ঋতুপর্ণ ঘোষ– আমার বন্ধু ঋতু। ও যখন ‘আনন্দলোক’ ছেড়ে দিল, আমি খানিক অবাকই হয়েছিলাম। তখন ওর সঙ্গে ঘন ঘন দেখাসাক্ষাৎ হত। কথাও হত ফোনে। কিছুদিন পরে ও আমাকে জানাল ‘রোববার’ পত্রিকার কথা। বুঝলাম, নতুন একটা পত্রিকা বাজারে আসতে চলেছে। ‘রোববার’-এর প্রথম সংখ্যার নাম ছিল ‘বহু বচ্চন’। অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে সংখ্যা। অসামান্য কপিরাইটার ঋতু, করল কী, দুটো বিজ্ঞাপন তৈরি করল। দুটো পোস্টারই সিনেমার পোস্টারের মতো করা। কম দামের একরঙের পোস্টার, যেখানে কোনও ছবি নেই– শুধু লেখা ও ডিজাইন। এই পোস্টারগুলো ছাপা হয়েছিল পাতলা কাগজে। এই পোস্টারগুলো থেকেও ‘রোববার’ এবং সংবাদ প্রতিদিন নতুন কী কাণ্ডটা করছে, তা নিয়ে বড় রকমের কৌতূহল তৈরি হয়েছিল।
২৪.
ঋতুপর্ণ ঘোষ– আমার বন্ধু ঋতু। ও যখন ‘আনন্দলোক’ ছেড়ে দিল, আমি খানিক অবাকই হয়েছিলাম। ‘উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে’ সেই পত্রিকার ক্যাচলাইন ছিল। ঋতুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? ছেড়ে দিলি?’ ঋতু বলল, ‘অন্য কিছু করব।’ তখন ওর সঙ্গে ঘন ঘন দেখাসাক্ষাৎ হত। কথাও হত ফোনে। কিছুদিন পরে ও আমাকে জানাল ‘রোববার’ পত্রিকার কথা। বুঝলাম, নতুন একটা পত্রিকা বাজারে আসতে চলেছে। বলেছিলাম, ‘চমৎকার আইডিয়া, দেখ যদি করতে পারিস!’
‘তোকে রোববার-এর জন্য একটা ছবি করতে হবে’, কথায় কথায় একদিন বলে উঠল ঋতু। আমি বলেছিলাম, ‘তুইও তো বিজ্ঞাপনের লোক, তুই কেন করছিস না?’ ঋতু বলেছিল, ‘না, তুই কর।’ ঋতু জানিয়েছিল, কিছু লোকাল বাংলা চ্যানেলে দেখাবে এই ছবি। দু’-তিনটে ভার্সানও করতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ছবি করার বিনিময়ে যে-টাকাকড়ির কথা বলেছিল ও, তা খুবই কম। ওকে বলেছিলাম, ‘এ পয়সায় ছবি হয় না রে!’ ‘তুই তো একসময় বিজ্ঞাপনের কাজ করেছিস কলকাতায়, কর না এরকম একখানা ছবি!’ খানিক জোর দিয়েই বলল ঋতু। এডিটর অর্ঘ্যকমল মিত্র, সিনেমাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায় ও আমি তখন একসঙ্গে কাজ করি। সে কথা ঋতুকে বলায় বলল, ‘সে তুই দেখে নে, কী করবি!’
সেই বিজ্ঞাপনের ছবি হয়েছিল। শুট হয়েছিল মূলত ঋতুর বাড়িতেই। গ্রাফিক্সের কাজকম্মোও হয়েছিল। ঋতু কিছু কথাবার্তাও বলেছিল সেখানে। কথামতো অভীকই শুট করেছিল এবং অর্ঘ্য এডিট। ছবি তৈরি হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যেই। নানা চ্যানেলে দেখানো হল ছবিগুলো। ওই বিজ্ঞাপনের ছবি ‘রোববার’-এর প্রতি পাঠকদের মনে কৌতূহল তৈরি করতে পেরেছিল। যেহেতু অনেকগুলো ধাপে বিজ্ঞাপন হয়েছিল, কৌতূহলও আস্তে আস্তে বেড়েছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল ঋতুর এই নতুন কাজের খবর।
প্রথম সংখ্যার নাম ছিল ‘বহু বচ্চন’। অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে সংখ্যা। মুম্বইতে গিয়ে অমিতাভের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। তবে সেটুকুই শুধু প্রথম সংখ্যার চমক নয়। অসামান্য কপিরাইটার ঋতু, করল কী, দুটো বিজ্ঞাপন তৈরি করল। যে দুটো পোস্টার এই লেখার সঙ্গে আপনাদের দেখার জন্য দেওয়া হল। এই দুটো পোস্টারই সিনেমার পোস্টারের মতো করা। কম দামের একরঙের পোস্টার, যেখানে কোনও ছবি নেই– শুধু লেখা ও ডিজাইন। এই পোস্টারগুলো ছাপা হয়েছিল পাতলা কাগজে। এই পোস্টারগুলো থেকেও ‘রোববার’ এবং সংবাদ প্রতিদিন নতুন কী কাণ্ডটা করছে, তা নিয়ে বড় রকমের কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। পোস্টারে লেখা ছিল: ‘বিনামূল্যে বচ্চন’ এবং ‘বড়দিনে বড়োমিঞা’। ১৯৯৯ সালে আসলে ‘বড়েমিঞা-ছোটেমিঞা’ রিলিজ করে– ডেভিড ধাওয়ানের সুপারহিট ছবি! গোটা কলকাতার বাঙালি অঞ্চলগুলো ভরে গিয়েছিল এই রোববার-এর পোস্টারে। বলতে দ্বিধা নেই, ‘রোববার’ প্রথম থেকেই খুবই সাকসেসফুল। পাঠকের ভালোবাসা পেল, যা পাওয়া উচিতও ছিল।
‘রোববার’-এর প্রথমদিকে একজন ফোটোগ্রাফার ছিলেন, তাঁর নাম সনৎ ঘোষ। কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন সনৎ, তিনিও আমার পরিচিত। বিজ্ঞাপনের অনেক ছবি তুলতেন। সানন্দা-র জন্যও ছবি তুলতেন। একদিন আমি, ঋতু আর অভীক আড্ডা মারছিলাম। কথাচ্ছলে ঋতু অভীককে বলল, ‘তাহলে তুই আসিস, আমরা ওইদিন শুট করব।’ আমি একথার আগে-পরে কিছুই জানতাম না, তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী শুট করবি রে?’ বলল, ‘ওই একটা কাজের জন্য।’ বললাম, ‘সে তো সনৎ করে।’ ‘সনৎকে আপাতত নেওয়া হচ্ছে না। অভীক শুট করবে এটা।’ জানাল ঋতু। আমি তখন বলেছিলাম, ‘অভীক তো সিনেমাটোগ্রাফার, আজ না হয় বন্ধু বলে একটা শুট করে দেবে, তার পরে? ও তো সময়ই দিতে পারবে না, তখন কী করবি?’ ঋতু বলল, ‘আমি একজন ভালো ফোটোগ্রাফার খুঁজছি, কে হতে পারে বল তো?’ আমি তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা জানতাম। তারাপদদা তখন সদ্য রিটায়ার করেছেন। বললাম, তাঁর কথা। বললাম, ‘তারাপদদাকে নে। দুর্দান্ত কাজ করে!’ আমার একাধিকবার ‘দুর্দান্ত’ বিশেষণে ঋতু খানিক অবাকই হল। যেহেতু আমাকে অনেক বছর ধরেই চেনে এবং আমি সাধারণত কারও ব্যাপারে এতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি না তখন ঋতু জেরা করার মতো প্রশ্ন করল, ‘তুই কি খবরের কাগজের ছবিগুলো দেখে দুর্দান্ত বলছিস?’ বললাম, ‘না, খবরের কাগজের ছবি যদিও কিছুটা, কিন্তু রঘুবীর সিং তারাপদর একটা বই বের করার চেষ্টা করছেন। সেখানে কথা হয়েছে, তারাপদদার ছবি থাকবে এবং আমার দাদা সৃঞ্জয় লিখবে লেখাটা।’
তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’-র মেকিংয়ের ছবি তুলেছিলেন। সেই ছবিগুলো দেখেই, আমার দাদা সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা সম্বন্ধে একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। আমার দাদা যেহেতু তারাপদদার বইয়ের লেখার কাজটা করছিল, তাই আমাদের বাড়িতে তারাপদদার প্রচুর কনট্যাক্ট শিট ছিল। কনট্যাক্ট শিট হল একপাতায় ছাপা একই সাইজের ৩৬/ ২৪টা ছবি। আমি তখন সেই কনট্যাক্ট শিটগুলো দেখতাম। যে-ছবিগুলো ডিটেলে দেখার দরকার ছিল, তা বাবার আতশ কাচ দিয়ে দেখতাম। আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরী, যেহেতু প্রচুর কয়েন জমাতেন, তাই আতশ কাচেরও কোনও কমতি ছিল না বাড়িতে। আমি সেই ছবি দেখার অভিজ্ঞতার কথা বললাম ঋতুকে। ঋতু রাজি হল। তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় চলে এলেন ‘রোববার’ পত্রিকায়।
কিন্তু অভীক সেই শুটটা করেছিল। সেই শুটটা ছিল ‘রোববার’-এরই। রাইমা ও স্বস্তিকাকে নিয়ে। ঋতু ডিরেকশন দিচ্ছিল। আমি তখন ঋতুকে বলেছিলাম, ‘আমি কি আসতে পারি?’ ঋতু বলেছিল, ‘আসতেই পারিস, কিন্তু দুম করে ছবিগুলো বের করে দিবি না। আমার ম্যাগাজিনে আগে বেরবে, তারপরে তুই কোথাও দিতে পারিস।’ আমি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলাম, ‘না, অনুমতি না নিয়ে কোনও দিনই বের করব না।’
সেই অনুমতি কোনও দিনই নেওয়া হয়নি। কারণ কোনও দিনই সেই ছবিগুলো বের করিনি।
………………………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………………….
এর পর অভীককে আর দরকার পড়েনি ঋতুর। মাঝে মাঝে ঋতুর সঙ্গে দেখা হত, কথা হত। ২০১৩ সালে ঋতু চলে গেল। অনিন্দ্য সম্পাদনার দায়ভার পেল ‘রোববার’ পত্রিকার। যে কথাগুলো ঋতুর সঙ্গে হত, সেইসব কথোপকথনের কিছুটা অনিন্দ্যর কাছে এসে পড়ল। আজকের কলাম লেখার সূত্র অনিন্দ্যই। এই শেষ পর্ব।
ঋতু, আজ সেই ছবিটা দিলাম রে। রোববার.ইন-এ। যদিও অনুমতি নেওয়া হল না।
…………………………………. (সমাপ্ত) ………………………………..
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৩। নিজের লেখা বই নিজের কাছেই ছিল না প্রীতীশের
পর্ব ২২। উত্তরের গলি, হলুদ ট্যাক্সি ও উস্তাদ আমজাদ আলি খান
পর্ব ২১। তপতীর বই পড়েই প্রিন্টের প্রতি আমার উৎসাহ বেড়ে গেল
পর্ব ২০। মৃত্যুর ২২ বছর পর বসন্ত চৌধুরীর ওপর বই হয়েছিল শুভাদার জন্যই
পর্ব ১৯। মৃণালদার মুদ্রাদোষগুলো আবারও দেখতে পেলাম অঞ্জন দত্তর সৌজন্যে
পর্ব ১৮। ১৭টা রাজ্য ঘুরে ১০৫৫টা পুরনো সিনেমা হলের ছবি তুলেছে হেমন্ত
পর্ব ১৭। এক বাঙালি বাড়ি আসবে বলে দু’রকমের মাছ রেঁধেছিলেন নানা পাটেকর
পর্ব ১৬। সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না
পর্ব ১৫। ১০ বছর বয়সেই ব্রাউনি ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছিল রিনামাসি
পর্ব ১৪। তাল ও সুর দিয়ে তৈরি এক গ্রহে থাকতেন উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২। পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved