শুধু শহরের আনাচ-কানাচ নয়, নতুন শতকে এইসব তরুণদের আধুনিক জীবনবোধও ছিল আদ্যন্ত নাগরিক। গ্রামের সঙ্গে কোনও না কোনও সম্পর্ক থাকলেও সবাই নিজেকে কলকাতার লোক বলেই মনে করত। গোপাল হালদারের মতে প্রত্যেক বাঙালির দুটো ঠিকানা– এক, তাঁর জন্মভিটে, দুই, কলকাতা। পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় এসে এই শহরের প্রেমে পড়ে যান বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের আক্ষেপ ছিল যে কোনও ডিকেন্স, বালজাক, টলস্টয়, বা বোদল্যার কলম ধরেননি কলকাতার জন্য।
১৭.
উনিশ শতকের কলকাতা মনীষীদের শহর– এ আমরা ছোট থেকে জেনে এসেছি। বড় হয়ে পড়েছি উনিশ শতকের কলকাতা হল আধুনিকতার শহর– না হয় হল সে ‘ঔপনিবেশিক আধুনিক’। নিজেদের চিন্তাভাবনা মিলিয়ে মিশিয়ে এক ‘স্বকীয় আধুনিকতা’ গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞজনেরা। কিন্তু এই পালাবদলের রঙ্গভূমি কলকাতার স্থানিক মাহাত্ম্য নিয়ে তাঁদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না উনিশ শতকে। বরং বেশিরভাগ লেখাপত্রেই কলকাতা বর্ণিত হয়েছে বাঙালি জীবনের ঐতিহ্য বা পরম্পরার স্থিতিশীলতা নষ্ট করার বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে।
‘জাল, জোচ্চুরি, মিথ্যা/ তিন নিয়ে কলকাতা’– দেবরাজ ইন্দ্রকে সাবধান করে দেন বরুণ কলকাতায় পা রাখার আগে। ‘সধবার একাদশী’তে বিক্রমপুর থেকে কলকাতায় এসে রামমাণিক্য শহুরে হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু ‘বাঙ্গাল’ পরিচিতি থেকে বেরোতে পারে না। কিন্তু ‘কলকাত্তাইয়া’ হতে গেলে কী কী করতে হবে? রাম চটে গিয়ে গাল পাড়ে: ‘পুঙ্গির বাই বাঙ্গাল বাঙ্গাল কর্যা মস্তক গুরাইদিচে– বাঙ্গাল কউশ ক্যান্– এতো অকাদ্য কাইচি তবু কলকতার মত হবার পারচি না? কলকতার মত না করচি কি? মাগীবারী গেচি, মাগুরি চিকোন দুতি পরাইচি, গোরার বারীর বিসকাট বক্কোন করচি, বাণ্ডিল খাইচি– এতো কর্যাও কলকতার মত হবার পারলাম না, তবে এ পাপ দেহতে আর কাজ কি, আমি জলে জাপ্ দিই আমারে হাঙ্গোরে কু্ম্বিরে বক্কোন করুক–’’
বাবুয়ানির কলকাতায় যেন ‘ধর্মের’ কোনও জায়গা নেই। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, ন্যায়-নীতির অবক্ষয়, সমাজ-সামাজিকতার অবনতি– সব মিলিয়ে নতুন শহর কলকাতা। উনিশ শতকের নকশা, নাটক, নভেলে এই ছবিই ঘুরেফিরে আসে। এক দিকে কাজের সন্ধানে শহরে আসতে বাধ্য হওয়া, অন্যদিকে পদে পদে বিপদ, বিপর্যয়, নৈতিক অধোগমন। নাগরিক আবহাওয়া যেন সবাইকে কলুষিত করে দেয়। টেকচাঁদ বলছেন, “কোন খানে দলপতি বাবুরা রাত্রে খানা আর মদ সেঁটে প্রাতঃকালে মুখ পুছিয়া জাত মারিতে বসিয়াছেন। কোন খানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা দিনের বেলায় গঙ্গা মৃত্তিকার ফোঁটা করিয়া চণ্ডীপাঠ ও যজমানগিরি কর্ম্ম করিতেছেন ও রাত্রে বাবুদিগের সঙ্গে মজায় ও চোহেলে মত্ত হইতেছেন। কোন খানে অধ্যাপকেরা শাস্ত্রকে কল্পতরু করিয়া দোকানদারি করিতেছেন– ফলের দফা কিঞ্চিৎ হইলেই আবশ্যক মতে বিধি দিতেছেন– রাতকে দিন করিতেছেন– দিনকে রাত করিতেছেন। কোন খানে বলরাম ও রামেশ্বর ঠাকুরের সন্তানেরা শূদ্রের বাটীতে জলস্পর্শ করেন না কিন্তু বেশ্যার ভবনে এমন করিয়া আহার ঠাসিতেছেন যে পাত দেখে বিড়াল কাঁদিয়া মরে। কোন খানে তিলক নামাবলী সন্ধ্যা আহ্নিকের ঘটা হইতেছে অথচ পরস্ত্রী গমন ও অপহরণে ক্ষান্ত নাই।”
বলা বাহুল্য, এই সব লেখায় হালকা চালে আধুনিক নগরের যে ছবি ফুটে ওঠে তা এক বিশেষ শ্রেণির, এক বিশেষ ধর্মীয়-সামাজিক অবস্থান থেকে দ্রুত বদলাতে থাকা জীবনযাত্রার পর্যবেক্ষণ। তাতে যেমন ব্যঙ্গ রয়েছে, শ্লেষ রয়েছে, তেমনই আছে জাতি-ধর্ম-সমাজকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা। নিম্নবর্গের চড়ক গাজনে বা সঙের গানে নাগরিক দৈনন্দিনতার মধ্যে নিয়ম ভাঙার আনন্দ বা উদযাপনের আভাস পাওয়া যায়। আধুনিক শহর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে তাঁদের জীবনে, উচ্চবর্ণের কাছে যা শুধুই জাত-ধর্ম হারানোর জায়গা।
কলকাতা নিয়ে চিন্তাভাবনায় বা লেখালেখিতে বদল আসতে শুরু করে উনিশ শতকের শেষভাগ আর বিশ শতকের শুরুর দশকগুলিতে। শহরের জীবনের সঙ্গে ততদিনে বাঙালি উচ্চ/মধ্যবিত্ত অনেক সড়গড় হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক নগরের জীবনযাপনকে আপন করে নিয়েছে। পশ্চিমি শিক্ষার হাত ধরে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয়, আবার একইসঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার মিশেলে দ্রুত বদলাতে থাকা বৌদ্ধিক জগত বাঙালির কাছে কলকাতাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে তোলে। এই সময় থেকেই ইংরেজ লেখকদের হাত ধরে কলকাতার অতীত নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। কিন্তু সেইসব আখ্যানে ইংরেজ কোম্পানি ও সাহেবসুবোদের কথাই পাওয়া যায়। ভারতীয়রা প্রায় অনুপস্থিত বললেই চলে। বিশ শতকের গোড়ায় প্রাণকৃষ্ণ দত্ত বা মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পুরনো কলকাতার বাঙালিটোলার গল্প পাওয়া গেল। সেই লেখায় নকশার ব্যঙ্গ নেই, বরং রয়েছে নাগরিক বাঙালির নানা আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, আদবকায়দা নিয়ে কথা।
একইসঙ্গে একগুচ্ছ কবি-লেখক-সাহিত্যিকের প্রাণের শহর হয়ে উঠল কলকাতা। শহরের রাস্তাঘাট, ময়দান, কলেজ পাড়া, চায়ের দোকান, মেসবাড়ি, কেবিন, পত্রিকার অফিস– সবই হয়ে উঠল টগবগে তরুণদের আড্ডাখানা। ‘কল্লোল যুগ’-এ অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, “মির্জাপুর স্ট্রীটে ফেভারিট কেবিনে কল্লোলের দল চা খেত। গোল শ্বেতপাথরের টেবিলে ঘন হয়ে বসত সবাই গোল হয়ে। দোকানের মালিক, চাটগেঁয়ে ভদ্রলোক, নাম যতদূর মনে পড়ে, নতুনবাবু সুজন সুলভ স্নিগ্ধতায় আপ্যায়ন করত সবাইকে। সে সংবর্ধনা এত উদার ছিল যে চা বহুক্ষণ শেষ হয়ে গেলেও কোনো সংকেতে সে যতিচিহ্ন আঁকত না। যতক্ষণ খুশি আড্ডা চালিয়ে যাও জোর গলায়। কে জানে হয়তো আড্ডাই আকর্ষণ করে আনবে কোনো কৌতূহলীকে, তৃষার্তচিত্তকে। পানের অভাব হতে পারে কিন্তু স্থানের অভাব হবে না। এখুনি বাড়ি পালাবে কি, দোকান এখন অনেক পাতলা হয়েছে, এক চেয়ারে গা এলিয়ে আরেক চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে বোস। সাদা সিগারেট নেই একটা? অন্তত একটা খাকি সিগারেট? বহু তর্ক ও আস্ফালন, বহু প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যচিত্রণ হয়েছে সেই ফেভারিট কেবিনে। “কল্লোল” সম্পূর্ণ হত না যদি না সেদিন ফেভারিট কেবিন থাকত।”
শুধু শহরের আনাচ-কানাচ নয়, নতুন শতকে এইসব তরুণদের আধুনিক জীবনবোধও ছিল আদ্যন্ত নাগরিক। গ্রামের সঙ্গে কোনও না কোনও সম্পর্ক থাকলেও সবাই নিজেকে কলকাতার লোক বলেই মনে করত। গোপাল হালদারের মতে প্রত্যেক বাঙালির দুটো ঠিকানা– এক, তাঁর জন্মভিটে, দুই, কলকাতা। পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় এসে এই শহরের প্রেমে পড়ে যান বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের আক্ষেপ ছিল যে কোনও ডিকেন্স, বালজাক, টলস্টয়, বা বোদল্যার কলম ধরেননি কলকাতার জন্য। তবে বাংলা ভাষায় আধুনিক নাগরিক জীবনের এক অনাস্বাদিত রস পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন লেখায়। ‘ক্লাইভ স্ট্রীটে চাঁদ’-এ নাগরিক কোলাহলের মধ্যেও শহরের শান্তির বৈপরীত্যের যে অনবদ্য ছবি তুলে ধরলেন তিনি, তা অতুলনীয়: “আমরা যারা শহরে থাকি, তারা চাঁদকে বিশেষ লক্ষ করি না; আমাদের ধারণা, চাঁদের শোভা সেখানেই, প্রকৃতির যেখানে নিজস্ব রাজত্ব–পল্লীর উন্মুক্ত প্রান্তরে, বা সমুদ্রের দৈগন্তিক লীলায়। এটা আমাদের একটা গতানুগতিক ধারণা, যা আমরা বংশপরম্পরায় অবাধে বিশ্বাস ক’রে এসেছি, বিশ্বাস করাই সহজ ব’লে। কিন্তু চাঁদকে যে এখানেই দেখতে হয়, এই বাণিজ্যধানীতে, কুবেরকে উৎসর্গিত মন্দির থেকে মন্দিরে প্রতিফলিত দীর্ঘ ছায়ার পরিপ্রেক্ষিতে– এখানেই তো সবচেয়ে বাণীময় হ’য়ে ওঠে চাদের শান্তি আর স্তব্ধতা। পল্লীর নির্জনতায় আর প্রসারে চাঁদ যায় হারিয়ে; যেখানে প্রকৃতি তার উদাস আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে আকাশে-আকাশে, সেখানে চাঁদ বাহুল্য মাত্র। আমরা, যারা শহরের লোক, কাড়াকাড়ি ক’রে, মারামারি ক’রে, প্রতি মুহূর্তে ঠেলাঠেলি ক’রে, কঠিন চেষ্টায় তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে হয়; আমরা, যাদের রক্তের বিবর্ণ পাণ্ডুরতা ধূসর হ’য়ে ফুটে ওঠে আমাদের মুখে; হৃদয় যাদের শুকিয়ে গেছে, ঝ’রে গেছে ধুলো হ’য়ে– আমাদেরই তো সবচেয়ে বেশি দরকার অন্তরে চাঁদের স্পর্শ, আমাদেরই জন্য তো চাঁদের শান্তি।”
শান্তি আর কোলাহল, কাড়াকাড়ি আর মারামারির এই বর্ণনা থেকে আমরা গত একশো বছরে কলকাতা নিয়ে রাগ, ঘৃণা, ভালবাসার নানা বয়ান পেয়েছি। দুশো বছরের ব্যবধানে কলকাতা গোটা জাতির মনোভূমি হয়ে উঠল– বাবুদের বোলচালের শহর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি, বর্ণ, বর্গের বাঙালির আপন আবেগ। প্রায় প্রতি বাঙালির কথা বলে দিলেন নাগরিক কবিয়াল যখন তিনি গাইলেন, ‘আমাকে পড়লে মনে এসো এইখানে, এখানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে।’
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট