অফিস ইউনিয়নে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব বা শিক্ষক আন্দোলনে তাঁদের অংশগ্রহণ কি তাঁদের নিজস্ব প্রয়োজন, দাবি-দাওয়া জানানোর পরিসর তৈরি করতে পেরেছিল? তাঁরা মহিলা হিসাবে কতটা সরব ছিলেন, আর তাঁদের রাজনীতিতে কতটা মুখ্য ছিল তাঁদের কর্মী পরিচয়? তাঁদের উপস্থিতি কী সে যুগের কর্মচারী ইউনিয়নের পুরুষতান্ত্রিকতাকে সামান্য হলেও বিচলিত করতে পেরেছিল? তাঁদের কথা কতটা ভেবেছিল তৎকালীন রাজনৈতিক দল, কর্মী ও শ্রমিক সংগঠনগুলি?
২১.
সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে চাকুরিরতা মহিলারা কি অফিস ইউনিয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন? মহিলা হিসাবে তাঁদের দাবি-দাওয়া, প্রয়োজনকে কি গুরুত্ব দিতেন কর্মী সংগঠনের নেতারা? অফিস পরিসরের বাইরে, চাকরি সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া নিয়ে কি পথে নেমেছিলেন প্রথম যুগের চাকুরিরতারা? তাঁদের পাশে কি তাঁরা কখনও পেয়েছিলেন কোনও রাজনৈতিক দলকে? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি আমরা আজকের লেখায়। কারণ, সে যুগের মহিলাদের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা বুঝতে জরুরি তাঁদের রাজনৈতিক জীবনকে বোঝা।
দেশভাগের পরপরই পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকেরা বেতন ও মহার্ঘ্য ভাতা বাড়ানোর দাবিতে বিরাট আন্দোলন করেন। তখন ১৯৫৪ সাল। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দুই শিক্ষক-শিক্ষিকা– সত্যপ্রিয় রায় ও অনিলা দেবী। অনিলা দেবী ছাড়াও বহু শিক্ষিকা শামিল হয়েছিলেন আন্দোলনে। দশ দিন রাজপথে কাটিয়েছিলেন তাঁরা, মিছিল করেছিলেন, ব্যারিকেড ভেঙেছিলেন, বাধ্য করেছিলেন সরকারকে তাঁদের দাবি মেনে নিতে। রাজ্যসভার আলোচনা থেকে জানা যায় ১৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৪) যে ২৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৫০ জন মহিলা।
তবে, এই ধরনের মুহূর্ত বোধহয় ব্যতিক্রম। আমাদের গবেষণা থেকে বুঝেছি ১৯৪৭ পরবর্তী প্রথম দুই-আড়াই দশকে, বিভিন্ন অফিস ইউনিয়নের কাজে সক্রিয় ভূমিকায় মেয়েরা ছিলেন বিরল। তবে ইন্ডিয়ান ইয়ারবুকের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় ট্রেড ইউনিয়নে মেয়ে সদস্যের সংখ্যা বাড়ছে। ১৯২৭-২৮-এ সমস্ত সদস্যদের মধ্যে ১.২% ছিলেন মহিলা, ১৯৪৭-৪৮-এ ৬.৮%, ১৯৬৩-৬৪-তে ৮.৮%। এইটুকু তথ্য থেকে অবশ্য রাজনীতিতে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা কতখানি বেড়েছিল, তা অনুমান করা সম্ভব নয়। গীতিকা মিত্র ১৯৬৪ সালে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে চাকরিতে ঢোকেন। তাঁর কাছে শুনি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে কেবল একজন মহিলাই ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন।
রাজনীতি-মনস্ক কবিতা চৌধুরী জীবন বীমা কোম্পানিতে (লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া) যোগ দেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার দিন চারেক পরেই টেবিলে তিনি পান একটা লিফলেট আর ব্যাচ। লিফলেটের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ায় তিনি তৎক্ষণাৎ ব্যাচটা পরে ফেলেন। কিন্তু এক প্রবীণ সহকর্মী যখন তাঁকে ব্যাচটা খুলে রাখতে বলেন, কবিতা মেনে নিয়েছিলেন। কথা প্রসঙ্গে অবশ্য কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেন, এই মেনে নেওয়ার পিছনে সম্মতি নয়, সহকর্মীর প্রতি সম্মান দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু কিছুদিন পরে বাম ইউনিয়নের (CDLA) ডাকা এক ঘণ্টার প্রতীকী ধর্মঘটে কবিতা যোগ দেন। তখনও তিনি প্রোবেশন পিরিয়ডে, এবং ধর্মঘটে যোগ দেওয়া একমাত্র মহিলা।
এল আই সি-তেই আজীবন চাকরি করেছেন চন্দ্রশেখর বসু। সক্রিয় রাজনীতিও করেছেন তিনি। তাঁর যতদূর মনে পড়ে পাঁচের দশকের শেষের দিকে মহিলারা প্রথম এল আই সি-তে আসেন, মেশিন বিভাগে। প্রথম চাকুরিরতাদের মধ্যে কেউ কেউ ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের সক্রিয় ভূমিকার কথা স্মৃতিতে নেই চন্দ্রশেখর বাবুর। তিনি আমাদের বলেছেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল মেয়েদের সংসার চালিয়ে ইউনিয়নের কাজ করার সময় সুযোগ পাওয়া মুশকিল। আমরা তাই কোনও চেষ্টাও করিনি, এনকারেজমেন্টও দিইনি।’ ১০০ পেরিয়ে আজ বুঝি একটু আক্ষেপই হয় তাঁর। তবে তাঁর কাছে শুনি ১৯৭৮-এর একটি ঘটনা। এল আই সি-র ইউনিয়নের সর্বভারতীয় কনফারেন্সে বি টি রনদিভেকে ভাষণ দিতে ডেকেছিলেন তাঁরা। রণদিভে জানতে চান তাঁদের এই সম্মেলনে কতজন মহিলা প্রতিনিধি। একজনও মহিলা নেই শুনে যারপরনাই অসন্তুষ্ট হন তিনি। প্রত্যাখ্যান করেন আমন্ত্রণ। স্পষ্ট বলে দেন ইউনিয়নের প্রায় ২০% সদস্য মহিলা হওয়া সত্ত্বেও যে অনুষ্ঠানে কোনও মহিলা প্রতিনিধি নেই, সেখানে তিনি যাবেন না। এই ঘটনার পর আমন্ত্রিতের তালিকায় মহিলাদের রাখা হয়, এবং প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে ইউনিয়নের চিন্তা-ভাবনাও বদলায়। ততদিনে অবশ্য এলআইসি-র বাম ইউনিয়নের মহিলা সদস্যদের মধ্যে অনেকেই সক্রিয় ভাবে সংগঠনের কাজে অংশ নিতে শুরু করেছেন। কবিতা চৌধুরী ছিলেন তাঁদের একজন। রাজনীতি-সচেতন কবিতা ইউনিয়নের সমর্থক থেকে সদস্য হন মেশিন বিভাগের মহিলাদের উৎসাহে। এই বিভাগের ৪০জন মহিলার মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন বাম সংগঠনের সদস্য। তবে তাঁর ডিপার্টমেন্টে, কেন্দ্রীয় ক্যাশ কালেকশন সেন্টারে প্রভাব ছিল কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন বয়স্ক পুরুষদের। তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপকে উপেক্ষা করে কবিতা আস্তে আস্তে হয়ে ওঠেন ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। সময়টা সাতের দশকের মাঝামাঝি।
’৫০-’৬০ দশকের কিছু গল্প, উপন্যাস, সিনেমাতে মাঝেমধ্যে আমরা দেখি রাজনীতি সচেতন, সক্রিয় চাকুরিরতাদের। সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দুই ভাই’ (১৯৬১) ছবিতে আমরা পাই মাধুরীকে। মাধুরী উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে, অভাবের সংসারের সব দায় তার ওপর। কারখানায় প্যাকিং-এর কাজ, টিউশনের মাঝেও সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পার্টির অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। ঘরে-বাইরে প্রতিদিনের নানা চাপের মধ্যে ওই রাজনীতিটুকুই তাকে বাঁচার অবকাশ দিয়েছে। প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও তার ওই রাজনীতির সূত্রে। প্রেমিকের দাদা তাকে বলে, ‘রাস্তার নোংরা মেয়ে’। তাতেও সে দমে না। বলে, ‘আমরা রিফিউজি মেয়ে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আমাদের মান-লজ্জা সব ভেঙে গেছে। সারা ছোটবেলা রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে কেটে গেছে। এত সহজে আমাদের কষ্ট হয় না।’
১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় হিরেন নাগ পরিচালিত ছবি ‘থানা থেকে আসছি’। সেই ছবিতে এক জায়গায় দেখি দয়াময়ী কনসার্নের মহিলারা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে স্ট্রাইক করছেন। এই দাবি ন্যায্য– সেকথা মানতে নারাজ দয়াময়ীর মালিক শ্রী সেন। মেয়েদের চাকরি করা ও সেখানে শ্রমের অধিকার দাবি করার নৈতিকতাকে খুব সহজেই অস্বীকার করে তিনি একে দাক্ষিণ্য হিসাবে চিহ্নিত করেন। বলেন, ‘রাস্তায় রাস্তায় না খেতে পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ডেকে এনে চাকরি দিয়েছি তাই মাথায় চড়ে বসেছে’। ‘মাথায় চড়ার’ শাস্তিস্বরূপ চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সন্ধ্যা চক্রবর্তীকে।
চাকরি চলে যাওয়ার ভয় তো নিশ্চয়ই গরিব বাড়ি বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের সক্রিয়ভাবে সংগঠন করার পথে বাধা ছিল– বিশেষ করে সে সময়ের সরকার-বিরোধী বামপন্থী সংগঠন। এছাড়া সংসার সামলে, অফিস করে হাতে তাঁদের সময়ই বা থাকত কতটুকু। অগ্রদূত পরিচালিত ১৯৫৫-র ছবি ‘অনুপমা’। বালবিধবা অনুপমা চাকুরিরতা। তার প্রেমিক অফিস আন্দোলনের লড়াকু নেতা। সে চায় রাজনীতির কাজে অনুপমাকে সর্বক্ষণ পাশে পেতে। সংসারের চাপে অনুপমা তা পারে না। চিড় ধরে প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কে।
এসবের মধ্যেই অবশ্য রাজনীতি-মনস্ক মেয়েরা নানাভাবে সময় বার করতেন– তা সে অফিসের সংগঠনের জন্যই হোক বা বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্যই হোক। জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘মেয়েলি জীবন, ভাগাভাগির পরের যুগ’ আমরা যেমন পাই ছবি দাসের কথা। ১৯৩৫-এ জন্ম তাঁর, ১২ বছর বয়সে আসেন কলকাতায়। স্কুলে কেরানির চাকরি করতেন। তিনি বলেন,
‘স্বামীরেও ভয় পাই নাই কোনও দিন। প্রথম ভোট দিই বিয়ার পরে। মিটিং-মিছিল খুব করতাম। একবেলা রাইধ্যা থুইতাম, দুইবেলা খাইতাম। মিটিংয়ে বাইরাতাম। ছবিদি যাবা? কইলেই যাইতাম। স্বামী পচ্ছন্দ করত না। একখানা পোস্টার লাগাইতে দিত না ঘরে। বাবাও কোনও দিন এ সব করে নাই। যারে ভোট দিবে, তারেই দিত। আমরাই একটু পাল্টি খাইয়া গেলাম…’
মিটিং-মিছিলের শহর হয়ে ওঠা দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতায় ছবি দাসদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। উদ্বাস্তু আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন বা খাদ্য আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক মেয়েরা যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য ১৯২০-র দশক থেকে গান্ধিবাদী রাজনীতি ও বিশ্বযুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা বিদ্ধস্ত সময়ে বামপন্থী রাজনীতিতে মেয়েদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তবে চাকরিজীবী মেয়েদের রাজনীতিতে তাঁদের ‘মহিলা’ ও ‘চাকুরিরতা’ এই দুই সত্তার কতটা মেলবন্ধন হয়েছিল সে প্রশ্ন রয়ে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, অফিস ইউনিয়নে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব বা শিক্ষক আন্দোলনে তাঁদের অংশগ্রহণ কি তাঁদের নিজস্ব প্রয়োজন, দাবি-দাওয়া জানানোর পরিসর তৈরি করতে পেরেছিল? তাঁরা মহিলা হিসাবে কতটা সরব ছিলেন, আর তাঁদের রাজনীতিতে কতটা মুখ্য ছিল তাঁদের কর্মী পরিচয়? তাঁদের উপস্থিতি কী সে যুগের কর্মচারী ইউনিয়নের পুরুষতান্ত্রিকতাকে সামান্য হলেও বিচলিত করতে পেরেছিল? তাঁদের কথা কতটা ভেবেছিল তৎকালীন রাজনৈতিক দল, কর্মী ও শ্রমিক সংগঠনগুলি?
কেউ কেউ যে ভেবেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে সে যুগের লেখালিখি, বিধানসভার তর্কাতর্কিতে। বিধানসভার অধিবেশনে (৪ জুলাই ১৯৫২) বিভিন্ন স্তরের মেয়েদের জীবিকার উপায় তৈরি করার দাবি জানিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন। পুরুষ ও মহিলার মধ্যে কাজের বৈষম্য আর মেয়েদের যথেষ্ট কাজের সংস্থান না করার জন্য তিনি সরকারকে তিরস্কার করেছিলেন। নার্সের চাকরি দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল, শিক্ষকতা করার জন্য পর্যাপ্ত স্কুলের অভাবও তিনি তুলে ধরেন। স্পষ্ট নারীবাদী অবস্থান ছিল তাঁর। ফুলরেণু গুহ, অশোকা গুপ্ত, রেণুকা রায়ের মতো মানুষও ছিলেন– মেয়েদের কর্মসংস্থান নিয়ে তাঁরা ভাবতেন, কাজ করতেন। মেয়েদের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করাতে কিছু মহিলা সংগঠনও জোর দেয়। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। রাজনৈতিক কর্মী ছবি বসু তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন– ‘সেখানে আত্মরক্ষা সমিতির পরিচালনায় দুপুরের দিকে একটা এডাল্ট এডুকেশনের ক্লাস হতো।… বয়স্ক মেয়েরা সাধারণত বস্তিবাসী রঙ মিস্ত্রী, ছুতোর মিস্ত্রী, কল মিস্ত্রীদের বৌ-রা, নয়ত খুচরো দোকানদারদের বৌ মেয়ে, আর বেশীরভাগ ছিল ঠিকে ঝি। এদের বাংলা অক্ষরপরিচয় হবার পর, যেটা আমরা সব সময় জোর দিতাম, সেটা হচ্ছে দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা, কীভাবে সাম্যবাদী দেশের মেয়েরা নিজেরাই দেশ গড়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে, এ সব বিস্তারিত আলোচনা।’
তবে নারীবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে সময় লেগেছিল আরও বেশ কিছু দশক। ১৯৪০-৫০-এর দশকে বিভিন্ন কারখানায় মেয়েদের ছাঁটাই, পুরুষদের অতিরিক্ত মদ্যপান, যৌন হেনস্থা– এই ধরনের কোনও বিষয়েই শ্রমিক ইউনিয়নগুলি সরব হয়নি। অফিসে চাকরি করা মহিলা, ‘টুওয়ার্ডস ইকুয়ালিটি রিপোর্ট’ যাঁদের সার্ভিসেস অ্যান্ড প্রফেশনের অন্তর্ভুক্ত করছে, তাঁদের সংগঠিত করা বা কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সমান অধিকারের লড়াই নিয়ে মাথাব্যথা ছিল আরও কম।
এই প্রসঙ্গে আমরা কথা বলি সিআইটিইউ-এর কলকাতা জেলার সভাপতি দেবাঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন এই যুগের কাজের জায়গায় মেয়েদের বিশেষ অসুবিধার প্রসঙ্গকে যথাযথ মূল্য দেওয়া হয়নি। মনে করিয়ে দেন যে শ্রম আইনের বিবর্তন দেখলেই এই কথা স্পষ্ট হয়ে যায়। ভারতবর্ষে ফ্যাক্ট্রিস আইন আসে ১৯৪৮-এ কিন্তু মেটার্নিটি বেনিফিটের মতো আইন আসতে আরও এক দশকেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়। সমান কাজের জন্য সমান বেতন (ইকুয়াল রেম্যুনারেশন এক্ট) আসে তারও কত পরে। তবে এই অনুপস্থিতির বয়ানের মধ্যেও পাওয়া যায় এমন মানুষদের কথা যাঁরা মেয়েদের কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন, মেয়েদের নিয়ে ভেবেছেন।
১৯৭০-৮০-র দশককে স্বাধীন ভারতবর্ষে নারী আন্দোলনের সুত্রপাত বলেই সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করতেন। এই মত অনুযায়ী ১৯৫০-৭০, এই দুই দশক নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একরকম নিষ্ক্রিয় সময়। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা অবশ্য এই ধারণাকে প্রশ্ন করেছে। ছবি দাস, মণিকুন্তলা সেন বা কবিতা চৌধুরীরা মনে করিয়ে দেন, নারীবাদী আন্দোলন হয়তো নির্দিষ্ট গতি পায়নি দেশভাগ-পরবর্তী দুই দশকে, কিন্তু ছোট-বড় নানা লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে একটা ভাষা তৈরির প্রয়াস অবশ্যই শুরু হয়েছিল। আর এই ভাষার নির্মাণ যেমন হয়েছিল রাজপথের আন্দোলনে, তেমনই এসেম্বলি বিতর্কে, আর অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যেও।
সহায়ক প্রবন্ধ:
১. জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মেঘে ঢাকা অন্য তারারা’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
২. জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মেয়েলি জীবন, ভাগাভাগির পরের যুগ’, সেমন্তী ঘোষ (সম্পাদনা), ‘দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা’। গাংচিল, কলকাতা, ২০০৮।
৩. ছবি বসু, ‘ফিরে দেখা: একটি জীবনের কিছু চিত্র’, কলকাতা, ২০০৪।
৪. Neera Desai, ‘From Articulation to Accommodation: Women’s Movement in India’, in ‘Visibility and Power: Essays on Women in Society and Development’, ed. Leela Dube, Eleanor Leacock, and Shirley Ardener, Delhi: Oxford University Press, 1986।
৫. Report of the First National Commission on Labour 1969 | V. V. Giri National Labour Institute, Noida, Uttar Pradesh, India। https://share.google/GEEQjPaSW50aLoCvB
… পড়ুন চৌকাঠ পেরিয়ে কলামের অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ২০: অদক্ষ হলেও চলবে, কিন্তু মেয়েলি বৈশিষ্ট্য না থাকলে চাকরি পাওয়া ছিল দুষ্কর!
পর্ব ১৯: শৌচাগার নেই, এই অজুহাতে মেয়েদের চাকরি দেয়নি বহু সংস্থা
পর্ব ১৮: অফিসে মেয়েদের সখ্যকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিছক পরনিন্দা-পরচর্চার ক্ষেত্র মনে করেছিল
পর্ব ১৭: পুরুষ সহকর্মীদের ‘বন্ধু’ ভাবতে অস্বস্তি হত পাঁচ ও ছয়ের দশকের চাকুরিরতাদের
পর্ব ১৬: ট্রামের স্বস্তি না বাসের গতি, মেয়েদের কোন যান ছিল পছন্দসই?
পর্ব ১৫: অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শই শুধু নয়, চৌকাঠ পেরনো মেয়েরা পেয়েছিল বন্ধুত্বের আশাতীত নৈকট্যও
পর্ব ১৪: লীলা মজুমদারও লেডিজ সিট তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন!
পর্ব ১৩: অল্পবয়সি উদ্বাস্তু মহিলারা দেহব্যবসায় নেমে কলোনির নাম ডোবাচ্ছে, বলতেন উদ্বাস্তু যুবকরা
পর্ব ১২: মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবির মিঠুর মতো অনেকে উদ্বাস্তু মেয়েই চাকরি পেয়েছিল দুধের ডিপোতে
পর্ব ১১: প্রথম মহিলা ব্যাঙ্ককর্মীর চাকরির শতবর্ষে ব্যাঙ্কের শ্রমবিভাজন কি বদলে গিয়েছে?
পর্ব ১০: সেলসগার্লের চাকরিতে মেয়েরা কীভাবে সাজবে, কতটা সাজবে, তা বহু ক্ষেত্রেই ঠিক করত মালিকপক্ষ
পর্ব ৯: স্বল্পখ্যাত কিংবা পারিবারিক পত্রিকা ছাড়া মহিলা সাংবাদিকরা ব্রাত্য ছিলেন দীর্ঘকাল
পর্ব ৮: অভিভাবকহীন উদ্বাস্তু মেয়েদের ‘চিরকালীন বোঝা’র তকমা দিয়েছিল সরকার
পর্ব ৭: মেয়েদের স্কুলের চাকরি প্রতিযোগিতা বেড়েছিল উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর
পর্ব ৬: স্বাধীনতার পর মহিলা পুলিশকে কেরানি হিসাবেই দেখা হত, সেই পরিস্থিতি কি আজ বদলেছে?
পর্ব ৫: প্রেম-বিবাহের গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের লেডি ডাক্তাররা স্বাধীনতার নিজস্ব ছন্দ পেয়েছিলেন
পর্ব ৪ : নার্সের ছদ্মবেশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যৌন হেনস্তার কবলে পড়তে হয়েছিল
পর্ব ৩ : উদ্বাস্তু মেয়েদের রোজগারের সুযোগ মিলেছিল টাইপ-শর্টহ্যান্ডের কাজে
পর্ব ২ : পিতৃতন্ত্রের কাঠামোয় কিছু ফাটল নিশ্চয়ই ধরিয়েছিলেন সে যুগের মহিলা টেলিফোন অপারেটররা
পর্ব ১ : দেশভাগের পর ‘চঞ্চল চক্ষুময়’ অফিসে চাকুরিরত মেয়েরা কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved