হত মূলত দু’রকম– ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল ফর্ম (প্রধানত, ভারতনাট্যম ও কত্থক) আর ওয়েস্টার্ন ফর্ম। এই দুটোকে মিশিয়ে, ভারতীয় দর্শকের কাছে, প্রথম নিয়ে এলেন জোহরা সেহগাল। আমরা ওয়াহিদাকে পেলাম ‘কহিঁ পে নিগাহেঁ কহিঁ পে নিশানা…’-তে, বা মিনু মমতাজকে দেখলাম ‘বুঝ মেরা ক্যা গাঁও রে…’-তে।
অনেকের ধারণা, ‘মুঘল-এ-আজম’-এ নৃত্য নির্দেশনার জন্য, লচ্ছু মহারাজের প্রায় হাতে-পায়ে ধরেছিলেন পরিচালক কে. আসিফ। কারণ, কত্থকের প্রভু লচ্ছু মহারাজ নাকি নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন সিনেমা-জগত থেকে। বাস্তবে, ভারতীয় সিনেমার আদিযুগ থেকেই, সংগীতে ও নৃত্যে, বহু অবদান রেখেছেন ধ্রুপদী পণ্ডিতেরা। লচ্ছু মহারাজও, চারের দশক থেকেই, কাজ করেছেন অনেক সিনেমায়।
অমিতাভ তাঁর সিগনেচার স্টেপস কোথা থেকে পেলেন? ভগবান দাদা-র আইকনিক নাচ, ‘ভোলি সুরত দিল কে খোটে…’ থেকে। কোরিওগ্রাফার, সূর্য কুমার। দুই অনাথ ভাই, সূর্য কুমার আর কৃষ্ণ কুমারকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনের দশকের নৃত্য-সম্রাজ্ঞী আজুরি। দুই ভাই একসঙ্গে কোরিওগ্রাফি করতেন। ‘আওয়ারা’-র কাজ চলাকালীন, খুন হন কৃষ্ণ। তারপর থেকে, বাকি জীবন, একাই সামলেছেন সূর্য।
বলিউডের খানদান বলতে শুধু কাপুর, মুখার্জী আর বচ্চনদের ভাববেন না। যদুগিরি দেবী, জয়পুর ঘরানার কত্থকে পারদর্শী দুই ভাই, সোহনলাল আর হিরালালকে কর্ণাটক থেকে বম্বেতে এনেছিলেন, মেয়ে বৈজয়ন্তীমালাকে ‘নর্থ ইন্ডিয়ান ড্যান্স’ শেখাতে। ওঁদেরই আরও দুই ভাই, চিন্নিলাল ও রাধেশ্যাম। স্বর্ণযুগের সিনেমার নৃত্যশৈলী এই চারজনের কাছে চিরঋণী। ভাবছেন, খামোখা ‘খানদান’ বলছি কেন? ‘কাজরা রে…’-র কোরিওগ্রাফার, বৈভবী মার্চেন্ট, হিরালালের নাতনি। আত্মীয়তা-সূত্রে, এঁদের সঙ্গে বাঁধা, ‘জুম্মা চুম্মা দে দে…’-র চিন্নি প্রকাশও।