রাস্তার নাম কবিরাজ রো। গণেশদার বাড়ি। সেই বাড়ি দেখে, আমার অন্তত মনে হয়েছিল, গণেশদার ছবিরই বাড়ি এটা। এই পরিবেশটাও গণেশদার ছবির। আমাকে বলা হয়েছিল, চুপচাপ কাজ সেরে নিতে। গণেশদা বসে আছেন, ছবি আঁকছেন– সেসবের শুটিং করলাম আমরা। আমার সঙ্গে একবিন্দু কথা হয়নি গণেশদার। ওঁকে কথা বলানোও আসলে ঝক্কির কাজ। এবং মনেই হত যেন বড্ড খুঁচিয়ে, প্রায় ধাক্কা মেরে কথা বলতে হয়। আমরা ছিলাম দু’-চার ঘণ্টা, ওঁর মুখ থেকে বেরিয়েছিল দু’-তিনটে কথা। কী কথা? তা হল, আমি কোথায় বসব কিংবা আমি কোথায় দাঁড়াব। এর বাইরে কিছুই না।
ছোটবেলা থেকেই গণেশ পাইনের কাজের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। খুবই পছন্দ করতাম ওঁর কাজ। বিভিন্ন সময় টুকরো-টাকরা কাজ দেখেছিলাম। নানা গ্যালারিতে গিয়েও। ১৯৮৬ সালে ‘ভিশনস’ নামে একটা বড় প্রদর্শনী হয়। চারজন শিল্পীর নানারকম কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী– ওই চারজন সোমনাথ হোড়, বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরী এবং গণেশ পাইন। শুধু কয়েকটা ছবি দেওয়ালে ঝুলিয়ে সেই প্রদর্শনী দায় চুকিয়ে দেয়নি। শিল্পীদের ছাত্রজীবনে আঁকা নানা স্কেচও ছিল সেখানে, যাতে বোঝা যায়, একজন শিল্পী কীভাবে বদলাতে বদলাতে নিয়ে চলেন তাঁর শিল্পকে। এর আগে গণেশ পাইনের ছবি এভাবে, এত খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। এই প্রদর্শনী ওঁর ছবির প্রতি আমার ভালো লাগা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সেসময় দেবব্রত রায় (যামিনী রায়ের নাতি, আমার পুরনো পাড়ার প্রতিবেশী), দেবব্রতদা, একটা ছবি করছিলেন ‘কলকাতা ৩০০’ নিয়ে। সেসময় কলকাতার জন্মদিন নিয়ে হইচই চলছে। দেবব্রতদা জিজ্ঞেস করল, সেই ছবিতে আমি কাজ করতে পারব কি না। ছবির বিষয় ছিল, কলকাতা শহরকে শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখা। কোম্পানির আমলের ছবি থেকে সাম্প্রতিক সময়ের ছবি– এই হল ছবির সময়ের পরিধি। আমার দায়িত্ব ছিল রিসার্চ করা থেকে শুরু করে ওই ছবিতে অ্যাসিস্ট করাও। একদিন দেবব্রতদা বলল, আমরা গণেশ পাইনের শুটিং করব। গণেশ পাইন অত্যন্ত লাজুক, মৃদুভাষী। তাও দেবব্রতদা বলে-কয়ে কী করে যেন বুঝিয়েছিল শুটিংটার জন্য। অবশ্যই ওঁকে বিরক্ত না করে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের দিকে একটা ফ্ল্যাটে শিফট করেন। এই নতুন পরিবেশে, নতুন সময়ে গণেশ পাইনের ছবি একটু অন্যরকম রূপ নিল। এই সময়টায় হয়তো দেখাও করতে পারতাম ওঁর সঙ্গে। কিন্তু আমার যে অন্ধ ভালোবাসা ছিল ওঁর কাজের প্রতি, তা অল্প অল্প করে কমে যেতে লাগল এই নতুন গণেশ পাইনে। এই বাসা বদলে ওঁর কাজে শুধু নয়, চেহারাতেও অন্য একটা রূপ এসেছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাস্তার নাম কবিরাজ রো। গণেশদার বাড়ি। সেই বাড়ি দেখে, আমার অন্তত মনে হয়েছিল, গণেশদার ছবিরই বাড়ি এটা। এই পরিবেশটাও গণেশদার ছবির। আমাকে বলা হয়েছিল, চুপচাপ কাজ সেরে নিতে। গণেশদা বসে আছেন, ছবি আঁকছেন– সেসবের শুটিং করলাম আমরা। আমার সঙ্গে একবিন্দু কথা হয়নি গণেশদার। ওঁকে কথা বলানোও আসলে ঝক্কির কাজ। এবং মনেই হত যেন বড্ড খুঁচিয়ে, প্রায় ধাক্কা মেরে কথা বলতে হয়। আমরা ছিলাম দু’-চার ঘণ্টা, ওঁর মুখ থেকে বেরিয়েছিল দু’-তিনটে কথা। কী কথা? তা হল, আমি কোথায় বসব কিংবা আমি কোথায় দাঁড়াব। এর বাইরে কিছুই না।
গণেশদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম এক আর্ট কালেকটরের বাড়িতে। আমাদের যেতে সামান্য দেরি হয়েছিল সেখানে। দেবব্রতদা সেই ভদ্রলোককে বলল দেরির কারণ গণেশদার বাড়িতে শুটিং। ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে প্রায় বার চারেক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সত্যিই গণেশ পাইনের বাড়িতে শুটিং করে এসেছেন?’
আমার শিল্পী-বন্ধুদের থেকে জেনেছিলাম, গণেশ পাইন দিনের বেলা কাজ করতেন। সন্ধেবেলা যেতেন বসন্ত কেবিনে। চা খেতে, আড্ডা মারতে। ওইরকম কম কথা বলা লোক, কী করে যে আড্ডা মারতেন, ভাবলেই অবাক লাগে!
পরের দিকে গণেশ পাইন চলে আসেন দক্ষিণ কলকাতায়। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের দিকে একটা ফ্ল্যাটে শিফট করেন। এই নতুন পরিবেশে, নতুন সময়ে গণেশ পাইনের ছবি একটু অন্যরকম রূপ নিল। এই সময়টায় হয়তো দেখাও করতে পারতাম ওঁর সঙ্গে। কিন্তু আমার যে অন্ধ ভালোবাসা ছিল ওঁর কাজের প্রতি, তা অল্প অল্প করে কমে যেতে লাগল এই নতুন গণেশ পাইনে। এই বাসা বদলে ওঁর কাজে শুধু নয়, চেহারাতেও অন্য একটা রূপ এসেছিল। এই সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের গণেশ পাইনের চেয়ে কবিরাজ রো-এর গণেশ পাইনকে আমি এখনও বেশি ভালোবাসি।
…ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved