
গবেষকদের মতে, কাটোয়ার কার্তিক পুজো শুরু হয়েছিল বারবণিতাদের আরাধনার মধ্যে দিয়ে। নানা প্রদেশের বণিকরা বিকিকিনির সূত্রে কাটোয়ায় আসতেন। তাঁদের এবং ধনাঢ্য দেশীয় বণিক জমিদার প্রমুখের প্রশ্রয়ে কাটোয়ায় বারবণিতা-পল্লি গড়ে ওঠে। সেই থেকে কাটোয়ায় যেমন কার্তিক পুজোর শুরু হয়েছিল; তেমনই নানা প্রদেশের বণিকদের আগমনে সাংস্কৃতিক সূত্র ধরে কাটোয়ায় ‘থাকা’ নামক শিল্পটির উদ্ভব হয়েছিল। কেননা থাকার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় নবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘গোলু’ বা ‘কোলু পুতুল’ সজ্জার প্রচুর মিল আছে।
১০.
সিংহাসনে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন রাজা। আকর্ণ চক্ষুদ্বয়। বাবরি চুল ঘাড়ে এসে ফেঁপে উঠেছে। মোটা পাকানো গোঁফে ব্যক্তিত্বের বিচ্ছুরণ। গায়ে ঝলমলে রাজকীয় পোশাক। মাথায় মুকুট। ডান হাতে ধরেছেন গোলাপ ফুল। কবজি থেকে ঝুলছে সেরখানেক মুড়ির নাড়ু। বাম হাত আলতো করে কোলে ন্যস্ত। রাজার দু’ পাশে দুই রাজনর্তকী বা সখি। তাদের দেহবিভঙ্গে উতরোল যৌবনের ঝিলিক।
ধাপে ধাপে নেমে আসা দু’ পাশের ধাপিতে আসীন চার জোড়া রাজার ভাই। একই রকমের দেখতে হলেও আকারে-প্রকারে ছোট। পোশাক-আশাক ভিন্ন রীতি ও রঙের।
মাঝখানে মঞ্চস্থ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের স্থির দৃশ্য। দুর্বিনীত দুঃশাসনের দু’ চোখে ক্রূরতা ও লেলিহান কাম-অনল। বসন ভূলুণ্ঠিত অসহায় যাজ্ঞসেনীর বিষাদময় মুখাবয়ব। অদূরে মৃদুহাস্যে কৃষ্ণ। পিতামহ ভীষ্ম, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সূতপুত্র কর্ণ। নতমস্তকে পঞ্চপাণ্ডব। প্রতিবাদী বিকর্ণের আরক্তিম দু’ চোখে ক্রোধের উদ্ভাস। নিচে আরেকটি মিনিয়েচার কার্তিক।

লোকপ্রযুক্তি ও প্রতিমাশিল্পের অনন্য যুগলবন্দী এই ‘রাজা কার্তিক’। দেশীয় যাত্রাপালা ও দক্ষিণি পুতুলশিল্পের প্রভাবযুক্ত ঐতিহ্যবাহী ‘থাকা-কার্তিক’। কাটোয়ায় কার্তিক লড়াইয়ের রঙিন আলোকোজ্জ্বল প্রচ্ছদ।
‘থাকা’ শব্দটির উৎস সম্ভবত ‘স্তবক’। অর্থ– শ্রেণি বা সিঁড়ি কিংবা ধাপি। বাঁশ-নির্মিত ধাপি যুক্ত এমন একটি গ্যালারি, যা দেখে লোকশিল্পীদের প্রতিভাকে বাহবা দিতে হয়। ঠিক যেন এক প্যাঁচ-সিড়ি। উপরে চাতাল। রেলিং-যুক্ত গ্যালারির চার-পাঁচ কিংবা ছয়টি ধাপি-যুক্ত সিঁড়ি নিচে নেমে এসেছে। চাতালের পিছনে অর্ধবৃত্তাকার ফ্রেম। প্রতিটি ধাপিতে পাঁচটি করে পুতুলের সজ্জা। উচ্চতা সর্বাধিক ১৩ থেকে ১৪ ফুট। ছয় ধাপি-যুক্ত গ্যালারিতে অন্তত ৩০ থেকে ৩২টি প্রতিমা-পুতুলের প্রদর্শনী।
থাকা-র উদ্ভব কাটোয়ায়। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে কাটোয়ার গ্রামগঞ্জে, দাঁইহাটের রাসে এবং নদিয়ার কালীগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে। থাকায় তিন শ্রেণির পুতুলের প্রদর্শনী উল্লেখযোগ্য। গ্যালারির চাতালে অবস্থিত দেবতার নামে থাকার মূল পরিচিতি– রাজা কার্তিক বা ভাই কার্তিক, কাত্যায়নী কার্তিক, গণেশ জননী, কৃষ্ণকালী, হরগৌরী ইত্যাদি। কাটোয়াতে বেশিরভাগ থাকা রাজা কিংবা কাত্যায়নী-যুক্ত।

থাকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য– গ্যালারির দু’ দিকে ধাপে ধাপে দণ্ডায়মান সখির উপস্থিতি। ধাপ অনুযায়ী সখির সংখ্যা নির্ধারিত। পাঁচ ধাপির ক্ষেত্রে দু’ ধারে পাঁচটি করে ১০টি, কিংবা ছয় ধাপির হলে ১২টি। সখিরা সুসজ্জিত। খোঁপা করা চুল। কেশসজ্জায় টিকলি এবং টায়রা। নাকে নথ। করজোড়ে, নৃত্যরতা কিংবা কুম্ভ-কাঁখে ইত্যাদি বিশেষ কয়েকটি ভঙ্গিতে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন।
রাজা কার্তিকের ক্ষেত্রে এই সজ্জার ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। রাজা কার্তিকের কাছে দু’ দিকে দু’টি সখি। বাকি সখিদের পরিবর্তে চারটি করে দু’ পাশে ৮টি বা ১২টি রাজা। এরা ‘কার্তিকের ভাই’ নামে পরিচিত। কাটোয়ার ‘সাতভাই’ কার্তিকের আঙ্গিকটি অভিনব। এখানে তিনটি করে দু’ পাশে ছয়টি এবং চাতালে একক কার্তিকের অবস্থান। সবগুলি ‘ভাই’ নামে পরিচিত। এখানে সবটাই ‘ভাই-কার্তিক’-এর দৃষ্টান্ত। সখির কোনও ভূমিকা নেই।
কাত্যায়নী থাকা কাটোয়ায় বেশি। উপরের চাতালে থাকেন দ্বিভূজা বা অষ্টভূজা কাত্যায়নী। তিনি জোড়া সিংহের উপরে ভদ্রাসনে আসীন। ডান হাতে বরদমুদ্রা। বাম হাতে ধরে রেখেছেন শিশু কার্তিক বা যোদ্ধা কার্তিকের ক্ষুদ্র মূর্তিকে। অষ্টভুজার ক্ষেত্রে বাকি হাতগুলিতে প্রচলিত আয়ূধাবলী।

গ্যালারির উপর এবং দু’ ধারের প্রচলিত পুতুলবিন্যাস ব্যতিরেকে মাঝখানে সজ্জিত ‘পালার পুতুল’। ৩২টি পুতুলের থাকা হলে, ১৮টি পুতুলের মধ্যে দিয়ে পালা উপস্থাপনা প্রথাবদ্ধ রীতি। সেক্ষেত্রে ৬ ধাপে ৩টি করে পুতুল সাজানো নিয়ম। প্রতিটি পুতুলই আবক্ষ বা বসা। কিন্তু মুখের ভাবভঙ্গি এবং পোশাকের সজ্জা, পুতুল বসানোর টেকনিক দেখে মনে হবে, তারা কেউ দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। থাকায় প্রতিমার মুখমণ্ডলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পালার বিষয়বস্তু মহাকাব্য পুরাণ, মঙ্গলকাব্য, চৈতন্য জীবনীচরিত কিংবা ফোক ন্যারেটিভ। সিন্ধুবধ, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, সীতাহরণ, কর্ণবধ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, কামরূপ কামাক্ষ্যা, কৃষ্ণকালী, শিবের বিয়ে, নিমাইসন্ন্যাস ইত্যাদি। সামাজিক পালাও যে হয় না তা নয়, তবে খুবই অল্প। ‘লকডাউন’ নিয়েও পুতুল-পালা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে অবশ্য উপরের এবং দু’ ধারের প্রচলিত পুতুল বিন্যাসের কোনও হেরফের হয় না।
প্রতি বছর পালার বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব আসে। সেই কারণে নানা ধরনের পুতুল তৈরি করা মৃৎশিল্পীদের কাছে মস্ত চ্যালেঞ্জ। পালার বিষয়বস্তু এবং চরিত্র নির্বাচন করেন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ইনি ‘পালাকার’ নামে সুপরিচিত। অভিজ্ঞ ব্যক্তি, অধ্যাপক কিংবা গবেষকরাই সাধারণত পালাকার হন।

থাকার লোকপ্রযুক্তি অসাধারণ বললেও কম বলা হবে। নির্দিষ্ট কাঠামো-শিল্পীরা বংশানুক্রমিক ভাবে থাকা বাঁধেন। এঁরা ‘বাঁশের-কারবারি’ নামে খ্যাত। প্রথমে সূত্রধরেরা ৮টি করে ১৬টি শাল বা নিমকাঠের রলা আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি বিন্যস্ত করে আয়তাকার ফ্রেমটি তৈরি করেন। কাঠের রলায় নির্দিষ্ট ছিদ্র করে তাঁদের দায়িত্ব শেষ।
নতুন করে থাকা বাঁধতে হলে প্রায় ১৫টি বাঁশ লাগে। বাঁশ ফাটিয়ে ছোট-বড় মাপের কাবারি করে উপরের ফ্রেমটি তৈরি হয় নিপুণ হাতে। বাঁধন হিসাবে সুতলি দড়ির প্রয়োজন। তিনজন করে শিল্পী পাঁচ দিন ধরে থাকা বেঁধে শেষ করেন। এঁদের আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকে। থাকে নির্দিষ্ট স্থানে পুতুল বসানো এবং নগর পরিক্রমার শেষে নামানোর দায়িত্ব। থাকা বাঁধার মজুরি অন্তত পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
প্রতিমাশিল্পীর কাজটিও কঠিন। তবে এ কাজে কাটোয়ার কুমোরটুলির শিল্পীরা বরাবর সিদ্ধহস্ত। কাটোয়ার কুমোরটুলি বহু প্রাচীন। অনেক প্রথিতযশা শিল্পী এ-কাজে বংশ পরম্পরায় যুক্ত। প্রয়াত দুর্গা পাল এবং তাঁর পুত্ররা– তিনকড়ি পাল, লক্ষ্মণ পাল, শ্যাম পাল, ধনঞ্জয় পাল প্রমুখ দীর্ঘদিন ধরে এ-কাজ করছেন। থাকার প্রতিমা হালকা হবে; এবং চরিত্র অনুযায়ী তার মুখমণ্ডল হওয়া চাই। শিল্পীরা ছাঁচে তোলা আর হাতে গড়া– দু’ ধরনের মুখই ব্যবহার করেন। তাঁরা পুতুল প্রতি গড়ে কম-বেশি হাজার টাকা মজুরি পান।

প্রতিমা সাজান নির্দিষ্ট পোশাক-শিল্পী। তাঁরা চরিত্র অনুযায়ী পোশাক তৈরি করেন। বাজার থেকে নানা রঙের কাপড় কিনে এনে দরজির কাছে কাটিয়ে নেন। এরপর পুঁতি-চুমকি-জরি ইত্যাদি বসিয়ে কাঙ্ক্ষিত রূপটি দেন। পৌরাণিক পুরুষের রকমারি গোঁফ তাঁদের অনবদ্য সৃষ্টি। বাজার থেকে শন কিনে, কালো রঙে চুবিয়ে, কাঠিতে জড়িয়ে নানা স্টাইলের চুল তাঁরাই তৈরি করেন এবং বসান। এঁরা মূলত যাত্রার রূপসজ্জা ও পোশাক-শিল্পী। অতীতে বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন ধর্মদাস মহান্ত। বর্তমানে মোতি শেখ এবং তাঁর পুত্র এ-কাজে নামকরা শিল্পী। তাঁদের মজুরিও কম করে সাত থেকে দশ হাজার টাকা।
কর্মকাররা থাকার জন্য তৈরি করেন লোহার-গাড়ি। আট ফুট লম্বা আয়তাকার লোহার গাড়িতে চারটি চাকা লাগানো। সামনে ফুট চারেক লম্বা ‘T’ আকৃতির হ্যান্ডেল। গাড়ির মাঝে গোলাকার বিয়ারিং। তার উপরে বসানো থাকাটি। শোভাযাত্রায় হ্যান্ডেল ধরে টানলে গাড়ি চলে গড়গড়িয়ে। মাঝেমাঝে থাকার কোনাটি ধরে দর্শকদের উদ্দেশে ঘোরানো হয়। আগেকার দিনে তিন সাঙার বাঁশ বেঁধে প্রায় ৪০ জন বেহারা থাকা কাঁধে চাপিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করতেন।
থাকায় লাগে ৩০ থেকে ৪০টি সাদা টিউবলাইট। নানারকম জ্যামিতিক বিন্যাসে টিউবলাইট সজ্জার উদ্দেশ্য হল– থাকার প্রতিটি মুখমণ্ডলে যেন যথাযথ আলো পড়ে। এছাড়া ক্যাতায়নী বা রাজা কার্তিকের মাথার পিছনে রঙিন আলোর ঘূর্ণনচক্র বাড়তি আকর্ষণ। থাকার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানা বর্ণের পতাকা দৃশ্যমান। সবমিলিয়ে থাকার উপস্থাপন জমজমাট ও আকর্ষণীয়।

কাটোয়ার থাকা ঐতিহ্যবাহী হলেও তার উদ্ভব সম্পর্কে কোনও ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ কাটোয়ার ইতিহাস অতি প্রাচীন। মধ্যযুগে গঙ্গা-তীরবর্তী কাটোয়া প্রাচীন ইন্দ্রাণী নগরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দশনামি সন্ন্যাসীদের ভারতী সম্প্রদায়ের আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন কাটোয়াতে। এই আশ্রমের কেশবভারতীর কাছে নবদ্বীপের শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস-দীক্ষা নিয়ে পরিচিত হয়েছিলেন ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ নামে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে ‘মুর্শিদাবাদের প্রবেশদ্বার’ ছিল কাটোয়া। কাটোয়ার উল্টোদিকে শাঁখাই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় কাটোয়া-দুর্গ।
পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি কাটোয়ার আমবাগানে রবার্ট ক্লাইভ নিয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতক থেকে কাটোয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলটি বর্গি-হাঙ্গামার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৮০৪ সালে কাটোয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাপটিস্টদের মিশন। কাটোয়ার পরিচিতি ইউরোপীয় পরিমণ্ডলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘আদি কাটোয়া’ বলতে বর্তমান গাঙ্গেয় বড়বাজার অঞ্চলটিকে বোঝায়। এখানেও আজও থাকার আধিক্য চোখে পড়ার মতো। চাউলপটি, খড়ের বাজার, বড়বাজার, শাঁখারিবাজার, কলাইপটি, তাঁতিপাড়া– সব মিলিয়ে প্রায় ১২-১৪টি থাকা আসে। অতীতে সংখ্যাটি বলাবাহুল্য আরও বেশি ছিল। থাকার জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে কাটোয়ায় জন্মাষ্টমী উপলক্ষে একসময় ‘মানুষ-থাকা’-র পর্যন্ত প্রদর্শনী হত। বর্তমানে ঐতিহ্যবোধের অভাব, দর্শকের রুচি পরিবর্তন এবং ব্যয়বাহুল্য ইত্যাদি কারণে থাকা-শিল্প সংকটের মুখে। একটি থাকার উপস্থাপনেই প্রায় লক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন পড়ে।

গবেষকদের মতে, কাটোয়ার কার্তিক পুজো শুরু হয়েছিল বারবণিতাদের আরাধনার মধ্যে দিয়ে। নানা প্রদেশের বণিকরা বিকিকিনির সূত্রে কাটোয়ায় আসতেন। তাঁদের এবং ধনাঢ্য দেশীয় বণিক জমিদার প্রমুখের প্রশ্রয়ে কাটোয়ায় বারবণিতা-পল্লি গড়ে ওঠে। সেই থেকে কাটোয়ায় যেমন কার্তিক পুজোর শুরু হয়েছিল; তেমনই নানা প্রদেশের বণিকদের আগমনে সাংস্কৃতিক সূত্র ধরে কাটোয়ায় ‘থাকা’ নামক শিল্পটির উদ্ভব হয়েছিল। কেননা থাকার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় নবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘গোলু’ বা ‘কোলু পুতুল’ সজ্জার প্রচুর মিল আছে।
নবরাত্রি উপলক্ষে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক প্রভৃতি প্রদেশের বিজোড়-সংখ্যক ধাপিতে টেরাকোটা, কাঠ ইত্যাদির পুতুলসজ্জার প্রদর্শন প্রচলিত প্রথা। ‘গোলু’, ‘কোলু’ বা ‘গোম্বে হাব্বা’ বিবিন্ন নামে পরিচিত হলেও মূল অর্থ হল পুতুল প্রদর্শনী। আকারে ছোট সাইজের পুতুলগুলি থাকায় বসিয়ে মহালয়া অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত চলে প্রদর্শনী।
দু’ ধরনের গোলু দেখা যায়– দেবতা-কেন্দ্রিক ও রাজা-কেন্দ্রিক। দেবতা-কেন্দ্রিক গোলুর উপরের ধাপে থাকে দেবলোক অর্থাৎ বিভিন্ন দেবদেবীর পুতুল। মাঝে সাধুলোক অর্থাৎ মুনি, ঋষি, মহাপুরুষের পুতুল বা স্ট্যাচুর সজ্জা। নিচের ধাপে দৃশ্যমান পৃথিবীলোক অর্থাৎ জনজীবনের নানা ধরনের প্রতিচ্ছবি এবং খেলনা বাসনোকোসনের সম্ভার। রাজা-কেন্দ্রিক গোলুর চাতালে থাকে রাজা ও রানি। এদেরকে বলে ‘মরপাচী’ পুতুল। সাধারণত এই পুতুলদ্বয় আকারে বড় এবং কাঠের তৈরি।

কাটোয়া অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে নানা প্রদেশের বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এসেছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ স্থায়ীভাবে নাড়া বেঁধেছেন। আজও কাটোয়া অঞ্চলে বহিরাগত অনেক মাড়োয়ারি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শুধু বর্তমানকালে নয়, অতীতেও, বিশেষ করে চতুর্দশ শতকে জৈন বণিকরা কাটোয়া অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। তার প্রমাণ মিলেছে তাম্রলেখ থেকে। আসলে সেটি শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের নবরাত্রি উপলক্ষে পূজিত নবপদ বা সিদ্ধচক্র। এটির পাঠোদ্ধার করেছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
সুতরাং কাটোয়ার থাকায় পুতুলনাচের কোনও ভূমিকা নেই; বরং গোলু বা কোলু থেকেই তার উদ্ভব। পরে যাত্রাশিল্পের অপ্রতিহত প্রভাব পড়ে স্থানীয় পালাকার, পোশাক-শিল্পী প্রমুখের মধ্যস্থতায়। কাটোয়া অঞ্চল এমনিতেই যাত্রা, পাঁচালি ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত। উনিশ শতকে কাটোয়ায় বিখ্যাত সব যাত্রাদল ছিল। অধিকারী ভাইদের নাম আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..
পর্ব ৯: শিশুঘাতক থেকে কেন শিশুরক্ষক দেবতা হয়ে উঠলেন কার্তিক?
পর্ব ৮: তেনাদের পুজো, তেনাদের মেলা-মোচ্ছব
পর্ব ৭: প্রেত মানেই ভূত বা অতীত, কিন্তু সকল প্রেতই ভূত নয়!
পর্ব ৬: কেবল কালী নন, লৌকিক লক্ষ্মী ঠাকরুনও দাঁড়ান স্বামী নারায়ণের বুকে পা রেখেই
পর্ব ৫: মহিষাসুরমর্দিনী নন, কৃষিপ্রধান বাংলায় আদিপূজিতা ছিলেন শস্যদেবী নবপত্রিকা
পর্ব ৪: পুকুরের দেবতা পুকুরের ভূত
পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস
পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর
পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved