‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নিয়ে ফিল্ম তৈরির কথা যখন ভাবছেন গৌতম ঘোষ, একটি চরিত্রে ভেবেছিলেন আমার বাবা বসন্ত চৌধুরীর কথাও। বাবা মেয়েটির বাবার চরিত্র করেছিল, সিনেমায় যে-ভদ্রলোক মেয়েটির বিয়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে। আমি তখন সদ্য স্কুল পেরিয়েছি। উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঝাড়া হাত-পা। বেকার বসে আছি, দিন গুনছি। সেসময়ই বাড়িতে এসেছিলেন গৌতমদা। যদিও গৌতমদার ফিল্মের এক লেকচার তার আগেই আমি শুনেছিলাম।
৫.
১৯৫৯ সালে ‘নহবৎ পত্রিকা’য় ছাপা হয়েছিল কমলকুমার মজুমদারের আশ্চর্য এক উপন্যাস, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। তা বই আকারে ছেপেছিলেন আরেক মজুমদার মশাই– ইন্দ্রনাথ মজুমদার, তাঁর সুবিখ্যাত ‘সুবর্ণরেখা’ প্রকাশনী থেকে। শুরু থেকেই কিছু পরিচালকও উঠে-পড়ে লেগেছিলেন উপন্যাসটা নিয়ে ছবি বানাতে। যদিও শেষমেশ ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ যাঁর হাত ধরে বড়পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেছিল, তিনি গৌতম ঘোষ।
নয়ের দশক ছুঁয়ে ফেলতে এই পৃথিবীর তখনও বছর তিন-চার বাকি, গৌতমদা শুটিং করছিলেন তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে ও ক্যারিশমায়। আমিও জড়িয়ে গিয়েছিলাম এই কাণ্ডকারখানার সঙ্গে, এবং জড়িয়েছিলাম বলেই, শুরু হয়েছিল আমার ছবি তোলা।
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নিয়ে ফিল্ম তৈরির কথা যখন ভাবছেন গৌতম ঘোষ, একটি চরিত্রে ভেবেছিলেন আমার বাবা বসন্ত চৌধুরীর কথাও। বাবা মেয়েটির বাবার চরিত্র করেছিল, সিনেমায় যে-ভদ্রলোক মেয়েটির বিয়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে। আমি তখন সদ্য স্কুল পেরিয়েছি। উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঝাড়া হাত-পা। বেকার বসে আছি, দিন গুনছি। সেসময়ই বাড়িতে এসেছিলেন গৌতমদা। যদিও গৌতমদার ফিল্মের এক লেকচার তার আগেই আমি শুনেছিলাম। কথাপ্রসঙ্গে তা জানাতেই গৌতমদা বলে উঠলেন, ‘ওহ, তুমি ওই লেকচারে ছিলে! তবে তো তোমার ফিল্ম নিয়ে আগ্রহ রয়েছে, তাহলে শুটিংয়ে চলে এসো।’ আমি কিন্তু-কিন্তু করছিলাম। গৌতমদা জোর দিয়ে বলায়, আমি আর না করলাম না। তাছাড়া, গৌতম ঘোষের ‘পার’ ছবিখানা এত ভালো লেগেছিল যে, তদ্দিনে আমি বারচারেক দেখেও ফেলেছিলাম। এমনকী, এখনও সেই ছবি দেখে একইরকম ভালো লাগে।
আমার বাল্যবন্ধু সামন্ত্যক দাস। আপনারা অনেকেই হয়তো চিনবেন তাঁকে। গৌতমদার গল্পে, কমলকুমারের গল্পে, আমার এই ফ্রেমকাহিনিতে ওর ঢুকে পড়ার হক রয়েছে একশোভাগ। কেন? বলছি।
সামন্ত্যকের কাছে একখানা ক্যামেরা ছিল। কোয়াফ্লেক্স কোম্পানির ক্যামেরা। প্রথম দেখেছিলাম ওর বাড়িতেই। ওর এক প্যারিস-নিবাসী মামার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল ও। যদিও সামন্ত্যক ফোটোগ্রাফার ছিল, এমনটা নয়। আমি শুটিংয়ে যাচ্ছি, এ ব্যাপারটা মনের মধ্যে পাকা করে নিয়ে গিয়েছিলাম ওর কাছে। বলেছিলাম, “তোর ক্যামেরাটা ক’দিন ধার দিবি?” ও একটু অবাকই। বলল, ‘তুই তো ছবি তুলতে জানিস না!’ ‘তাতে কী, শিখিয়ে দে।’– বাল্যবন্ধুর ওপর যেমন জোর খাটানো যায়, সেরকম গলায় বলেছিলাম একথা। ক্যামেরার খুঁটিনাটি দেখিয়ে দিল ও। ছবির রোল কিনে নিয়েছিলাম শুটিংযাত্রার আগে।
অবশেষে সাগরদ্বীপে পৌঁছল এই বান্দা। জীবনের ‘বড় শুটিং’ বলতে সেই প্রথম। হাঁ করে দেখতাম– কী কাণ্ডটাই না হচ্ছে চারপাশে! গৌতমদার সহকারী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা দেখলেন, চালাকচতুর তরুণ ছোকরা– অতএব ফাইফরমাস খাটাতে লাগল। যা খুবই স্বাভাবিক ছিল, আমি তো অন্য কোনও কাজেও লাগছিলাম না। এখানে-ওখানে দৌড়ে যাচ্ছি, এটা-সেটা নিয়ে আসছি, আর টুক করে ক্যামেরা বের করে এর মধ্যেই চেষ্টা করতাম ছবি তোলার। দেখতে দেখতে রোল ফুরিয়েও গিয়েছিল। এক প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার কেন কে জানে, ওঁর দু’খানা রোল দিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। ফলে আমার ছবি তোলায় সেবারে কোনও ছেদ পড়েনি।
এরই মাঝে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। যা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। বাবার শুটিং হয়ে গিয়েছে, কলকাতায় ফিরে যাবে বাবা, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু গৌতমদার সঙ্গে যেসব মানুষ এতদিন আমাকে দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন, সত্যি বলতে, আমারও সেসব করতে চমৎকারই লাগছিল, তাঁরা বাবাকে বললেন, ‘আপনি কলকাতায় ফিরে যান। কিন্তু আপনার ছেলেটা আমাদের সঙ্গেই থাক। ওর সিনেমার ব্যাপারটায় বেশ আগ্রহ রয়েছে। আমাদের ওকে লাগবে।’
বাবা ফিরে গেলেন। রয়ে গেলাম আমি। যে দু’-তিন রোল ছবি তুলেছিলাম, তার মধ্যে একটা গৌতম ঘোষের এই ছবিটা, যা আজকের লেখার সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন আপনারা।
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এখনও আমার কাছে গৌতমদার অত্যন্ত প্রিয় ফিল্ম। যে ফিল্ম-শুটিং আমাকে ধরিয়েছিল ক্যামেরা। কানে কানে বলেছিল, আলো ক্রমে আসিতেছে…
(চলবে)
…ফ্রেমকাহিনির অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved