সাহেবপাড়ার হোটেল থেকে বেরিয়ে তাই চারিদিকে হই-হট্টগোল, একগুচ্ছ হকার, ফুটপাত দখল-করা অস্থায়ী বিকিকিনির মেলা, ভিখিরির দল দেখে ফরাসি নৃতত্ত্ববিদের ২০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদের কথা মনে পড়ে না, বরং প্রায় পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ে ধাক্কা দেওয়া উত্তর-ঔপনিবেশিক নাগরিক বাস্তব স্থান-কাল নির্বিশেষ তৃতীয় বিশ্বের শহরের এক সাধারণ ধারণাকেই পুষ্ট করে। আর এই ধারণা সঙ্গে নিয়েই পশ্চিমি পর্যটকদের দল কলকাতায় আসে। গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে কলকাতা শহরের যে একমাত্রিক ছবি আমরা বিদেশি ট্যুরিস্টদের লেখা, ছবি, বর্ণনায় দেখতে পাই, তা কলকাতার দারিদ্রকে এক নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছে।
৩১.
পৃথিবী-বিখ্যাত ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ ক্লদ লেভি-স্ট্রাউস কলকাতায় এসেছিলেন ১৯৫০ সাল নাগাদ। বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমাজবিজ্ঞানীর স্মৃতিকথায় এই শহরের এক নিদারুণ করুণ ছবি ফুটে ওঠে:
Every time I emerged from my hotel in Calcutta, which was besieged by cows and had vultures perched on its window-sills, I became the central figure in a ballet which would have seemed funny to me, had it not been so pathetic. The various accomplished performers made their entries in turn: a shoeblack flung himself at my feet; a small boy rushed up to me, whining ‘One anna, Papa, one anna!’ a cripple displayed his stumps… And then there were a whole host of minor players, men who touted for rickshaws, gharries and taxis. There were as many vehicles as one could possibly want, only a yard or two away, waiting in line by the pavement…. Not to mention the multitude of merchants, shopkeepers and street-hawkers, to whom one’s advent brought a promise of Paradise, since one was perhaps going to buy something from them…
A single obsession, hunger, prompts this despairing behaviour; it is the same obsession which drives the country-dwellers into the cities and has caused Calcutta’s population to leap from two to five millions in the space of a few years…
জাতিগোষ্ঠী ও ‘মিথ’ নিয়ে আলোচনায় গঠনতান্ত্রিক যুক্তিকাঠামো ব্যবহার করে যিনি সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতি চর্চায় মোড় ঘোরানো সব বই-প্রবন্ধ লিখেছেন, তিনি যখন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে কলকাতার ছবি আঁকলেন তখন যেন কিছু নির্দিষ্ট চিত্রকল্প, রূপক, আর সাধারণ বুদ্ধির ছাপ পড়ল তাতে। কলকাতা তাঁর কাছে দারিদ্র, খিদে, ভিখিরি, দালালদের শহর। বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের শহর নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা যেন পুরোটাই প্রথম বিশ্বের অভিজ্ঞতা-প্রসূত; তাই ভারতের তাবড় বড় শহরই তাঁর চোখে ‘বস্তি’ বলে মনে হয়।
What we are ashamed of as if it were a disgrace, and regard as a kind of leprosy, is, in lndia, the urban phenomenon, reduced to its ultimate expression: the herding together of individuals whose only reason for living is to herd together in millions, whatever the conditions of life may be. Filth, chaos, promiscuity, congestion; ruins, huts, mud, dirt; dung, urine, pus, humours, secretions and running sores: all the things against which we expect urban life to give us organised protection, all the things we hate and guard against at such great cost, all these by-products of cohabitation do not set any limitation on it in India. They are more like a natural environment which the Indian town needs to prosper.
ভারতের শহরগুলি যেন সভ্যতার মাপকাঠিতে বিচার্য নয়; প্রকৃতির আদিমতার মধ্যেই ভারতীয় নাগরিক অভিজ্ঞতা নিমজ্জিত। পশ্চিমি-চোখে উনিশ শতক থেকেই কলকাতার এই ছবি কমবেশি পাওয়া যায়। ঔপনিবেশিক আমলে ‘দেশীয়দের এলাকা’ বা নেটিভ কোয়ার্টারের বর্ণনায় এই বক্তব্য বারে বারে এসেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী কলকাতার আর দিশি-বিলিতি ভাগ নেই, তাই পুরোটাই এক বড়সড় বস্তি। সাহেবপাড়ার হোটেল থেকে বেরিয়ে তাই চারিদিকে হই-হট্টগোল, একগুচ্ছ হকার, ফুটপাত দখল-করা অস্থায়ী বিকিকিনির মেলা, ভিখিরির দল দেখে ফরাসি নৃতত্ত্ববিদের ২০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদের কথা মনে পড়ে না, বরং প্রায় পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ে ধাক্কা দেওয়া উত্তর-ঔপনিবেশিক নাগরিক বাস্তব স্থান-কাল নির্বিশেষ তৃতীয় বিশ্বের শহরের এক সাধারণ ধারণাকেই পুষ্ট করে। আর এই ধারণা সঙ্গে নিয়েই পশ্চিমি পর্যটকদের দল কলকাতায় আসে। গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে কলকাতা শহরের যে একমাত্রিক ছবি আমরা বিদেশি ট্যুরিস্টদের লেখা, ছবি, বর্ণনায় দেখতে পাই, তা কলকাতার দারিদ্রকে এক নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছে।
এই উপস্থাপনার উপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক সহায়তা আর তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র মোচনের এক রূপরেখা তৈরি হয়। প্রথম বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবর্গ থেকে শুরু করে সাধারণ মধ্যবিত্ত ‘বাজেট ট্যুরিস্ট’, বিখ্যাত লেখক-সাহিত্যিক থেকে ‘লোনলি প্ল্যানেট’-এর গাইড বই–সকলের কাছেই ‘কলকাতা’ এক বিশেষ অভাবের ছবি তুলে ধরে, যার দরকার আছে সহানুভূতির, প্রয়োজন আছে অনুদানের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এক চক্রাকার আবর্তে তাই পড়ে যায় কলকাতার ‘বর্তমান’, যেখানে ঔপনিবেশিক অতীতের কথা মনে থাকে না। আধুনিক ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সাম্যের কথা ভাবা যায় না, তাই দান গ্রহীতার ভূমিকায় নতজানু হয়েই থাকাই দস্তুর ছিল সদ্য স্বাধীনতা-প্রাপ্ত সাম্রাজ্যের কলোনিগুলির। ‘ভালো’ করতে চাওয়ার মধ্যে যে কর্তৃত্ব থাকে তা অপরের ক্ষমতায়নের প্রশ্নকে স্বীকৃতি দেয় না। এর ফলে সামাজিক অসাম্যের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক পালাবদলের পরও টিকে থাকে।
উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের আলোচনার সূত্র ধরে আমরা এখন এইসব লেখাপত্র পড়ে বুঝতে পারি এর অন্তর্নিহিত রাজনীতির চরিত্র, ধরতে পারি ক্ষমতার স্বরকে। কলকাতা নিয়ে আলোচনায় ইতিহাসবিদ বা সমাজ বিজ্ঞানীরা এই পশ্চিমি দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্ন করেছেন নানাভাবে, তুলে ধরেছেন নাগরিকতার অন্য নানা আঙ্গিক, দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক নগরায়নের সীমাবদ্ধতা কীভাবে বিপর্যস্ত করেছে নাগরিক পরিষেবা, চিত্রিত করেছেন শহরের নির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক ‘উন্নতির’ মানচিত্র। কিন্তু এই যাবতীয় আলাপ-আলোচনা সত্ত্বেও আমরা এখনও কলকাতার ‘অভাব’ নিয়ে গবেষণা থামাতে পারিনি। সবসময়েই কলকাতা ধাওয়া করে চলেছে ‘উন্নয়ন’-এর। তাই বিশ্বের তো বটেই, ভারতের অন্যান্য বড় শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও কলকাতার হার নিশ্চিত।
কলকাতার বাসিন্দারাও এই ‘অভাব’ মেনে নেন। তাই অনেকেই শহরের (বাঙালি) সংস্কৃতিতে আশ্রয় খোঁজেন। মেধার উৎকর্ষে আশ্বস্ত হন। কিন্তু শহরের মধ্যে আমরা-ওরার ভাগ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হন না। বস্তি এখনও কলকাতায় আছে। ফুটপাত জুড়ে আছেন হকাররা। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কাছে এসবই অবাঞ্ছিত উপদ্রব। নিজেদের অভিজ্ঞতা-প্রসূত দৈনন্দিন ‘জঞ্জাল’ নিয়ে আমরা অনেক বেশি মুক্তকণ্ঠ। নাগরিক পরিষেবার অসামঞ্জস্য নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা এই শহরে। কিন্তু এই দুরবস্থা যে গঠনতান্ত্রিক অসাম্যের ইঙ্গিত দেয়, ফরাসি নৃতত্ত্ববিদের মতোই তা আলোচনা করার কথা আমাদের মাথায় আসে না; পাশ কাটিয়ে যেতে পারাটাই উদ্দেশ্য।
আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির যে প্রচণ্ড ক্ষমতা, তাকে ছাপিয়ে যাওয়া সহজ নয়। তাই আঠারো-উনিশ শতক জুড়ে কলকাতার যে বিবরণ বিভিন্ন পর্যটকরা দিয়েছেন সেগুলি খানিক অস্বীকার করতে পারলেও বিশ শতকের কলকাতা যেন এখনও আমাদের আশেপাশে রয়েছে। সেই রূপকল্পগুলি এখনও শহরের ধারণাকে নানাভাবে খোরাক জুগিয়ে চলেছে। একে অস্বীকার করার মানে নেই, বরং বিশ্লেষণ করা জরুরি।
ঋণস্বীকার: John Hutnyk, The Rumour of Calcutta: Tourism, Charity and the Poverty of Representation (1996)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩০: উপনিবেশে দেশীয় সংস্কৃতির রেশ: কলকাতার ‘জেন্টেলম্যান’দের নানা ক্লাব
পর্ব ২৯: মেসের বাঙালি ছাত্ররা ঝাঁপ দিয়েছিল সরকার-বিরোধী কর্মকাণ্ডে
পর্ব ২৮: কলকাতার রাস্তা নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়, দেখিয়ে দিয়েছিল পালকি-বেহারাদের ধর্মঘট
পর্ব ২৭: কোনটা কলকাতা, কোনটা নয়!
পর্ব ২৬: দ্বীপের মতো করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছিল কলকাতাকে
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট