সরকার চাইত না প্ল্যাটফর্ম জুড়ে এই মানুষের স্রোত। রেল কর্তৃপক্ষও চেষ্টা করত এঁদের অন্য কোথাও পাঠানোর জন্য। নাম-ধাম জেনে নিয়ে বলত ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে যতদিন না তাঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি গাড়ি আসছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কেউই দিনের পর দিন চুপ করে এক জায়গায় থাকত না। আর প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ এসে উপস্থিত হতেন, ফলে একটা প্ল্যাটফর্মে সবার জায়গা হত না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের আস্তানা খুঁজে নিতেন তাঁরা। অন্যদিকে, নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ লেগেই থাকত এই উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়ে।
১৯.
দেশভাগের পর প্রায় দু’-দশক ধরে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে এসেছেন উদ্বাস্তু মানুষ। সড়কপথে ছাড়াও কলকাতায় এসে পৌঁছনোর আরেক উপায় ছিল ট্রেন ধরে শিয়ালদা স্টেশনে আসা। তারপর সেখান থেকে শুরু হত শহরের নানা জায়াগায় ঠাঁই খোঁজার পালা। অনেক সময়ে সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী স্টেশন থেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হত উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে। কিন্তু নথিপত্র ঘাঁটলে পাওয়া যায় ১৯৪৬ থেকে শুরু করে প্রায় ছয়ের দশকের শেষ অবধি শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম জুড়ে উদ্বাস্তু মানুষের ভিড়ের কথা। অত্যন্ত ব্যস্ত একটা রেল স্টেশনে এই ঘরহারা মানুষগুলির উপস্থিতি সরকারের বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রেলের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৪৫-’৪৬ সালে, প্রতিদিন গড়ে ৩৭,৭০০ যাত্রী শিয়ালদা স্টেশনে এসে পৌঁছতেন বিভিন্ন লাইনের ট্রেন ধরে। শিয়ালদা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যাত্রীর সংখ্যাও ছিল কাছাকাছি। ১৯৪৭ সালের টিকিট-বিক্রির এক হিসেব অনুযায়ী, ‘অফিস টাইমে’ প্রায় ১৪,০০০ যাত্রী যাতায়াত করতেন। তবে টিকিট ছাড়া যাতায়াত করা লোকজনের অভাব ছিল না, তাই মূল যাত্রীর সংখ্যা যে এর থেকে বেশ খানিক বেশি ছিল, তা বলা বাহুল্য।
এহেন জনবহুল এলাকায় উদ্বাস্তু পরিবারগুলি এসে পৌঁছলেন। যাঁদের উপায় ছিল, বা কিছু পূর্ব পরিচিতি, তাঁরা শহরের বিভিন্ন জায়াগায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেন। কিন্তু যাঁদের নিতান্তই কিছু করার ছিল না, কোনক্রমে চলে এসেছিলেন এ পারে, তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন স্টেশন প্ল্যাটফর্মে– এই আশা নিয়ে যে, দিন কয়েকের মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে দিন, মাস পেরিয়ে বছর কেটে গিয়েছিল এই স্টেশনেই। ১৯৫০-এর দাঙ্গা পরবর্তী যে উদ্বাস্তু স্রোত শিয়ালদায় উপস্থিত হয়, তাঁরা মূলত ছিলেন নিম্নবর্ণের মানুষজন। তাঁদের না ছিল বিশেষ পয়সা-কড়ি, না ছিল কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে আত্মীয়-পরিজন।
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ র হিসেব অনুযায়ী, ১৯৫০-এর ৭ এপ্রিল ৮০০০ রিফিউজি ছিলেন শিয়ালদায়, ২৭ জুন প্রায় ৯০০০, ২২ জুলাই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১২,৬৯৫-তে, আর অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে খানিক কমে হয় হাজার দশেক। ১৯৫০-এর পরও শিয়ালদায় নিয়মিত উদ্বাস্তু মানুষ থাকতেন। যুগান্তর জানায় যে ১৯৫২ সালের ১৭ অক্টোবর ১১,৯১৭ জন ছিলেন, যদিও দিন কয়েক পর সংখ্যাটা বেশ খানিক কমে যায়। ১৯৬৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি টাইমস অফ ইন্ডিয়া লেখে যে তখনও প্রায় ৬০০০ রিফিউজি রয়েছেন স্টেশনে।
১৯৫০ নাগাদ শিয়ালদায় ১২টা প্ল্যাটফর্ম ছিল। ৮টায় ছিল শহরতলির ট্রেনের যাতায়াত, আর বাকি চারখানা বরাদ্দ ছিল দূরপাল্লার ট্রেনের জন্য। এই চারটে প্ল্যাটফর্ম ছিল ৯০০ ফুট লম্বা, যার মধ্যে ৫৪০ ফুট ছিল শেডের নিচে। অন্য আটটা প্ল্যাটফর্মের মধ্যে দুটোতে কোনও শেড ছিল না, দুটোতে মাত্র ৯০ ফুট ঢাকা, আর বাকি চারটেতে শেড ছিল ৪৮০ ফুট। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর দৈর্ঘ্য ৫৮৫ থেকে ৬০০ ফুট ছিল। ফলে রিফিউজি পরিবারগুলির প্রথম সমস্যা ছিল কোনভাবে স্টেশন চত্বরে একটা নিরাপদ এলাকা বেছে নেওয়া, বিশেষত এই শেডের নিচে একটু জায়গা দখল করে নেওয়া, তারপর কিছু না কিছু খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা।
পুনর্বাসনের জন্য সরকারি খাতায় নাম লেখানোর পর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কোনও ক্যাম্পে ঠাঁই পাওয়ার জন্য তার কোনও ঠিক ছিল না। এক দুই সপ্তাহ হতে পারে, বা তার বেশিও। একবার কোনও পরিবারের নাম ডাকার পর যদি তাঁরা সেই সময়ে উপস্থিত না থাকে, তাহলে হত মহা বিপত্তি। দ্বিতীয়বার কবে তাঁদের আবার ডাকা হবে তার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। এই পুরো সময় জুড়েই ছিল অনন্ত অপেক্ষা! ঝড়, জল, গরম মাথায় করে কোনও ক্রমে প্ল্যাটফর্মে দিন গুজরান। গোটা এলাকায় পুরুষদের জন্য আটটা আর মহিলাদের জন্য মাত্র দুটো শৌচাগার ছিল। তিন খানা মাত্র টিউবওয়েল ছিল জলের জন্য। রোগ মারীর সময়ে অবস্থা যে ভয়াবহ হবে এর থেকেই বোঝা যায়। ১৯৫০ সালে কলকাতায় কলেরা আর গুটিবসন্ত হু হু করে ছড়ায়। বহু সংখ্যায় উদ্বাস্তু আগমনকে বিশেষভাবে দায়ী করা হয় রোগের প্রাবল্যের জন্য। জনবহুল এলাকাগুলি নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না কর্তৃপক্ষের। স্বাভাবিকভাবেই শিয়ালদা নিয়েও নানা কথা ওঠে। প্রচুর মানুষ মারা যান স্টেশন চত্বরে। যতীন বালা লিখেছেন যে, প্রতিদিন সকালে দেখা যেত যে মৃতদেহ সৎকার করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক এসেছে। তারা চার, সাত বা দশটা দেহ একসঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলে যেত। সৎকার হত কি না, সেই হতভাগ্যদের, একথা কেউই হলপ করে বলতে পারত না।
………………………………………………………………..
পুনর্বাসনের জন্য সরকারি খাতায় নাম লেখানোর পর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কোনও ক্যাম্পে ঠাঁই পাওয়ার জন্য তার কোনও ঠিক ছিল না। এক দুই সপ্তাহ হতে পারে, বা তার বেশিও। একবার কোনও পরিবারের নাম ডাকার পর যদি তাঁরা সেই সময়ে উপস্থিত না থাকে, তাহলে হত মহা বিপত্তি। দ্বিতীয়বার কবে তাঁদের আবার ডাকা হবে তার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। এই পুরো সময় জুড়েই ছিল অনন্ত অপেক্ষা! ঝড়, জল, গরম মাথায় করে কোনও ক্রমে প্ল্যাটফর্মে দিন গুজরান। গোটা এলাকায় পুরুষদের জন্য আটটা আর মহিলাদের জন্য মাত্র দুটো শৌচাগার ছিল।
………………………………………………………………..
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু মানুষ চাইতেন সরকারি ক্যাম্পে না গিয়ে শিয়ালদায় থাকতে যতদিন না কলকাতার অন্য কোথাও একটা আস্তানা জুটিয়ে নেওয়া যায়। অনেকেই ক্যাম্পে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিলেন শিয়ালদায়। কিছু একটা কাজ নিশ্চয়ই জোগাড় করা যাবে কলকাতায়– এই আশায়। শিয়ালদার আশেপাশে প্রচুর দোকান, বাজার, পাইস হোটেল, নিত্যযাত্রীদের আনাগোনা। উদ্বাস্তু মানুষ সস্তা শ্রমিকও বটে। ফলে টুকটাক কাজ অনেকেই জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন বিভিন্ন জায়গায়। কয়েকজন প্ল্যাটফর্মে বসবাস করার সময়ে স্টেশনের বাইরে ভাত-ডাল, পান-সিগারেটের দোকান চালু করে দেন। এই রকম কিছু সুযোগের জন্য অনেকেই কলকাতার থেকে দূরে কোনও সরকারি ক্যাম্পে যেতে নারাজ ছিলেন। তার উপর ক্যাম্পের অবস্থার কথাও সকলে জানতেন। সেখানে পৌঁছেও যে ঠিকঠাক থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হবে, সেই নিশ্চয়তাও ছিল না। তাই শহরের বুকে, স্টেশন প্ল্যাটফর্মে নানা বাধা-বিপত্তি, অসুখ, অসুবিধে সত্ত্বেও থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেশ কিছু উদ্বাস্তু মানুষ।
অবশ্যই সরকার চাইত না প্ল্যাটফর্ম জুড়ে এই মানুষের স্রোত। রেল কর্তৃপক্ষও চেষ্টা করত এঁদের অন্য কোথাও পাঠানোর জন্য। নাম-ধাম জেনে নিয়ে বলত ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে যতদিন না তাঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি গাড়ি আসছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কেউই দিনের পর দিন চুপ করে এক জায়গায় থাকত না। আর প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ এসে উপস্থিত হতেন, ফলে একটা প্ল্যাটফর্মে সবার জায়গা হত না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের আস্তানা খুঁজে নিতেন তাঁরা। অন্যদিকে, নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ লেগেই থাকত এই উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়ে। স্টেশনে ভিড়, পুরো এলাকাটা জঞ্জালে পরিপূর্ণ, নোংরা, অস্বাস্থ্যকর– এইসব বক্তব্য বারবার উঠে এসেছে সে সময়ের খবরের কাগজে, পাঠকের চিঠিতে, সম্পাদকীয় কলামে। পুলিশ এসে রিফিউজিদের তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাঁদের দোকানঘর ভেঙে দিয়েছে। এই ঘটনার নিন্দেও হয় কাগজে। কিন্তু সরকারি নানা চাপ সত্ত্বেও, প্রাত্যহিক নানা অসুবিধে মেনে নিয়ে উদ্বাস্তু এই লোকগুলি শিয়ালদায় মাটি আঁকড়ে বসে ছিলেন, অপেক্ষায় ছিলেন নিজেদের জায়গা খুঁজে নেওয়ার। দেশভাগের দায় স্বাধীন ভারতের সরকারকে খানিক হলেও বাধ্য করেছিল এই মানুষগুলোর ‘অপেক্ষা করার অধিকার’কে মান্যতা দিতে। দিনের পর দিন শিয়ালদা রেল স্টেশনের মতো ভীষণ ব্যস্ত এক জায়াগায় এত মানুষের উপস্থিতি কোনও কর্তৃপক্ষই মেনে নেবে না। কিন্তু সেই সময়টাই ছিল অন্যরকম। ছিন্নমূল মানুষগুলির দাবি অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না সরকারের, যতই তাঁরা সরকারি পুনর্বাসন নীতি অমান্য করুন না কেন।
শিয়ালদা স্টেশন পরিসরের এই কয়েক বছরের ইতিহাস আমাদের সামনে দেশভাগ আর উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে জর্জরিত কলকাতা শহরের এক অন্য ছবি তুলে ধরে। বুঝতে সাহায্য করে সহায়-সম্বলহীন কিছু মানুষের নিজেদের পথ খুঁজে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা, শত সমস্যা নিয়েও অপেক্ষা করা, কলকাতার বুকে থেকে শহরের অসংগঠিত অর্থনীতির বিভিন্ন আনাচে-কানাচে একটা জায়গা করে নেওয়া, আর প্রতিদিন নতুন করে লড়াই শুরু করার গল্পগুলিকে।
ঋণ স্বীকার: অন্বেষা সেনগুপ্ত, ‘বেঙ্গল পার্টিশন রিফিউজিস অ্যাট শিয়ালদা রেলওয়ে স্টেশন, ১৯৫০-৬০’, সাউথ এশিয়া রিসার্চ, ৪২ (১), ২০২১।
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট