কবে ইন্দ্রকাকার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছে আমার, একেবারেই মনে নেই। সম্ভবত, বাবার সঙ্গে মাঝেসাঝে যখন উত্তর কলকাতায় যেতাম, তখন হয়তো কলেজ স্ট্রিটের দিকেও পা পড়ত। ইন্দ্রকাকার সঙ্গে যোগাযোগ যাকে বলে, ‘ঘন’ হল। সৌজন্যে সামান্য কিছু টাকাপয়সা। ফলে, কলেজ ছুটির পর বইপাড়ায় যাওয়াটাই ছিল দস্তুর। ততদিনে ‘ইন্দ্রকাকা’ হয়ে উঠেছে ‘ইন্দ্রদা’। ‘সুবর্ণরেখা’য় গিয়ে বই কিনতাম দু’-তিনটে– তবে সেজন্য খুবই দরাদরি চলত।
৮.
ন’মাসে-ছ’মাসে, কী বছরে এক-আধবার অচেনা বই এসে পড়ত আমার কাছে। তখন বয়স ১৪-১৫ হবে। যে বইগুলোর কথা বলছি, সেগুলো যদিও নতুন নয়– পুরনো। আমার বাবা বসন্ত চৌধুরী সেই বই দিয়ে বলত, ‘ইন্দ্রকাকা পাঠিয়েছে।’ আমি বুঝতেই পারতাম, এ হল সেই ‘সুবর্ণরেখা’র ইন্দ্রনাথ মজুমদার। কবে ইন্দ্রকাকার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছে আমার, একেবারেই মনে নেই। সম্ভবত, বাবার সঙ্গে মাঝেসাঝে যখন উত্তর কলকাতায় যেতাম, তখন হয়তো কলেজ স্ট্রিটের দিকেও পা পড়ত। ইন্দ্রকাকার সঙ্গে যোগাযোগ যাকে বলে, ‘ঘন’ হল। সৌজন্যে সামান্য কিছু টাকাপয়সা। ফলে, কলেজ ছুটির পর বইপাড়ায় যাওয়াটাই ছিল দস্তুর। ততদিনে ‘ইন্দ্রকাকা’ হয়ে উঠেছে ‘ইন্দ্রদা’। ‘সুবর্ণরেখা’য় গিয়ে বই কিনতাম দু’-তিনটে– তবে সেজন্য খুবই দরাদরি চলত। দাম যা বলত ইন্দ্রদা, ঠিকঠাকই বলত, তার চে’ অনেকটাই কম বলতাম আমি, কারণ পয়সাকড়ি বিশেষ নেই। জোরজারও করতাম। বেশিরভাগ সময়ই, যে দাম বলছি, তা হুবহু মেনে না নিলেও, অনেকটাই কমাত ইন্দ্রদা। শুধু বই কেনা অবশ্য নয়, অনেক বই দেখা, পড়া, সময় কাটানো, আড্ডা– সব মিলেঝুলেই ছিল সেই সুবর্ণরেখা-র ঠেক।
একদিন ইন্দ্রদা খবর দিল– একটা বই এসেছে যা আমার প্রভূত কাজে লাগবে! সে বই, একেবারেই টেকনিক্যাল, কিন্তু সহজে মেলে না। বাবাকেও বলে পাঠিয়েছে সেকথা। কিন্তু মুশকিল হল, সে বইয়ের দাম ছিল অনেক। সেই বাজারে কয়েকশো টাকা। হাতে মোটেই অত টাকা নেই। ইন্দ্রদাকে জানালাম যে, কয়েক মাস পরে নেব। ইন্দ্রদা রেখেও দিয়েছিল ৩-৪ মাস। কিন্তু সে বই কেনার টাকা কয়েক মাসেও জড়ো করতে পারিনি। এরই মধ্যে একদিন পৌঁছলাম সুবর্ণরেখায়। ইন্দ্রদা বলল, ‘এই, তোমার বইটা নিয়ে যাও তো!’ ‘এখনও তো পুরো টাকাটা জমেনি ইন্দ্রদা, সামনের মাসে আশা করি নিয়ে যেতে পারব।’ “তোমার কাছে ক’টাকা আছে?” মানিব্যাগ হাতড়ে দেখলাম, দেড়শো টাকার মতো পড়ে। বইয়ের দাম সে তুলনায় তিন-চারগুণ! ইন্দ্রদা বলল, ‘টাকাটা আমাকে দাও, বইখানা নিয়ে যাও।’ তিন-চারগুণ কম দামে ইন্দ্রদা বইখানা দিয়ে দিয়েছিল। সেই বিকেলটা এক ঝটকায় বদলে গেল। বইটা বাগিয়ে সুবর্ণরেখা-র সিঁড়ি দিয়ে নামছি, হঠাৎ ইন্দ্রদার গলা শুনতে পেলাম। নাম ধরে ডাকছেন। পিছনে তাকিয়ে দেখি, হাত নেড়ে ডাকছে। ‘বাড়ি ফেরার টাকা আছে তো?’ বলেছিলাম, ‘আছে।’
‘এক্ষণ’ পত্রিকায় চমৎকার একটা বিজ্ঞাপনের লেখা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। সাধারণত, বিজ্ঞাপনে এই ভাষার চমৎকারিত্ব তেমন চোখে পড়ে না। লেখা হয়েছিল:
‘বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা লাগালে লাভ হয়তো কিছু হতে পারে, কিন্তু খরচের কথা ভেবে দেখেছেন কখনো? ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির মতো ব্যাপার আর-কি! তার চেয়ে সহজ একটা উপায় আছে: দুষ্প্রাপ্য বইয়ের প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। পৃথিবীর যে-কোনো ভাষার বই, যত দুষ্প্রাপ্যই হোক-না, আমরা শস্তায় বিক্রি করে থাকি। আর-এক কথা: পুরনো বই কিংবা বইয়ের সংগ্রহ কিনতেও আমরা কম উৎসাহী নই।
সুবর্ণরেখা
৭৩ মহাত্মা গান্ধী রোড। কলকাতা ৯’
২০০০ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর একদিন ইন্দ্রদার দোকানে গিয়েছি। এটা-সেটা গপ্প চলছে। ইন্দ্রদা আমাকে গোটা তিরিশেক বইয়ের নাম বলে দিল। এই তিরিশটা মতো বই-ই বাবার সংগ্রহের। সবগুলো যে ইন্দ্রদার থেকেই কেনা, এমন নয়। কিন্তু ইন্দ্রদা বাবার সংগ্রহে কী কী জরুরি ও দুর্লভ বই রয়েছে, জানত। বলেছিল, সেই বইগুলো যেন যত্ন করে রাখি। বিজ্ঞাপনের পুরনো বইয়ের গোয়েন্দা যেন ইন্দ্রদাই। তবে, বাবার সংগ্রহের বই যত্নে রাখতে বলাটা ছিল বই ও আমার প্রতি স্নেহ থেকেই। বইগুলো কিনবে, এমন উৎসাহ বিন্দুমাত্রও দেখায়নি।
আস্তে আস্তে কাজকর্ম বাড়ল আমার। শহরে না-থাকাও বাড়ল। এসে জুটেছে মোবাইল ফোন। ইন্দ্রদার ফোন পেতাম, বই এসেছে। ইন্দ্রদা বুঝতেই পারত, আমি ব্যস্ত রয়েছি। সেসময় বহুদিন নারকেল দড়ি দিয়ে বান্ডিল করে বই রেখে দিত। কখনও এক বান্ডিলে না কুলোলে, দু’-তিন বান্ডিলও। দোকানের এমন জায়গায় রাখা থাকত সেই বান্ডিল, যেখানে লোকের চোখে পড়বে না। অনেক সময়ই তা অ্যাকাউন্ট্যান্টের চেয়ারের নিচে, বা কোনও টেবিলের পিছনে। সুবর্ণরেখায় গেলেই, সেইসব বান্ডিল খুলে বই বের করতাম। হয়তো ৪০টা বই, নেব কয়েকটা। বান্ডিল থেকে বই বের করে টেবিলে রাখতাম একের পর এক। ইন্দ্রদা তৎক্ষণাৎ সে বইয়ের দাম বলে দিত। একবার একটা বই বের করে রাখায়, ইন্দ্রদা বলল, ‘এ বই তো তোমার আছে।’ বললাম, ‘এটা পুরনো এডিশন।’ কিন্তু ব্যাপার হল, সেই বই আমি ইন্দ্রদার থেকে কিনেছি অন্তত ১০-১৫ বছর আগে! ফলে শুধু বাবার নয়, আমার বইয়ের প্রতিও ইন্দ্রদার নজর ছিল ঠিক।
এই সময়টায়, আমি আর দাম কমানোর চেষ্টা কোনও দিন করিনি। কারণ আমার যখন ক্ষমতা ছিল না, তখন ইন্দ্রদা যারপরনাই সাহায্য করেছে। বই দিয়ে, চারগুণ কম দাম নিয়ে, আমার প্রচুর অনুরোধ-উপরোধ সামলে। ফলে পুরোপুরিভাবে কাজে ঢোকার পর, সামান্য বইপত্র কেনার ক্ষমতা যখন হল, তখন আর পুরনো দিনের মতো দর করিনি। এটাই আমার বই কেনার পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল।
একবার সুবর্ণরেখায় বইপত্র কেনার দিন দুয়েক পরই দেখা হয়েছিল অভীক মুখোপাধ্যায়ের। আমার সিনেমাটোগ্রাফার-বন্ধু অভীক মুখোপাধ্যায়। সে সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে একটা কাজ করছে। বেশ ক’টা বইও পড়েছে। কিন্তু দু’খানা বই কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমার এবং অভীকের উত্তর কলকাতায় একটা লোকেশন দেখতে যাওয়া ছিল ক’দিন পরেই। তখন অভীককে নিয়েই ভাবলাম ঢুঁ মারা যাক সুবর্ণরেখায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পুরনো সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখি, দোকানে লোকজনের ভিড় যথেষ্টই। পাল্লা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। ইন্দ্রদা খানিক অবাক, সে অবাক মুখের অনুবাদ করলে হয়– ক’দিন আগেই তো এসেছ। এখন আবার কী দরকারে! বলল, ‘কী ব্যাপার?’ সিপাহি বিদ্রোহের যে দুটো বই অভীক চিরুনিতল্লাশি করেও পায়নি, সে-দুটো বইয়ের কথা বললাম। ‘তুমি আবার একটা সাবজেক্ট অ্যাড করছ?’ আসলে, অনেক দিন ধরেই ইন্দ্রদা বলেছে আমাকে বিষয়ের পরিধি কমাতে। নানা দিকে মাথা না দিয়ে এতদিনের যে যে বিষয় নিয়ে কাজ করি, সেখানে যেন কনসেনট্রেট করি। ইন্দ্রদাকে বুঝিয়ে বলি, যে, এটা আমার জন্য না, হাত দেখালাম অভীকের দিকে। ভিড়ের আদল থেকে মুখ বাড়াল সে।
ইন্দ্রদা শান্তিনিকেতনেও যে দোকান করেছিল, সেকথা বোধহয় সবারই জানা। ‘সুবর্ণরেখা’ তদ্দিনে দুটো। আমি গিয়েছি বোলপুরে। ইন্দ্রদা জানত, কোথায় থাকি সেখানে গিয়ে। বলল, ‘রাতে আমার কাছে খেও।’ খাবারের কথা শুনে আমি খুব আহ্লাদিত। ‘কী খাওয়াবে বলো?’
‘বাংলা আর বাদুড়ের মাংস।’ আমি খুব খুশি– কারণ বাদুড়ের মাংস সেই প্রথম খাব। বললাম, ‘বাংলাটা খাব না, কিন্তু বাদুড়টা খেতে আসব। মদ খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
ইন্দ্রদা খুব অবাক হল। কারণ রাধাপ্রসাদ গুপ্তর বাড়িতে আমি, ইন্দ্রদা এবং আর.পি.– তিনজনে বেশ কয়েকবার মদ্যপান করেছি। তখন যদিও আমি সদ্য কলেজপড়ুয়া।
বলল, ‘কবে ছেড়েছ?’
‘তা, অ-নে-ক দিন আগে।’
‘বাংলা না খেলে কিন্তু বাদুড় পাবে না।’ ইন্দ্রদা ঘোষণা করল সেইবেলা।
সেবার আমি বাংলা খাইনি। তাই বাদুড়ও পাইনি।
(চলবে)
…ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল