উনিশ-বিশ শতকের কলকাতায় বসবাসের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে হলে শহরের পাড়াগুলি নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ে। যিনি কলকাতায় থেকেছেন কখনও, তাঁকে ‘পাড়া’ শব্দটি বললে এক লহমায় বুঝে যাবেন কী বলা হচ্ছে। পাড়া তো আমাদের খেলাধুলো, প্রেম-ভালবাসা, ঝগড়াঝাঁটি, সরকার-রাজনীতি, সবের মূলে। পাড়ার নির্দিষ্ট কোনও সীমানা নেই, কিন্তু পাড়ার লোকে সবাই জানে কোথায় ‘অন্য পাড়া’ শুরু হচ্ছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ছাড়া এই অনির্দিষ্টতা খাতায়-কলমে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। যেমন পাড়ার রাস্তায় ক্রিকেট খেলার নিয়ম– যেখানে গলি সরু, দু’ধারে বাড়ির দেওয়াল, সেখানে একরকম; আবার যেখানে রাস্তা-ফুটপাত মিলিয়ে খানিক চওড়া এলাকা, সেখানে আরেক রকম। ব্যাট-বল-উইকেটের ধারণা এক থাকলেও, ক্রিকেটের আইন-কানুনের নানা অভিনব রূপান্তর ঘটিয়ে এক এক পাড়ায় এক এক রকমের খেলা চলে।
৩২.
Dawn had broken when he said: “Sire, now I have told you about all the cities I know.”
“There is still one of which you never speak.”
Marco Polo bowed his head.
“Venice,” the Khan said.
Marco smiled. “What else do you believe I have been talking to you about?”
The emperor did not turn a hair. “And yet I have never heard you mention that name.”
And Polo said: “Every time I describe a city I am saying something about Venice.”
“When I ask you about other cities, I want to hear about them. And about Venice, when I ask you about Venice.”
“To distinguish the other cities’ qualities, I must speak of a first city that remains implicit. For me it is Venice.”
(Italo Calvino, Invisible Cities)
অন্য কোনও শহরের কথা বলার সময়ে মার্কো পোলোর মতোই আমরা প্রত্যেকে কি আমাদের নিজেদের শহরের কথাই বলি? হয়তো সজ্ঞানে নয়, কিন্তু মাথার ভিতরে কি একটা তুলনা চলতেই থাকে সবসময়ে? নিজের শহরই বা কী? যেখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, নাকি যে শহরে কাজের সূত্রেই হোক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, দীর্ঘদিন বাস করেছি? শহরের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ একইসঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত। বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন– সব মিলিয়েই আমাদের নাগরিক অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। আবার একই সঙ্গে নির্জন একাকী নানা মুহূর্ত একান্তভাবেই আমাদের নিজস্ব এক শহরের স্মৃতি গড়ে দেয়। কিন্তু এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিসর ছাপিয়ে শহর নিয়ে আলোচনা করার উপায় কী? সমাজ বিজ্ঞানের নানা পন্থা অবলম্বন করে আমরা নগরায়নের রূপরেখা, নাগরিক পরিষেবার হাল-হকিকত, শহরের সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করি, চিন্তাভাবনা করি। সেইসব লেখাপত্র আমাদের যেমন কোনও একটি বিশেষ শহর সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে তেমনই নাগরিক সভ্যতার কিছু সাধারণ ধ্যান-ধারণা সম্পর্কেও ইঙ্গিত দেয়।
তবে যে কোনও শহরেরই নিজস্ব কিছু ছাপ থাকে, একটা ধরন থাকে, যা অন্য জায়গার থেকে আলাদা। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় সেই নিজস্বতা প্রকাশ করা অনেকসময়েই দুরূহ হয়ে ওঠে। বিস্তর বর্ণনা আর তত্ত্বকথার মধ্য দিয়ে হয়তো তার আভাস দেওয়া সম্ভব, কিন্তু পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। আর সেখানেই চলে আসে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ।
উনিশ-বিশ শতকের কলকাতায় বসবাসের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে হলে শহরের পাড়াগুলি নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ে। যিনি কলকাতায় থেকেছেন কখনও, তাঁকে ‘পাড়া’ শব্দটি বললে এক লহমায় বুঝে যাবেন কী বলা হচ্ছে। পাড়া তো আমাদের খেলাধুলো, প্রেম-ভালবাসা, ঝগড়াঝাঁটি, সরকার-রাজনীতি, সবের মূলে। পাড়ার নির্দিষ্ট কোনও সীমানা নেই, কিন্তু পাড়ার লোকে সবাই জানে কোথায় ‘অন্য পাড়া’ শুরু হচ্ছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ছাড়া এই অনির্দিষ্টতা খাতায়-কলমে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। যেমন পাড়ার রাস্তায় ক্রিকেট খেলার নিয়ম– যেখানে গলি সরু, দু’ধারে বাড়ির দেওয়াল, সেখানে একরকম; আবার যেখানে রাস্তা-ফুটপাত মিলিয়ে খানিক চওড়া এলাকা, সেখানে আরেক রকম। ব্যাট-বল-উইকেটের ধারণা এক থাকলেও, ক্রিকেটের আইন-কানুনের নানা অভিনব রূপান্তর ঘটিয়ে এক এক পাড়ায় এক এক রকমের খেলা চলে। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত, পাড়াতুতো জীবন কলকাতার নাগরিকতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর এর নিরিখেই আমরা যাচাই করি অন্য শহরকে, অন্য নাগরিক অভিজ্ঞতাকে। এমনকী, কলকাতার পাশেই গড়ে ওঠা সল্টলেকের জ্যামিতিক নগরায়ন সাবেক শহরের পাড়া-জীবনের থেকে কতটা আলাদা তাই নিয়ে কখনও হা-হুতাশ, কখনও বক্রোক্তি করি।
একইভাবে শহরের কোনও এলাকার নাম বললে কলকাতাবাসীর মনে তৎক্ষণাৎ একটা ছবি ফুটে ওঠে, যার নির্দিষ্ট কিছু মানে আছে, কিছু বিশেষ ‘চিহ্ন’ আছে। এ যেন এক সাংকেতিক ভাষা, যা ‘বাইরের’ কেউ জানে না। তাই ‘বড়বাজার’, ‘বাগবাজার’, বা ‘রাজাবাজার’-এর যেমন বিস্তর ব্যবধান, তেমনই দূরত্ব ‘গড়িয়া’ আর ‘গড়িয়াহাট’-এর। ‘কলেজ স্ট্রিট’ আর ‘পার্ক স্ট্রিট’ দুই বিশেষ নাগরিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক। ‘বিজয়গড়’ বা ‘নেতাজী নগর’ নামের মধ্যেই ‘বড় ইতিহাস’ লুকিয়ে আছে। এইসব ধারণাই আমাদের দৈনন্দিন নগর-যাপনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে– গল্প-আড্ডায়, লেখাপড়ায়, পথচলতি কথাবার্তায়, সাহিত্য-সিনেমা, খবরের কাগজ বা ফেসবুকের পাতায় চোখ বুলিয়ে।
কলকাতার জনপরিসরের বৃহত্তম উৎসব দুর্গাপুজোর উদযাপনেও মিশে থাকে শহরের নাগরিকতার এক বিশেষ ‘কোড’। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরাঘুরির এক নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করে নিয়েছি যেন আমরা। তাই একদিন ‘উত্তর’, তো পরের দিন ‘সাউথের ঠাকুর’। ‘শ্রীভূমি’-র পুজো মানে লাইনে দাঁড়িয়ে কেটে যাবে গোটা একটা সন্ধে। অন্যদিকে রয়েছে বালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে ‘একডালিয়া’, ‘সিংঘি পার্ক’ দেখে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে দু’পাশের প্যান্ডেল দেখতে দেখতে কালীঘাট হয়ে মুদিয়ালি বা ভবানীপুর যাওয়া। এই ‘বিশেষ মানচিত্র’ আমাদের নিজেদের, যা বহু বছর ধরে সামগ্রিকভাবে গড়ে উঠেছে, কারওর নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই। কিন্তু নগরজীবনের জনপরিসরে সাধারণ জনগণের এই অংশগ্রহণ অন্যরকম মান্যতা পেয়ে যায় যখন খবরের কাগজে পুজো পরিক্রমার ম্যাপ এঁকে দেওয়া হয়, বা কলকাতা পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচলের পাশাপাশি জনতার স্রোত নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করে।
এই যাবতীয় ‘ন্যারেটিভ’-এর মধ্যে দিয়েই যে কোনও শহরের একটা ‘ইমেজ’ গড়ে ওঠে, যা আমাদের বিভিন্ন শহর সম্পর্কে একটা বিশেষ ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে। তাই ‘শহরের ইতিহাস’ অনেকসময়েই হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ইতিহাস। যে কোনও শহর নিয়েই লেখা বই-প্রবন্ধের একটা বড় অংশই হয় সেই শহরে বাস করার অভিজ্ঞতা। ফলে অনেকসময়েই শহরের ইতিকথা হয়ে পড়ে নস্ট্যালজিয়া-আক্রান্ত রোমন্থন, বিগত কালের এক খণ্ডচিত্র। তবে এর মানে এই নয় যে কোনও সমাজ বিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদ নিজের শহর ছাড়া লেখেন না। বরং তাঁরা সর্বদাই চেষ্টা করেন নিজেদের ব্যক্তি-পরিচিতির বাইরে বেরিয়ে নগরায়ন বা নগর-জীবনের বিভিন্ন পরিসরের নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা। কতদূর তা সম্ভব, তাই নিয়ে অবশ্য পক্ষে-বিপক্ষে নানা কূট তর্ক আছে।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার পরিসরের বাইরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই আমাদের চালিত করে। আমরা নানা শহর ঘুরলেও যেন মনে মনে সর্বদা মেপে নিতে চাই নিজের শহরের সঙ্গে। কুবলাই খানের প্রশ্নের জবাবে তাই মার্কো পোলো ভাবেন যে,
Marco Polo imagined answering (or Kublai Khan imagined his answer) that the more one was lost in unfamiliar quarters of distant cities, the more one understood the other cities he had crossed to arrive there, and he retraced the stages of his journeys, and he came to know the port from which he had set sail, and the familiar places of his youth, and the surroundings of home, and a little square of Venice where he gamboled as a child. (Italo Calvino, Invisible Cities)
‘নাগরিক ইতিহাস’-এর জনজীবনে সাধারণ মানুষের প্রবল উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তাই পেশাদার সমাজ বিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদও গুরুত্ব দিয়ে পড়েন এই আলাপ-আলোচনা, স্মৃতিচারণা, বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বয়ানগুলিকে। তার মধ্যে থেকেই উঠে আসে শহরকে পাঠ করার নতুন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, খুঁজে পড়া শুরু হয় অতীতের অবদমিত স্বরগুলিকে। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই নির্মিত হতে থাকে শহরের নতুন নতুন চিত্র।
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩১: বিদেশি ট্যুরিস্টদের কাছে কলকাতা কি এখনও ‘অভাবের শহর’?
পর্ব ৩০: উপনিবেশে দেশীয় সংস্কৃতির রেশ: কলকাতার ‘জেন্টেলম্যান’দের নানা ক্লাব
পর্ব ২৯: মেসের বাঙালি ছাত্ররা ঝাঁপ দিয়েছিল সরকার-বিরোধী কর্মকাণ্ডে
পর্ব ২৮: কলকাতার রাস্তা নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়, দেখিয়ে দিয়েছিল পালকি-বেহারাদের ধর্মঘট
পর্ব ২৭: কোনটা কলকাতা, কোনটা নয়!
পর্ব ২৬: দ্বীপের মতো করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছিল কলকাতাকে
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট