হাসির নামে, বছরের পর বছর, একদল মানুষকে নাগাড়ে আঘাত করাও কি ন্যায্য? অথচ, এ দেশের মেনস্ট্রিম সিনেমায় হয়ে আসছে সেটাই। সমকামী মানেই ভাঁড়, নপুংসক মানেই ভিলেন। বলিউডের প্রথম খোলাখুলি গে চরিত্রে অনুপম খেরকে (‘মস্ত কলন্দর’) যেভাবে দেখানো হল– সেটা আমোদ নয়, অপমান।
কমেডি বিষয়টা আসলে খুব সিরিয়াস। কাউকে হাসাতে পারা চাড্ডিখানি ব্যাপার নয়। কিন্তু, হাসির নামে, বছরের পর বছর, একদল মানুষকে নাগাড়ে আঘাত করাও কি ন্যায্য? অথচ, এ দেশের মেনস্ট্রিম সিনেমায় হয়ে আসছে সেটাই। সমকামী মানেই ভাঁড়, নপুংসক মানেই ভিলেন। বলিউডের প্রথম খোলাখুলি গে চরিত্রে অনুপম খেরকে (‘মস্ত কলন্দর’) যেভাবে দেখানো হল– সেটা আমোদ নয়, অপমান। আর, ‘সড়ক’-এ সদাশিব অম্রপুরকারকে দেখে আঁতকে ওঠেননি, আছেন না কি এমন দর্শক? নয়ের দশকেই, এল ‘তমন্না’। সেখানে কাঁদিয়ে ছাড়লেন পরেশ রাওয়াল। ভারতীয় ফিল্মে নপুংসক চরিত্রের কথা উঠলে, ‘তমন্না’ থাকবে প্রথম সারিতেই, চিরকাল।
ছয়ের দশকের শেষদিকে, হিন্দি পত্রিকা ‘ধর্মযুগ’-এর সম্পাদক ছিলেন প্রেম কাপুর। প্রাচীন ভারতে কামকলায় ভরা ভাস্কর্যের নান্দনিক ব্যাখ্যায় ডক্টরেট প্রেম, ‘হংস’ পত্রিকায় পড়লেন কমলেশ্বর প্রসাদ সাক্সেনার ধারাবাহিক, ‘এক সড়ক সাত্তাওন গলিয়াঁ’। স্টোরিটা নিয়ে, সিনেমা বানাবেন ভেবে, দ্বারস্থ হলেন ফিল্ম ফাইনান্স কর্পোরেশনের (এখন, এনএফডিসি)। ফান্ড পেলেন আড়াই লাখ টাকা। কাস্ট করলেন থিয়েটারের পোক্ত অভিনেতাদের। ক্রু নিলেন বাঘা-বাঘা। মিউজিকে, ‘ভুবন সোম’ খ্যাত বিজয় রাঘব রাও। এডিটে, হৃষীকেশ মুখার্জী। সাউন্ড ডিজাইনে, মণি কউলের টিম। পর্দায় কবিতাপাঠ করলেন হরিবংশ রাই বচ্চন। মধু ঢেলে দিল গুলাম মুস্তাফা খাঁর কণ্ঠে ‘সজনা কাহে নাহি আয়ে…’, আর সতীশ ভুটানির গাওয়া ‘তারোঁ কা মেলা ভরা হ্যায় গগন মেঁ…’। সিনেমার নাম, ‘বদনাম বস্তি’।
আরও ফ্ল্যাশব্যাক: পায়ে বেত মেরে নাচাতে হল অমিতাভ বচ্চনকে
হ্যাঁ, ওখানে খোলাখুলি সমকাম ছিল না বটে; তবে, যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল, মানবিকভাবে। এদিকে, কপাল খারাপ প্রেম কাপুরের। গল্পে ডাকাতি আর মানুষ পাচারের মতো ব্যাপার থাকায়, সেন্সরের সার্টিফিকেট এল, ‘A’। বম্বের রিগ্যাল থিয়েটারে স্পেশাল স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা করলেন পরিচালক। শেষ মুহূর্তে, বাতিল হল সেটা। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটা পাঠানোর কথা হল। কিন্তু, হৃষীকেশের এডিটিংয়ে খুশি না হয়ে, আরেকটু কাটা-ছেঁড়া করতে গেলেন প্রেম। ফলে, পেরিয়ে গেল জমা দেওয়ার তারিখ। অবশেষে, হলে রিলিজ করলেন। দর্শকেরা বললেন, কী বোরিং সিনেমা রে বাবা!
ফিল্মটা একদিন হারিয়ে গেল, রহস্যজনকভাবে। এনএফডিসি বা এনএফএআই-এর কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারলেন না, ৪৯ বছরের পুরনো প্রিন্ট কোথায়! নভেম্বর ২০১৯-এ, আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি-র ছাত্রী সিমরন ভাল্লা আর ব্লক মিউজিয়াম অফ আর্টের কিউরেটর মাইকেল মেৎগার ভাবলেন, ছয়ের আর সাতের দশকের ভারতীয় সিনেমা নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করবেন। রথী-মহারথীদের পাশাপাশি, রাজ কাপুরের কাজ খুঁজতে শুরু করলেন তাঁরা। ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলেন, বার্লিনের আর্সেনাল আর্কাইভে, রাজ কাপুরের ফিল্মোগ্রাফিতে– ‘বদনাম বস্তি’!
আরও ফ্ল্যাশব্যাক: ‘আমি গানের দোকান খুলতে আসিনি’, যশ চোপড়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ‘দিল চিজ ক্যা হ্যায়’-এর গীতিকার
হয়েছিল কী, পশ্চিম জার্মানির ম্যানহাইম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটা পাঠিয়েছিলেন প্রেম, ১৯৭২-এ। আর, ভাগ্যিস পাঠিয়েছিলেন! নইলে, সমকাম নিয়ে ভারতের প্রথম সিনেমাটা মুছেই যেত, চিরতরে। তবে হ্যাঁ, কপালটা তাঁর খারাপই। ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে, ২০২০-তে, ওটা দেখাবেন বলে স্থির করলেন সিমরন আর মাইকেল। সঙ্গে, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গুরু দত্তের কাজও। আচমকা শুরু কোভিডের লকডাউন। ব্যাস, বাতিল করতে হল ফেস্টিভ্যাল।
কর্ণাটকের মাঠে-ঘাটে বেড়াতে বেড়াতে, টিমেরি এন. মুরারি দেখলেন ছাগল চরাচ্ছে স্নিগ্ধ এক কিশোরী। ভাবলেন, ফোটো তোলা যাক! ক্যামেরা বের করতেই, সে মেয়ে চমকে চিল্লিয়ে, জড়ো করে ফেলল লোকজন। মারমুখী গ্রামবাসীদের কোনওমতে ঠান্ডা করলেন তিনি। জানতে পারলেন, বহুদিন ধরেই, ওই গ্রামের মেয়েদের কিডন্যাপ করে, বেচে দেওয়া হয় শহরের বেশ্যাপল্লিতে। সারাজীবনের মতো নিখোঁজ হয়ে যায় তারা।
আরও ফ্ল্যাশব্যাক: মেনস্ট্রিম হিরোদের ঘায়েল করেছিল শাকিলার ঢেউ
বাড়ি ফিরে, মুরারি লিখলেন ‘দায়রা’। আত্মরক্ষা করতে, এক ধর্ষিতা (সোনালি কুলকার্নি) সেজে থাকে পুরুষ। তাকে পুরুষ সাজার ট্রেনিং দেয় কে? এক ট্রান্সভেস্টাইট (নির্মল পাণ্ডে)। দু’জনে হয়ে ওঠে দু’জনের আশ্রয়। অনেকগুলো সিন আর ডায়লগ কেটে, সেন্সর ‘A’ রেটিং দিল। তাও, কখনও মুক্তি পেল না এ দেশে। যদিও, অনেক ফেস্টিভ্যালে দেখানো হল। ক্রিটিকরাও মাথা নোয়ালেন ‘দায়রা’-র কাছে।
সেন্সরের ছাড়পত্র না পাওয়ায়, ইরফান খানের একটা অভিনয় দেখতে বঞ্চিত হলাম আমরা। সিনেমার নাম, ‘অধুরা’। এক বিবাহিত সাংবাদিক (ইরফান) আর এক বয়স্ক শিল্পপতির (আশিস বলরাম নাগপাল) প্রেম। সাহসী দৃশ্যে ছয়লাপ কাহিনি, পরিণতিতে ট্র্যাজিক। এ দেশের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীরা সে আগুন নিতে পারেননি তখন। যদিও, দমার লোক ইরফান ছিলেন না। এরপরেও, গে চরিত্র করলেন, শর্ট ফিল্ম ‘মাইগ্রেশন’-এ।
আর. রাজ রাওয়ের একগুচ্ছ কবিতা পড়ে, রিয়াদ ভিঞ্চি ওয়াদিয়া ভাবলেন বম্বের সমকামী পুরুষদের জীবনযাপন নিয়ে একটা ফিল্ম বানাবেন। নয়ের দশকে কাজটা করা সহজ ছিল না। রিয়াদ আর রাজ দু’জনে মিলে স্ক্রিপ্ট লিখলেন। কিন্তু, অনেক ঘুরেও, ফান্ড জোগাড় করতে কালঘাম। ততদিনে, রাজ আরও কয়েকটা কবিতা লিখেছেন, ‘বমগে’ নামে। রিয়াদের মাথায় খেলে গেল একটা আইডিয়া। স্থির করলেন, নতুন কবিতাগুলো নিয়ে, ছ’খানা শর্ট ফিল্মের সিরিজ বানাবেন। সিনেমারও নাম, ‘বমগে’।
আরও ফ্ল্যাশব্যাক: টিপ টিপ বরসা পানি ও বুক ঢিপ ঢিপ নাইন্টিজ
টাকা-পয়সা কম থাকায়, প্রথমে ভাবলেন চেনা-জানা সমকামীদের দিয়েই কাজ করাবেন। কিন্তু, ওইসময়ে প্রকাশ্যে আসতে রাজি হলেন না কেউই। তখন, অ্যাডভার্টাইজিং ইন্ডাস্ট্রির বন্ধুদের সাহায্য নিলেন। প্রধান চরিত্রে পাওয়া গেল রাহুল বোসকে। অধিকাংশ দৃশ্য শুট হল গেরিলা স্টাইলে। যৌন দৃশ্যের শুটিংয়ে যাতে ঝামেলা না হয়, সেজন্য লোকজনকে বোঝালেন রিয়াদ, ফিল্মটার বিষয়: র্যাগিং। এতকিছুর পরেও, সেন্সরের কাছে সিনেমাটা পাঠালেন না তিনি। নিশ্চিত ছিলেন, সবুজ সংকেত কখনওই তারা দেবে না।
‘রাজিয়া সুলতান’ সিনেমায়, একটা গানের দৃশ্যে, মহিলাদের নৌকাবিহার– মনে আছে? পরভিন ববি আর হেমা মালিনী, ক্লোজ-আপে দু’জনের মুখ, কাছাকাছি; সঙ্গে সঙ্গে, একটা বড় ঝালর ঢেকে দিল তাঁদের। সহচরীরা একে অন্যকে ইশারা করল চুপ থাকার। আন্দাজ করা হয়, হিন্দি সিনেমায় ওটাই প্রথম লেসবিয়ান প্রেমের ইঙ্গিত। এর প্রায় ১২-১৩ বছর পর, দীপা মেহেতার, ‘ফায়ার’। শাবানা আজমি আর নন্দিতা দাস, স্বাভাবিকভাবেই, সারা দেশে খোলাখুলি আগুন ধরালেন।
রমজান মাস, ১৯৭৫। মাহিমের গলিতে, হার্মাফ্রোডাইট টিকু কুড়িয়ে পেলেন একটি সদ্যোজাত মেয়েকে। স্নেহে-মমতায় বড় করে তুললেন সেই শিশুকে। হ্যাঁ, ‘তমন্না’-র কাহিনি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। কাহিনিতে টিকু, এক প্রাক্তন অভিনেত্রীর একমাত্র সন্তান, যাকে স্বীকৃতি দেয়নি জন্মদাত্রী মা। বলা যায়, ‘তমন্না’-রই প্রিক্যুয়েল, ‘দরমিয়াঁ’। হার্মাফ্রোডাইটের চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে, অনুপম খেরের কাছ থেকে কল্পনা লাজমির ফোন নম্বর জোগাড় করলেন শাহরুখ খান। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। ঘটনাটা নয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, তখন তিনি রীতিমত স্টার। মিটিং হল। পারিশ্রমিকের আলোচনা না করে, কাজটা করতে চাইলেন শাহরুখ। কিন্তু, ঝামেলা বাঁধল তাঁর ডেট নিয়ে। এদিকে, দেরি করতে চাইছেন না কল্পনা; তাই, রোলটা পেলেন আরিফ জাকারিয়া। ‘শূল’ দেখে, সায়াজি সিন্ধের ভক্ত হয়ে থাকলে, ‘দরমিয়াঁ’-তে তাঁকেও দেখুন। চরিত্রের নাম, চম্পা।
তবে, পুরোপুরি নিরাশ কখনও করেন না শাহরুখ। তাঁর ডেবিউ ফিল্ম, টিভিতেই। নাম, ‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোজ ওয়ানস’। খুবই ছোট্ট ভূমিকা ছিল তাঁর। হ্যাঁ, সেখানে তিনি সমকামী পুরুষের চরিত্রে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved