Robbar

রাঢ়ের কবিগানের পালায় হিঁদু হলেন চাঁদ মুহম্মদ, কাশীনাথ মুসলিম

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 26, 2025 8:58 pm
  • Updated:December 26, 2025 8:58 pm  

দুই ধর্মের মিলিত লোকায়ত সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে দুই ধর্মের লোকমানব। যেমন কাটোয়া থানার বেড়া গ্রামের শাক্ত-সাধক রামানন্দের সঙ্গে দাঁইহাটের বদর পিরের সখ্য। বীরভূমের সুপুর গ্রামের আনন্দচাঁদের সঙ্গে শাহাপিরের মোহাব্বতের কিস্যা। কিংবা কালিকাপুরের কমলিপিরের সঙ্গে বৈষ্ণব সাধকের দোস্তির কথকতা অফুরান। হিন্দু-মুসলমানের লোকায়ত আঙিনায় এখনও ভেসে ওঠে মঙ্গলকোটের পিলশোঁয়া গ্রামের আউলচাঁদের সঙ্গে হরশহিদ পিরের দোস্তির কাহিনি। আউলচাঁদ বাঘের পিঠে চেপে চলেছেন। আর হরশহিদ আসছেন ভাঙা পাঁচিলে চেপে দোস্তের সঙ্গে দেখা করতে।

স্বপনকুমার ঠাকুর

১৫.

শহর কিংবা মফস্‌সল। চায়ের দোকানে জমাটি আড্ডা। দশের কথা। দেশের কথা। ময়দানের ২২ গজের যুদ্ধ। সোশাল মিডিয়ায় রিলসের যৌনতা। রাজনীতির রঙ-পাঁচালি। তার সঙ্গে দু’-চারটে পক্ষ-প্রতিপক্ষের মন্তব্যের ঝাঁজালো লঙ্কা-ফোড়ন: শাসনের নামে শোষণ। দান-খয়রাতি। চোর-জোচ্চরদের সাড়ে বত্রিশ ভাজার চৌরপঞ্চাশিকা। ছ্যা! আরও আছে। লেলিয়ে দেওয়া লেলিহান আগুনের সমস্যা হিন্দু-মুসলমান। এ নিয়েই তো আসমুদ্রহিমাচল ভোটব্যাঙ্কের যত ডেবিট-ক্রেডিট।

অথচ এই তো ক’ বছর আগেকার ঘটনা। দুর্গাপুজো উপলক্ষে গ্রামে বসেছে কবিগানের আসর। চাঁদ মুহম্মদ আর কাশীনাথ দেবনাথ। রাঢ়বঙ্গের দুই বিখ্যাত কবিয়াল। পালার বিষয় হিন্দু-মুসলমান। দুই ধর্মের অগুনতি শ্রোতা। শ্রোতারাই পালা নির্বাচন করে দিলেন। তবে শর্ত হল, হিঁদু হবেন চাঁদ মুহম্মদ। মুসলমান কাশীনাথ।

রাঢ় বাংলার কবিগান

যেমন পালা তেমনি উপস্থাপনা। কেচ্ছা-কথকথা-গান-পাঁচালিতে প্রতিপক্ষের যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে পালা জমে ক্ষীর। শেষে দুই পালাকার সমবেত গাইলেন–

‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।’

উভয় ধর্মের শ্রোতারা ধন্য ধন্য করে উঠলেন।

গ্রামেগঞ্জে ক্ষেত্রচারণা করলে এই মিলনের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নিত্য যাপনে, সংস্কৃতিতে, জীবনের সমস্যায় দুই ধর্মের লোক একে অপরের পরিপূরক। গাঁ-গঞ্জের খেটে-খাওয়া মানুষের দল। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার। দিন এনে দিন খায়। কিন্তু আনন্দে কমতি কীসের? মাদারপিরের উৎসবে মুসলিমদের মতো চাঁড়াল পাড়ার মেয়েমরদরা কুলের আঙারে হাঁটে। কলার ছড়া আর রুমাল মানত করে। সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে দুই ধর্মের প্রান্তিক মানুষ– মিলন হবে কত দিনে!

কেন মিলবে না? একই তাদের জীবন-সংগ্রাম। চাওয়া-পাওয়া। না-পাওয়ার হতাশা, বঞ্চনা, শোষণের শিকার– একই রকমের জীবনভাষ্য। পাশাপাশি বাস করছেন চোদ্দপুরুষ ধরে। কোনও ভেদবুদ্ধির ইবলিশ তাই তাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।

মাঝেমাঝে বিভেদের কালিমা মাখাবার চেষ্টা করেছে তথাকথিত কিছু ধর্মবাজ। কুলোর বাতাস দিয়েছে সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকরাই। পরক্ষণেই ভুল বুঝতে পেরে শুধরে নিয়েছেন সাধারণ মানুষ। একে অপরকে বলেছেন, হুঁশিয়ার! বহুত হুঁশিয়ার!

ছবিটি প্রতীকী। সূত্র: ইন্টারনেট

অধিকাংশ গ্রামেই হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করেন। অনেক গ্রামে হিন্দুপাড়া থেকে মুসলমানপাড়া বিচ্ছিন্ন। অনেক গ্রামে আবার হিন্দু-মুসলমান একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি। বিপদে-আপদে পরস্পর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাড়িতে আগুন লাগলে কিংবা বানের সময়– মিলনের এই ছবিটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

দু’টি বিপরীত ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষের এই সহজধর্ম। রবীন্দ্রনাথ এই কথাটাই ‘কালান্তর’ গ্রন্থে ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে বলেছিলেন– ‘যদি আমরা পাশাপাশি চলি, কাছাকাছি আসি, তা হলেই দেখতে পাব, মানুষ বলেই মানুষকে আপন বলে মনে করা সহজ। যাদের সঙ্গে মেলামেশা নেই তাদের সম্বন্ধেই মত প্রভৃতির অনৈক্য অত্যন্ত কড়া হয়ে ওঠে, বড়ো হয়ে দেখা দেয়। যখনই পরস্পরের কাছাকাছি আনাগোনার চর্চা হতে থাকে তখনই মত পিছিয়ে পড়ে, মানুষ সামনে এগিয়ে আসে।’

কাটোয়া অঞ্চলেই রয়েছে শতাধিক পিরের আস্তানা। খাদিম মুসলমান। ভক্ত হিন্দুরা। ঢাকঢোল বাজিয়ে সিন্নি দিয়ে আসে ফি-মাসে। মঙ্গলকোটের বুঁইচি গ্রামের গ্রাম্যদেবতা সান্ন্যাদান পির। অজস্র গ্রামবাসী চৈত্রমাসে পিরতলায় সিন্নি দিয়ে আসেন। লাল-কালো ঘোরা মানত করেন।

পটচিত্রে গাজি পিরের ছবি

চৈত্রমাস এলে হিন্দুরা বাড়ির সদর দুয়ারে গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে রাখেন। মাঝরাতে ঘোড়ায় চেপে পিরসাহেব বেরবেন গ্রাম প্রদক্ষিণে। এমনই তাঁদের লোকবিশ্বাস। গাজিপুরে কেউ পাকাবাড়ি বানালে আগে পিরতলায় ছোট্ট এক মন্দিরের মতো করে দিয়ে আসেন। এই তো সোনার বাংলা।

পিরের মাজার মানেই মাটির ঘোড়ার আড়ত। মানতকরা যুগ-যুগান্তরের ছলন। কাটোয়ার বারান্দা গ্রামে গ্রামবাসীরা লালপতাকা পুঁতে দেন পিরতলায়। কোশিগ্রামে ওমেদ ফকিরের নামে গ্রাম ষোলআনা পৌষমাসে বনভোজন করেন মাঠে। ওমেদ ফকির নাকি কলেরা রোগ থেকে হিন্দু গ্রামবাসীদের বাঁচিয়েছিলেন সেরেফ তেঁতুল গোলার পানি পিইয়ে। মঙ্গলকোটের সাঁড়ি গ্রামে ওমেদ ফকিরের উদ্দেশ্যে হরিনাম সংকীর্তন করা হয়। সংস্কৃতির রঙিন রূপান্তর।

আবার গাঁয়ে বিপদ-আপদ হলে, জল-থল না পড়লে পিরতলায় পুজো দিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা। কোনও সন্দেহ নেই– পিরের মাজারই মিলিয়েছে গ্রামের রাম-রহিম আর রেবা-রাবেয়াদের। চৈত্রমাসের প্রতি বৃহস্পতিবারেই পিরের মেলা। সিন্নির প্রসাদ। ফকিরি গান, ইসলামি সংগীতের জলসা, সত্যপিরের গান। শ্রোতা হিন্দু-মুসলমান উভয়েই।

মাজারে ফকিরদের গানবাজনা

দুই ধর্মের মিলিত লোকায়ত সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে দুই ধর্মের লোকমানব। যেমন কাটোয়া থানার বেড়া গ্রামের শাক্ত-সাধক রামানন্দের সঙ্গে দাঁইহাটের বদর পিরের সখ্য। বীরভূমের সুপুর গ্রামের আনন্দচাঁদের সঙ্গে শাহাপিরের মোহাব্বতের কিস্যা। কিংবা কালিকাপুরের কমলিপিরের সঙ্গে বৈষ্ণব সাধকের দোস্তির কথকতা অফুরান। হিন্দু-মুসলমানের লোকায়ত আঙিনায় এখনও ভেসে ওঠে মঙ্গলকোটের পিলশোঁয়া গ্রামের আউলচাঁদের সঙ্গে হরশহিদ পিরের দোস্তির কাহিনি। আউলচাঁদ বাঘের পিঠে চেপে চলেছেন। আর হরশহিদ আসছেন ভাঙা পাঁচিলে চেপে দোস্তের সঙ্গে দেখা করতে।

বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখণ্ডে বাবা ভূতনাথের মন্দিরের খানিকটা দূরে একদিল পিরের আস্তানা। মাঝবরাবর রাস্তায় ঘরবাড়ি করা দুই ধর্মের নিষিদ্ধ। কারণ দুই দোস্তের যাওয়া-আসায় না কি অসুবিধা হবে। এমনই বিশ্বাস গ্রামবাসীদের। মুসলমানরা হিন্দুদের কাঁচাদেবতা মানে মনসাকেই সব চেয়ে বেশি মানেন। কাঁকোড়াগ্রামে কর্কটনাগের পুজো বিখ্যাত। মুসলমানরাও কর্কট নাগের পুজো দেয়।

কালনা থানার উদয়পুর গ্রাম। এখানকার বেহুলার ঝাঁপান বিখ্যাত। কিংবদন্তি আছে বেহুলা মৃত-পতি লখিন্দরকে ভেলায় করে নদীপথে আসছিলেন। এই উদয়পুরে তিনি উদিত হন। প্রথমে এক সুন্দরী নারীর বেশে মুসলমান বাড়িতে ওঠেন বেহুলা। পরে তিনি পাষাণ হয়ে যান। এখন ঝাঁপানের দিনে সেই মুসলমান বংশধর কাংরু শেখের পুজো হয় সর্বাগ্রে।

শ্রীখণ্ডের ভূতনাথ মন্দির

মেমারি থানার মণ্ডলগ্রামে জগৎগৌরীর পুজোর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নিকটবর্তী বামুনিয়া গ্রামে মুনীরাজের সঙ্গে দেবীর অসমাপ্ত বিয়ে। দেবীর ফিরে যাওয়ার সময় বামুনিয়া গ্রামের মুসলমানরাও দেবীর পুজো দেন। ভাতার থানার মাহাতা গ্রামের অন্যতম জাগ্রতা দেবী ‘বড়দুয়ারী’ নামে ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো। আরতি হয় না। দেবীমূর্তিও ব্যতিক্রমী। কার্তিক-গণেশ নেই। লক্ষ্মী-সরস্বতীর বদলে জয়া-বিজয়া। মুসলমানরাও এই দেবীর কাছে মানত করেন। মানতের পাঁঠা ছেড়ে দিয়ে যান।

ক্ষীরগ্রামে মুসলমান বসবাস নিষিদ্ধ হলেও যবগ্রাম, কারুলে, বামুন্ডি, শীতলগ্রাম, কুরুম্বা প্রভৃতি গ্রামের মুসলমানদের কাছে দেবী যোগাদ্যা ‘জলেরমা’। তাঁরাও দেবীর কাছে মানত করেন। আর পাঁঠা ছেড়ে দিয়ে যান যোগাদ্যাতলায়। ভাতার থানার কয়রাপুরের দেবী ত্রৈলোক্যতারিণী আবার মুসলমান পাড়ায় পুজো নিতে যান। সেখানে রয়েছে দেবীর সইয়ের বংশধর। বর্ধমানের এই ছবি অল্পবিস্তর সারা বাংলাতেই ক্রমবর্ধমান।

হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করার ফলে একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। হিন্দুদের মতোই মুসলমানরাও নবান, দাওন প্রভৃতি কৃষি উৎসবে মেতে ওঠেন নিজেদের মতো করে। তাছাড়া অম্বুবাচি, অমাবস্যা-পূর্ণিমায় হাল-লাঙল পালে। অনেক গ্রামের মসজিদের মৌলভিসাহেব হিন্দুর ছেলেদের ঝাড়ফোঁক করেন, পানিপড়া দেন। অনেকে আবার জিন বা ভূত তাড়াতে আসেন। হিন্দুদের মেলাখেলাতে মুসলমানরা সব চেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করে।

কয়রাপুরের দেবী ত্রৈলোক্যতারিণী

দধিয়া বৈরাগ্যতলার পাশে হিন্দু-মুসলমানের গ্রাম এহিয়াপুর। মুসলমান পাড়ার মধ্যে আসে ঐতিহ্যবাহী কালীপুজো। গ্রামের শিক্ষক সুশান্তকুমার ব্যানার্জি শোনালেন আর এক আখ্যান। গ্রামের জমিদার ছিলেন আমজাদ আলি। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন রঘুনাথ উপাসক গোপালদাসের ভক্ত। রঘুনাথ আর গোপালদাসের আশীর্বাদেই তিনি নাকি জমিদারি পেয়েছিলেন।

আজও আমজাদের উত্তরপুরুষেরা রঘুনাথের মালসা চড়ান দধিয়ার মেলায়। প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে কবি কৃত্তিবাসের বাসস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ‘…এখনও যাহাকে জিজ্ঞাসা কর, সে কৃত্তিবাসের বাড়ির স্থান দেখাইয়া দিবে। উহা একজন দরিদ্র মুসলমান প্রজার বাঁশবন।’

………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..

পর্ব ১৪: খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন

পর্ব ১৩: বৈদিক যুগের ‘স্থালী’-ই আজকের প্লেট, ‘উখ্য’-ই ফ্রাইং প্যান

পর্ব ১২: লোকখেলার মধ্যে মিশে রয়েছে হাজার বছরের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি

পর্ব ১১: অঘ্রানের নবান্ন মূলত নববর্ষেরই উৎসব ছিল

পর্ব ১০: বারবণিতাদের আরাধনার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল কাটোয়ার কার্তিক লড়াই

পর্ব ৯: শিশুঘাতক থেকে কেন শিশুরক্ষক দেবতা হয়ে উঠলেন কার্তিক?

পর্ব ৮: তেনাদের পুজো, তেনাদের মেলা-মোচ্ছব

পর্ব ৭: প্রেত মানেই ভূত বা অতীত, কিন্তু সকল প্রেতই ভূত নয়!

পর্ব ৬: কেবল কালী নন, লৌকিক লক্ষ্মী ঠাকরুনও দাঁড়ান স্বামী নারায়ণের বুকে পা রেখেই

পর্ব ৫: মহিষাসুরমর্দিনী নন, কৃষিপ্রধান বাংলায় আদিপূজিতা ছিলেন শস্যদেবী নবপত্রিকা

পর্ব ৪: পুকুরের দেবতা পুকুরের ভূত

পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস

পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর

পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প