ডায়লগ বা টাইটেল নিয়ে, সেন্সর চোখ রাঙালে, ক্ষুরধার যুক্তি কোন্ডকের: যাদের ১৮ বছর হয়নি, তারা এসব বুঝবে না; আর, যাদের ১৮ হয়ে গেছে, তারা নিশ্চয়ই মজা পাবে। প্রোডিউসার’স অ্যাসোসিয়েশনে, একটা টাইটেল রেজিস্ট্রি করেছিলেন তিনি, ‘ম্যায় দেতি হুঁ তু লেতা যা’। নিজেরই ফিল্ম ‘তেরে মেরে বিচ মে’-তে নিজের লেখা একটা গান থেকে নেওয়া এই নাম। যদি মনে করেন, হিট সিনেমার রেকর্ড রাজেন্দ্র কুমারের, অমিতাভ বচ্চনের বা শাহরুখ খানের– তাহলে ভুল করছেন। জুবিলি হিটের সংখ্যা সবথেকে বেশি, কোন্ডকের।
আটের দশকের শেষদিক। এ দেশের এমন কোনও কোনা নেই, যেখানে বাজছে না ‘ম্যায়নে প্যার কিয়া’-র গান। দীঘল চোখের এক তরুণ, রাতারাতি ভারতের ধড়কন। হ্যাঁ, সালমান খান। তারপর, মাত্র দু’-চার বছরে, এক ডজন সিনেমা এল তাঁর; এবং, অধিকাংশই ফ্লপ। চায়ের দোকানে, ক্লাসরুমে, পাড়ার ঠেকে– সর্বত্র, সকলের রায়, এ ছেলের দ্বারা কিসুই হবে না। চুপিসারে রিলিজ হল এক বর্ষায়, ‘হম আপকে হ্যাঁয় কউন…!’ এরপর, আর ফিরে তাকাতে হয়নি ‘ভাইজান’ সালমানকে।
এক মেগাস্টারের কেরিয়ার গড়ে দেওয়ার নেপথ্যে ছিল এই দুটো সিনেমার গান; সুরকার, রাম-লক্ষ্মণ। অনেকের ধারণা, এঁরা আলাদা দু’জন মানুষ। হ্যাঁ, শুরুতে তাই-ই ছিল। কিন্তু, প্রথম হিন্দি সিনেমায় সাইন করার পরপরই, মারা যান রাম। প্রায় সারাজীবন একাই হাল টেনেছেন লক্ষ্মণ, বন্ধুর নাম না মুছে।
তাহলে কি কোনও সিনেমায় একসঙ্গে সুর দেননি দু’জনে? উঁহু, দিয়েছিলেন; তাঁদের ডেবিউ কাজ, ‘পাণ্ডু হাবলদার’-এ। অর্কেস্ট্রা বাজাতেন লক্ষ্মণ (আসল নাম, বিজয়)। তাঁর দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে, দাদা কোন্ডকে অফার দিলেন ফিল্মে মিউজিক দেওয়ার। ‘পাণ্ডু হাবলদার’-এর গান ঝড় তুলেছিল মহারাষ্ট্রের অলিগলিতে। এই সুরকারকে খুঁজে আনার জন্য ভারতীয় ফিল্মি সংগীত ঋণী, দাদা কোন্ডকের কাছে।
আসল নাম, কৃষ্ণ কোন্ডকে। বাঙালিদের মতো মারাঠিরাও সম্মানসূচক সম্বোধনে বলেন, ‘দাদা’। তাই, ওই নাম। তাঁর নাম শুনে, অনেকে হাসাহাসি করেন, তাঁর সিনেমার টাইটেলে ও ডায়লগে ডাবল-মিনিং শব্দবন্ধের কারণে। যেমন, ‘আন্ধেরি রাত মেঁ দিয়া তেরে হাথ মেঁ’। অনেকেই খেয়াল করেন না, ওরই আড়ালে কীভাবে ঠুকতেন তিনি রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও ধর্মীয় নির্লজ্জতাকে। ওই সিনেমাতেই কোন্ডকের চরিত্র, গুল্লু, মাঝেমাঝে কথা বলে ‘বাপু’-র সঙ্গে। আফসোস করে ‘বাপু’-র কাছে, দেশের দুর্দশা নিয়ে। মধ্য-প্রাচ্যের এক শেখ, সুলতান (আমজাদ খান), প্রথমবার ভারতের কোনও গ্রাম দেখছে। সে অবাক, মন্দির মসজিদ গির্জা– এগুলো এত দূরে দূরে বানানো হয়েছে কেন! কাছাকাছি থাকলে তো প্রার্থনা করতে সবার সুবিধে হয়! হেসে ওঠে গুল্লু, ‘তাহলে নেতারা কী করবে, অ্যাঁ?’ এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সুলতানকে গর্বভরে জানায়, তার ব্যাঙ্ক নিয়োজিত এই গ্রামের মানুষদের সেবায়। ব্যাঙ্কের নামটা একটু খেয়াল করুন, ‘আর্বান ব্যাঙ্ক’।
জীবনকে সিনেমায় পেয়েছিলেন কোন্ডকে। বম্বের ধুন্ধুমার গণপতি উৎসব, যার প্রধান আকর্ষণ ও পাগলপারা ভিড়– ‘লালবাগ চা রাজা’– ওই লালবাগ জায়গাটায় ছিল টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি। চারিদিকে কারখানা; মিলের শ্রমিকদের ঘুপচি বস্তি; এঁদো, স্যাঁতস্যাঁতে। মহল্লায় দুষ্টের যম, কোন্ডকে। কোনও মেয়েকে দেখে কেউ শিস দিয়েছে? ধড়াম! টাকা ঝেড়ে দিয়েছে কেউ? ধুড়ুম! সোডার বোতল, থানইট, রড– সবেতেই পারদর্শী তিনি। চাকরি করতেন ‘আপনা বাজার’-এ, কাজ বলতে চাল-ডাল বাঁধাছাঁদা করা। মাইনে, ৬০ টাকা।
হঠাৎ, বড় দাদা ছাড়া, মারা গেল পরিবারের সবাই, এক বছরের মধ্যে। থমকে গেল মারকুটে তরুণের বাঁচা। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। কথাবার্তা বন্ধ, সকলের সঙ্গে। দিনরাত শুধু অদেখা ঈশ্বরের কাছে নালিশ। উন্মাদ অবস্থা থেকে, ঘুরে দাঁড়ালেন একদিন। ভাবলেন, একটাই অস্ত্রে ঘায়েল করবেন দুঃখকে– মানুষকে হাসানোই হবে তাঁর কাজ।
ফ্ল্যাশব্যাক পর্ব ১৫: পারিশ্রমিকের কথা না ভেবেই নপুংসকের চরিত্রে কাজ করতে চেয়েছিলেন শাহরুখ খান
ঢুকে পড়লেন এক ব্যান্ড পার্টিতে। গান-বাজনার পাশাপাশি, মঞ্চে তাঁর প্রতাপ দেখে, ব্যান্ডের কর্তারা সুযোগ দিলেন নাটকে। মহারাষ্ট্র আর গোয়া মিলিয়ে, ১,৫০০ রজনী পেরোল ‘বিছ্যা মাঝি পুরি করা’ (আমার ইচ্ছা পূরণ করো)। মারাঠি নাট্য-দুনিয়ায় স্টার হয়ে উঠলেন কোন্ডকে। লোকজন পাগল তাঁর অভিনয় দেখতে। অবস্থা এমন, কোনও হোটেলে বা ধাবাতে ঘর পেতে হিমশিম নাটকের দল। কারণ, কোন্ডকের একটা ঝলক দেখতে যে ভিড় হবে, তা সামলাবে কে! এদিকে, মহারাষ্ট্র জুড়ে, স্টেজে ঘুরতে ঘুরতে, কী করলেন কোন্ডকে? বুঝতে থাকলেন ছোট ছোট শহরের, গাঁ-ঘরের মানুষের দুঃখ, ব্যথা, হাসি, কান্না।
‘বিছ্যা মাঝি পুরি করা’-র শো যখনই থাকত বম্বেতে, শত কাজ ফেলেও, ছুটে যেতেন আশা ভোঁসলে। সুকণ্ঠীর সঙ্গে কোন্ডকের বন্ধুত্ব অটুট। সময় পেলেই, আড্ডা দিতেন দু’জনে। আমিন সায়ানিকে বলেছিলেন আশা, ‘কোন্ডকের কাজ অবশ্যই দেখুন, হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে!’ একবার, কোন্ডকের গ্রামের এক আত্মীয়া বম্বে এসে, আশাকে দেখে কৌতূহলী, ‘এই মেয়েটা কে?’ কোন্ডকে নাম জানালেন। আত্মীয়া বললেন, ‘কী করে?’ এমন নিষ্পাপ ভারতবাসীকে কী উত্তর দেবেন, ভেবে কোন্ডকে দিশাহারা। আশাই তাঁকে নিয়ে গেলেন একদিন, মারাঠি ফিল্মমেকার ভালজি পেনঢারকারের কাছে। সিনেমায় অভিষেক হল কিংবদন্তি কোন্ডকের।
কয়েক বছরের মধ্যেই মহারাষ্ট্রের হার্টথ্রব তিনি, আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁর ফ্যান। একটাই কারণ, দু’দণ্ড হাসাতে পারেন কোন্ডকে। বস্তির সেই রগচটা মস্তান বানালেন চোখ-ধাঁধানো পেন্টহাউজ অ্যাপার্টমেন্ট, পশ্চিম দাদারে। ঠিক উলটো দিকেই শিবাজী পার্কের রোদ, সেখানে তখন সারাদিন ব্যাটে-বলে মশগুল এক বেঁটেখাটো বালক। নাম, শচীন তেন্ডুলকার। তাড়দেওতে অফিস বানালেন কোন্ডকে, যেটা এশিয়ার অন্যতম ব্যয়বহুল এলাকা। কিন্তু, কখনও, এক মুহূর্তের জন্যও, ছাড়লেন না সাধারণ মানুষের সঙ্গ। এমন একজনও ছিল না, যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে, সান্নিধ্য পায়নি। সিনেমার ইতিহাসে এমন সুপারস্টার আর কেউ আছেন কি না, জানি না।
ফ্ল্যাশব্যাক পর্ব ১৪: ‘আমি গানের দোকান খুলতে আসিনি’, যশ চোপড়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ‘দিল চিজ ক্যা হ্যায়’-এর গীতিকার
আশার পাশাপাশি, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেও হৃদ্যতা সমান ছিল তাঁর। দুই বোনের খুনসুটিতে মজাই পেতেন তিনি। লতা বলতেন, ‘দুনিয়ার সব প্রোডিউসার আমাকে দিয়ে গাওয়াতে চায়… শুধু কোন্ডকেই কখনও আমাকে গাইতে বলে না!’ লতার রান্না করা বাংরা মাছ আর গাজরের হালুয়া খেয়ে, কোন্ডকে বলতেন, ‘লতাজীর কণ্ঠস্বর না তাঁর রান্না, কোনটা বেশি মধুর বলা মুশকিল!’
ভালজি পেনঢারকারকে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন কোন্ডকে। ভালজির ‘জয়াপ্রভা স্টুডিওজ’ ছিল কোলাপুরে। সেখানে শুটিং করছিলেন কোন্ডকে। একটা কাজে লতাও পৌঁছলেন। এ’কথা সে’কথার পর, সরল মুখ করে লতা বললেন, ‘শুনেছি, আপনি দারুণ বন্দুক চালান, এয়ারগানও আছে…’। লাফিয়ে উঠে বন্দুকটা নিয়ে এলেন কোন্ডকে। ভাবলেন, গায়িকা মানুষ, নরম মন– গোলাগুলি কী বুঝবে! জোরকদমে ব্যাখ্যা করতে থাকলেন কোন্ডকে, কীভাবে ধরে কীভাবে তাক করতে হয়। বকবকানির মাঝপথেই, পরপর পাঁচবার গুলি ছুড়লেন লতা। আর, প্রতিবারই নিখুঁত নিশানায়! দেখে, কোন্ডকে তাজ্জব।
ডায়লগ বা টাইটেল নিয়ে, সেন্সর চোখ রাঙালে, ক্ষুরধার যুক্তি কোন্ডকের: যাদের ১৮ বছর হয়নি, তারা এসব বুঝবে না; আর, যাদের ১৮ হয়ে গেছে, তারা নিশ্চয়ই মজা পাবে। প্রোডিউসার’স অ্যাসোসিয়েশনে, একটা টাইটেল রেজিস্ট্রি করেছিলেন তিনি, ‘ম্যায় দেতি হুঁ তু লেতা যা’। নিজেরই ফিল্ম ‘তেরে মেরে বিচ মে’-তে নিজের লেখা একটা গান থেকে নেওয়া এই নাম। যদি মনে করেন, হিট সিনেমার রেকর্ড রাজেন্দ্র কুমারের, অমিতাভ বচ্চনের বা শাহরুখ খানের– তাহলে ভুল করছেন। জুবিলি হিটের সংখ্যা সবথেকে বেশি, কোন্ডকের।
আমজনতাকে বুঝলেও, দুটো জিনিস কখনও বুঝতে পারেননি তিনি। এক, হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। কমেডিকে কেন তারা সাইড ডিশে রাখে! কেন একটা হাসির দৃশ্যের আগে কয়েকটা খুন আর মারামারি হয়! কেন ডিসকোর নামে ঝালাপালা বাজনা বাজে বেসুরো! দুই, আর্টহাউজ ফিল্ম। ‘সামনা’, ‘উম্বরঠা’, ‘মুসাফির’-এর পরিচালক জব্বার প্যাটেলকে বলেছিলেন, ‘এক্সপেরিমেন্ট করতে হলে, চাষবাস নিয়ে করুন! সিনেমায় কেন?’ ও, হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও বোঝেননি তিনি– রাজনীতি। বাল ঠাকরের পাশে যথেষ্ট থেকেও, শিবসেনার জন্য যথেষ্ট লড়েও, রাজনীতির ফ্রন্টে আসার কপাল হয়নি তাঁর। বুঝতে পারেননি, শুধু জনপ্রিয় হলেই এ দেশের নেতা হওয়া যায় না, পদবীর পরিচয়টাও একটা ব্যাপার।