Robbar

রবীন্দ্রনাথের নীড় থেকে জীবনানন্দর নীড়, এক অলৌকিক ওলটপালট

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 23, 2025 11:21 am
  • Updated:September 5, 2025 8:50 pm  

কবি যখন একা, নিঃশর্ত ভাবেই একা– যাবতীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান-নিরপেক্ষ ভাবে একা। ভিড় থেকে দূরে, সমুদ্রে বা পাহাড়ে নয়, ভিড়ের হৃদয় থেকেই আমি দেখতে পাই একজন কবি লিখে গিয়েছেন কতদিন আগে, ‘পৃথিবীতে ব্যারাকের চেয়ে বেশি ঘৃণা আমি কিছুতেই করি নি কোনও দিন; কোনো রেসিডেনসিয়াল ইউনিভার্সিটি– কনভোকেশন অ্যাড্রেস– এক্সটেনশন লেকচার বা প্রফেসরদের ইউনিয়নগুলোকেও না।’ একথা জানার জন্য জীবনানন্দের ফুকো পড়তে হয়নি। আকাদেমিয়ার কর্তাদের দাঁত-নখ যে সমরপতিদের অনুরূপ, তা তিনি অনাড়ম্বর ভাবে জানতেন। শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের সভ্যতাকে যে সমস্ত মেধাবী যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে, তা কখনও উত্তর কলকাতার মেসবাড়ি, কখনও রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে সৌন্দর্যের সারাৎসার: নশ্বরতা থেকে অমরতা।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

১.

স্বর্গযানের মতো দু’টি ট্রাম, যথাক্রমে বালিগঞ্জ ও টালিগঞ্জ ছেড়ে রাসবিহারী মোড়ে যখন দাঁড়াত, সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে জীবনানন্দ দাশ গ্যালিফ স্ট্রিট ও এন্টালি ছাড়িয়ে আরও দূর ব্যর্থ অন্ধকারে। শেলী কাফের (অধুনালুপ্ত) ম্যানেজার সম্ভবত ঘুমন্ত; কিন্তু দেয়ালা করলেও ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পেরিয়ে তিনি সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে আর তাকাননি। জীবনানন্দ মৌলালির জাহাজঘাটায় দেড় সেরি ইলিশের সুলুক সন্ধানে বেরিয়ে দেখলেন আকাশ বেশ ফরসা হতে চাইছে। এ রং ঘাসফড়িংয়ের দেহের মতো কোমল নীল নয়। অগত্যা গবেষকদের দিকে তাকাতেই শুনতে পেলেন জনৈকা জিপিএস সুকণ্ঠী জানাচ্ছেন, এই ভূবলয় শোভনার মুখের মতো। তিনি কালের বিধান মেনে নিলেন। সুতরাং, আমাদের যাত্রা শুভ হোক।

‘হৃদয়’ নামক বস্তুটি বুকের বাঁদিকে থাকে বলেই মানুষের ধারণা। উপরন্তু বরিশাল ও কলকাতায় মানুষ যূথবদ্ধ প্রাণী। তবু আত্মার বামফ্রন্ট গড়ে ওঠেনি আজও। ভাগ্যক্রমে একা করার মতো কিছু কাজ মানুষের কররেখায় নির্দিষ্ট হয়ে আছে। যেমন কবিতা লেখা। পৃথিবীর প্রজাতন্ত্রসমূহে প্লেটো ও কবি অনেক দিন সহবাস করেছে। হদ্দ বাঙাল জীবনানন্দের কাছে প্রশ্নটা সুতরাং এই না যে, কবিতা লেখা হবে কি না। হবে, কিন্তু কীভাবে। শব্দে শব্দে বিবাহ হলেই যে কাব্য সরস্বতীর মনোবাসনা পূর্ণ হবে– তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি আর নেই। বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ এখন পিকনিক স্পট। থতমত খেয়ে তিনি ‘নীড়’ শব্দটির দিকে তাকালেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথের হাতযশ ছিল। ‘পাখী আমার নীড়ের পাখী’ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি পাশার দান দিলেন ‘পাখীর নীড়ের মতো’– এ যেন হেগেল থেকে মার্কস– এক অলৌকিক উল্টে দেওয়া। সংস্কার থেকে শব্দ প্রতিস্থাপনের দায় কবির মৌলিক দায়। একেই ‘ভাষা বিহার’ বলে।

Jibanananda Das - Wikipedia

পঁচিশে বৈশাখ। ওই একদিনেই কবিতা রূপসীর মুখে আইসক্রিমের মতো মিলিয়ে যায়। পড়ে থাকে মে মাস ও কলকাতা শহর। টিন, মেট্রো রেলের দাম, হাফ গেরস্ত মেয়ে মানুষ, শিয়ালদা স্টেশনের মাথার অরণ্য। লিপস্টিক-বিনোদন সংখ্যা-অনুমোদিত অ্যানার্কি। টালিগঞ্জের অরণ্যদেব ডায়াল করে। ঢাকা থেকে অরুণিমা সান্যাল উত্তর দেয়। কোনও শোক নেই যে, কবি মন্থর বিলাপ করবে। কোনও আহ্লাদ নেই যে কবি দীর্ঘ উল্লাস করবে। ট্র্যাজেডি নেই। কমেডিও নেই। কেন না বিস্ময় নেই! নবীন চাঁদের মতো স্তন, নকশাল পন্থার মেঘদূত, আলুলায়িত পয়ার আছে। আকাশকুসুম ফুটে ওঠে রোজই পাপড়ি অনুসারে। জীবনানন্দ তবু দেখেন শৌচাগারের দেওয়ালে লটকে আছে প্রজাতির আত্মা। কবি কবিতার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে: পরপুরুষ।

বর্ষা শেষ। কাঁচুলি খুলে চাঁদ উঠল। যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মতো হেসে একজন কবি আত্মজীবনীর প্রথম খসড়া শেষ করে দেখলেন ইতিমধ্যেই মিডিয়া ছেপে দিয়েছে তার আত্মার বিবরণী। এখন তিনি কী করবেন? এমন কোনও প্রতিবিন্দু নেই, এমন অনুভূতি পরিসর নেই যা কবিকে খেয়া পার হতে সাহায্য করবে। সমস্যা এই যে সব কিছুই অনুমোদিত। সব কিছুই পরিগৃহীত। শূন্যতার বিভা কতক্ষণ পর্যন্ত তাকে আলোকিত করে রাখবে?

জীবনানন্দর স্কেচ। সত্যজিৎ রায়

বাংলা শব্দের কুসুমকাননে একা বিহার করার সময় আজ কবিকে প্রায়ই আপ্যায়নকুশলা বার-বিলাসিনী মনে হয়। তার সকলই আছে; জ্ঞানের বিহনে তবু প্রেম নেই। চিত্রনাট্যে কবির আশ্চর্য বুৎপত্তি ও গমনছন্দে নিরূপম পায়চারি আমাদের তাৎক্ষণিক সুখ কিন্তু কবিতা কেমন আলেয়ার মতো দূরে সরে যায়।

অথচ কবি যখন একা, নিঃশর্ত ভাবেই একা– যাবতীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান-নিরপেক্ষ ভাবে একা। ভিড় থেকে দূরে, সমুদ্রে বা পাহাড়ে নয়, ভিড়ের হৃদয় থেকেই আমি দেখতে পাই একজন কবি লিখে গিয়েছেন কতদিন আগে, ‘পৃথিবীতে ব্যারাকের চেয়ে বেশি ঘৃণা আমি কিছুতেই করি নি কোনও দিন; কোনো রেসিডেনসিয়াল ইউনিভার্সিটি– কনভোকেশন অ্যাড্রেস– এক্সটেনশন লেকচার বা প্রফেসরদের ইউনিয়নগুলোকেও না।’ একথা জানার জন্য জীবনানন্দের ফুকো পড়তে হয়নি। আকাদেমিয়ার কর্তাদের দাঁত-নখ যে সমরপতিদের অনুরূপ, তা তিনি অনাড়ম্বর ভাবে জানতেন। শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের সভ্যতাকে যে সমস্ত মেধাবী যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে, তা কখনও উত্তর কলকাতার মেসবাড়ি, কখনও রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে সৌন্দর্যের সারাৎসার: নশ্বরতা থেকে অমরতা।

আমাদের অবিরাম পতনের মধ্যে আমরা কি দেবতাকে বেছে নেব পরিত্রাণের আলো বিন্দু হিসেবে? না, বরং জয়ন্তীর স্বয়ম্বরসভায় যেমন ছদ্মবেশী দেবতাদের থেকে নলকে আলাদা করে চেনা গিয়েছিল– তার দেহে ঘামের জামা ছিল, তার মাথায় ফুল শুকিয়ে এসেছিল– তেমনভাবেই আমরা আমাদের স্বেচ্ছানির্বাচিত প্রান্তিকতা উৎসর্গ করতে চাই জীবনানন্দ দাশকে। এই নরকের মধ্যেই আমাদের খুঁজে পেতে হবে ‘পরিত্যক্তদের আস্তানা’। তাঁকে আর আমাদের উন্নয়নশীল প্রদেশের কথ্যভাষায়, পয়ার ও উদ্ধৃতিতে, ধরা যাবে না। শাপগ্রস্ত আমাদের ভাষাশহরের শরীরকে পরিত্যাগ করে তাঁর কাব্যের আত্মা চলে গেছে অন্যত্র। এটুকুই গল্পের সূচনা।