২০০০ সালের পর থেকে আমার প্রিন্টে আগ্রহ বাড়ে। ফলে নানা ধরনের পুরনো প্রিন্ট কিনতে থাকি। ছবি আরও খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। এই সময়টায় রাধাপ্রসাদ গুপ্ত চলে গিয়েছে। আমার সমস্ত জিজ্ঞাসার উত্তর পেতাম তপতীর থেকে। এখন বুঝতে পারি, অনেক বোকা বোকা প্রশ্ন করেছিলাম ওকে। আরও কয়েক বছরে আমার প্রিন্টের কালেকশন বাড়ে। জ্ঞানবুদ্ধিও বাড়ে খানিকটা। এইরকম একটা সময় তপতী ছিল ‘সেন্টার ফর সোশাল সায়েন্স’-এর দায়িত্বে। সেসময় সেন্টার নানা ধরনের মানুষ ও তাঁদের কাজের ডিজিটাইজেশনে উদ্যোগী হয়েছিল। রণেন আয়ান দত্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-ও ছিলেন সেই তালিকায়। তপতী আমার প্রিন্টগুলোও সেসময় ডিজিটাইজ করে।
২১.
আমার দাদা সৃঞ্জয় আর তপতী গুহ ঠাকুরতার ভাই রাজা একই ক্লাসে পড়ত। লা মার্টিনিয়ার স্কুলে। গুহঠাকুরতাদের বাড়ি ছিল লা মার্টিনিয়ার স্কুল থেকে হাঁটা পথ। তপতীর দাদা পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। মাঝেমধ্যে এক্সট্রা ক্লাসের চক্করে কিংবা এমনিই আমার দাদা গুহঠাকুরতাদের বাড়িতে যেত। কখনওসখনও থেকেও যেত। গুহঠাকুরতা বাড়ির সঙ্গে এই যোগাযোগের জন্যই তপতীকে ছোট থেকেই আমি দেখেছি। সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়াও বটে। কোনও একটা সময় তপতীকে আমি ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছিলাম। ‘দিদি’ সম্বোধনটাও তুলে দিয়েছিলাম।
১৯৮৭ সালে লিজিয়ঁ দ্য’নর পেয়েছিলেন যখন সত্যজিৎ রায়, তখনকার একটা গল্প তপতী বলছিল কয়েক দিন আগেই। ওই পুরস্কার ঠাঁই পেয়েছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। তপতী ও ওঁর স্বামী হরি বাসুদেবন– দু’জনে সেরিমনি শেষে হেঁটে ফিরছিল। তপতী তখন অন্তসত্ত্বা। হাঁটতে দেখে আমার বাবা বসন্ত চৌধুরী বলেন যে, এখন আর ট্যাক্সি কোথায় পাবে, আমার গাড়িতে উঠে পড়ো। শুধু লিফট দিয়েই ব্যাপারটা চুকেবুকে যায়নি। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তপতীর বাবা-মার সঙ্গে বেশ খানিক আড্ডাও মেরেছিল বাবা।
আমার সঙ্গে তপতীর নতুন করে পরিচয় হল ‘‘দ্য মেকিং অফ এ নিউ ‘ইন্ডিয়ান’ আর্ট: আর্টিস্টস অ্যাসথেটিক্স অ্যান্ড ন্যাশনালিজম ইন বেঙ্গল, ১৮৫০-১৯২০’’ এই বইটা পড়তে পড়তে। অক্সফোর্ড থেকে গবেষণা শেষ করে যখন তপতী ফিরল, তার আশপাশের সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল তপতীর এই বই। এই বইটা বঙ্গীয় শিল্পভাবনার ওপর। আমার আগ্রহের এমন অনেক বিষয়ই ছিল, যা নিয়ে আস্ত বই পাইনি আগে– সেসবের বেশ কিছুই ছিল তপতীর এই বইতে। পরে যদিও, অনেক অন্য বই জোগাড় করেছিলাম।
নয়ের দশকে, এই বই-ই আমার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলল আঠেরো-উনিশ শতকীয় প্রিন্ট ছবির ওপর। পাশাপাশি রাধাপ্রসাদ গুপ্তর সঙ্গে আমার একরকম সখ্য ছিল, সেকথা তো এই কলামে আগেও লিখেছি। আর.পি. কাকুর কালীঘাট ড্রয়িং এবং আর্লি বেঙ্গল প্রিন্টেরও বিপুল সংগ্রহ ছিল। অল্প কিছু ছবিই ছিল দেওয়ালে টাঙানো। কিন্তু বছরে একবার করে, আমি আর. পি. কাকুর ট্রাঙ্কে থাকা বহু ছবি বের করে রোদে দিতাম। রোদ বললাম বটে, তবে সরাসরি রোদ নয়, রোদের আলোতে। এই কাণ্ডটা করতে গিয়ে আর.পি. কাকু অনেক সময় ওই ছবিগুলো কেনার গল্প বলত। কখনও ছবির ভেতরকার গল্পও বলত– কোন ঘটনার রেফারেন্সে ছবিটা আঁকা, কার আঁকা– এইসব। ছবিগুলো আলোয় দিয়ে আর.পি.-ও আমার সঙ্গে বসে থাকত। রোদ বাড়লে, রোদ ছবির দিকে এগোলে আবার ছবির স্থান পরিবর্তন করতাম দু’জন মিলে।
অল্প কিছু ছবি কিনতে শুরু করেছিলাম তখন থেকেই। ২০০০ সালের পর থেকে আমি এ ব্যাপারে আরও জড়িয়ে পড়ি। নানা রকম প্রিন্ট কিনতে থাকি। ছবি আরও খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। এই সময়টায় আর.পি. চলে গিয়েছে। আমার সমস্ত জিজ্ঞাসার উত্তর পেতাম তপতীর থেকে। এখন বুঝতে পারি, অনেক বোকা বোকা প্রশ্ন করেছিলাম ওকে। আরও কয়েক বছরে আমার প্রিন্টের কালেকশন বাড়ে। জ্ঞানবুদ্ধিও বাড়ে খানিকটা। এইরকম একটা সময় তপতী ছিল ‘সেন্টার ফর সোশাল সায়েন্স’-এর দায়িত্বে। সেসময় সেন্টার নানা ধরনের মানুষ ও তাঁদের কাজের ডিজিটাইজেশনে উদ্যোগী হয়েছিল। রণেন আয়ান দত্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-ও ছিলেন সেই তালিকায়। তপতী আমার প্রিন্টগুলোও সেসময় ডিজিটাইজ করে। তখন নানা গল্পগাছার মধ্যেই তপতী আমাকে প্রস্তাব দেয়, যদি আমার প্রিন্টের সংগ্রহ নিয়ে একটা প্রদর্শনী করা যায়। এবং তা কিউরেট করবে তপতীই। বিড়লার সঙ্গে যৌথভাবে, ওদের একটা গোটা ফ্লোর নিয়ে প্রদর্শনী চলেছিল। ২০০৬ সালের ১১-২৫ মার্চ পর্যন্ত ‘অ্যান এগজিবিশন অফ প্রিন্টস ফ্রম দ্য কালেকশন অফ সঞ্জীত চৌধুরী’ নামের এই প্রদশর্নীটি ছিল একেবারেই ‘নট ফর সেল’। প্রদর্শনীটা জনপ্রিয় হয়েছিল খুবই। পরে, মুম্বইতেও এই প্রদর্শনী দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এত দিন কেটে গিয়েছে, অথচ এখনও কিছু মানুষ দেখা হলে এই প্রদর্শনীর প্রসঙ্গ তোলেন। ৪০ পাতার একটা রঙিন ক্যাটালগ বেরিয়েছিল এই প্রদর্শনী উপলক্ষেই, যাতে ছবি তো বটেই, লেখা ছিল তপতীরই।
বসন্ত চৌধুরীর প্রচুর দুর্লভ বই তপতী ডিজিটাইজ করেছিল। এতই পুরনো ছিল সেই সব বই, যে কপিরাইটের আওতায় ছিল না। সেই বইগুলি এখন নানা পড়ুয়া এবং সংস্থার কাছে পৌঁছয় ওদের মাধ্যমেই।
তপতী ১২ বছর ধরে দুর্গাপুজো নিয়ে কাজ করছিল। বইটি প্রকাশিত হয় দিল্লির বিখ্যাত প্রকাশনী ‘প্রাইমারস’ থেকে। ২০২২ সালে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে তপতী পুরস্কৃতও হয়। আমি মনে করি, দুর্গাপুজোকে যে ইউনেস্কো ‘হেরিটেজ’ তকমা দিয়েছে, তার নেপথ্যে তপতীর বেশ জোরালো ভূমিকা রয়েছে। যদিও একথা বললেই ও এড়িয়ে যাবে।
তপতীর স্বামী, হরির সঙ্গেও আমার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। হরি একজন দুরন্ত ইতিহাসবেত্তা। হরি-তপতীর বাড়িতে যখন যেতাম, তখন হরি আমার জন্য একরকম কফি বানাত। যা পার্কুলেটরের কফি, আদতে দক্ষিণের। একটা ফুড বুকের কাজ আমি করছি অনেক দিন ধরেই। ভজহরি মান্নার উদ্যোগে। সেখানে অবিভক্ত বাংলার খাবারদাবারের কথা রয়েছে। হরিকে বলেছিলাম, একটা ভূমিকা যদি কেউ লিখে দেন। হরি ওর এক বন্ধুকে বলে ভূমিকাটা লিখে দেওয়ার ব্যাপারে। সেই বই হয়তো কয়েক মাস কিংবা নতুন বছরের শুরুতেই বেরবে। তখন হরির কথা আরও, আবারও বড় মনে পড়বে।
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২০। মৃত্যুর ২২ বছর পর বসন্ত চৌধুরীর ওপর বই হয়েছিল শুভাদার জন্যই
পর্ব ১৯। মৃণালদার মুদ্রাদোষগুলো আবারও দেখতে পেলাম অঞ্জন দত্তর সৌজন্যে
পর্ব ১৮। ১৭টা রাজ্য ঘুরে ১০৫৫টা পুরনো সিনেমা হলের ছবি তুলেছে হেমন্ত
পর্ব ১৭। এক বাঙালি বাড়ি আসবে বলে দু’রকমের মাছ রেঁধেছিলেন নানা পাটেকর
পর্ব ১৬। সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না
পর্ব ১৫। ১০ বছর বয়সেই ব্রাউনি ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছিল রিনামাসি
পর্ব ১৪। তাল ও সুর দিয়ে তৈরি এক গ্রহে থাকতেন উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২: পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল