আমার মনে আছে বাপির ফোর্থ স্টেজ ক্যানসার, আমি বাপিকে মোটিভেট করার জন্য পাঞ্জা লড়ছি। কোনও দিনও আমি বাবাকে পাঞ্জাতে হারাতে পারিনি। ভাইয়ের কাছেও যতবার খেলেছি, হেরেছি। বাপির সেই শারীরিক অবস্থায় আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম যে, বাপি পারবে না কিন্তু আমি বাবাকে হারাব না। এমন একটা ভাব করব যেন প্রায় সমানে-সমানে শেষ হবে। আমি পারিনি। বাপি আমাকে হারিয়ে দিয়েছিল।
আমার এক বন্ধু ছিল, তখন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছি, ’৮৪ সাল। কলেজে পড়তাম, রোজই নতুন বন্ধু হত। বন্ধুই বলতাম, তখন সবাই বন্ধু– পরিচিত হলেই তাকে ‘বন্ধু’ বলে ফেলতাম। তা এরকমই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায়। সে যে ওরকম দক্ষ চোর, সেটা আমার জানা ছিল না, চমকে উঠেছিলাম ওর চুরি করার কায়দা দেখে। সাহস দেখে। কী সাংঘাতিক শক্তিশালী ওর নার্ভতন্ত্র। আমি ধুকপুকে বুকে ওর সঙ্গে মেলায় তফাত রেখে রেখে ঘুরছিলাম। ও একে একে প্রেমিকার জন্য টিপ, মায়ের জন্য কানের দুল, বাবার জন্য একটা পোড়া মাটির রবীন্দ্রনাথ চুরি করেছিল। আমার জন্য ছোট্ট স্লিং (Sling) ব্যাগ চুরি করে দিয়েছিল লেদারের। আমি সেই ব্যাগটা ইউজও করতাম।
আমাদের সময় ইলেভেন-টুয়েলভেও কলেজে পড়ানো হত, ভর্তি হয়েছিলাম স্কটিশ চার্চ কলেজে। পিওর সায়েন্স নিয়ে। মাধ্যমিকে যা নম্বর পেয়েছিলাম তাতে ডাইরেক্ট অ্যাডমিশন হয়ে গিয়েছিল স্কটিশ চার্চ কলেজে, ঘুষ-টুস দিতে হয়নি। আমরা তিন বন্ধু– ভীষ্মদেব, শেখর আর আমি একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম দারুণ আনন্দে। তখনও আমি কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, ম্যাথের বইগুলো দেখিনি। স্কটিশ চার্চ কলেজ আমার বাবার কলেজ, আমার দাদুরও, কাকারাও পড়েছেন ওই কলেজে। আমি শুধু ভর্তি হয়েছিলাম, পড়িনি।
ইনফ্যাক্ট পড়াশোনা আমি কোনও দিনই ঠিকঠাক করিনি, গল্পের বই, খবরের কাগজ, বাংলা ইংরেজির সিলেবাসের গল্পগুলো, কয়েকটা কবিতা আর টুকটাক সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকা– এই আমার পড়ার দম ও পরিধি। ভূগোল, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইতিহাস– এসব ছিল আমার ঘুমের ওষুধ, দু’-পাতাও পড়তে হত না তার আগেই নিদ্রাদেবী ভর করতেন আমার ওপর। আর এই না পড়ার কারণে বাপির কাছে বেধড়ক মার খেতে হয়েছে মাঝেমধ্যেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত বাবার কাছে অঙ্ক শিখতে গিয়ে আমার খুব গুলিয়ে যেত। সারাক্ষণ ভয়ে থাকতাম এই বোধহয় একটা থাবড়া খাব। আর বাবার মারের কোনও হিসাব ছিল না, গর্দানে দু’-চারবার বাবার থাবড়া খেয়ে আমি শুধু লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যাইনি, এটুকু বলতে পারি, দু’-তিনবার আমার মনে হয়েছিল– আমি নেই।
ক্লাস এইটের পর বাবার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলাম, সুবলবাবুর কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। সুবলবাবু আমাকে অঙ্ক-ফোবিয়া থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ওঁর কাছে যাওয়ার পর অঙ্ক আমার কাছে ধাঁধার মতো হয়ে গিয়েছিল। হেব্বি মজা পেতাম সল্ভ করতে পারলে, ভয় পেতাম না আর।
বাবা আমাকে কোনও দিন বদমাইশি করার জন্য মারেননি। বাপির একটা ফরমুলা ছিল, সেটা খুব চাপের। বাবা আমাকে তিনটি প্রশ্নের বেশি করতেন না। তাও যদি প্রথম আর দ্বিতীয়টা দুটোই ভুল বা ঠিক হত, তৃতীয়টা পর্যন্ত যেতে হত না, একটা ভুল একটা ঠিক হলে তবেই তৃতীয় প্রশ্নের প্রশ্ন উঠত। নইলে না। দুটো ভুল– প্যাঁদানি, জাস্ট প্যাঁদানি। রদ্দাগুলো, উফ্!
বাবার গায়ের জোর ছিল অসম্ভব। ক্রিকেট খেলতেন। ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাব ক্রিকেটও খেলেছেন। মাঝে নাকি বক্সিংও করতেন। সাংঘাতিক শক্তি ছিল আমার বাপের। সেটা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝতাম মাঝেমধ্যেই। আর যতদূর শুনেছি, শ্যাম পার্কে এক মারোয়াড়ি ক্রিকেটার ‘বাঙালি কাঙালি’ টাইপ কিছু গালি দিয়েছিল, সে বাবার একটা লেফট হুক-এ দু’দিন হসপিটালে ছিল।
তবে দুটো প্রশ্ন সঠিক বলে দিতে পারলেও তৃতীয় প্রশ্ন আসত না। বই বন্ধ– ‘মায়া, বেরলম’ বলে অফিস বেরিয়ে যেতেন বাবা। অথবা সন্ধেবেলা হলে চলে যেতেন টিউশন করতে। শেখানো একটা প্যাশন ছিল বাবার, সরকারি চাকরির পাশাপাশি সংসার চালানোর জন্য টিউশনটা প্রয়োজন ছিল। তার থেকেও বেশি প্রয়োজন ছিল আমার পড়ার খরচ চালানো।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আমায় তিনজন ইংরেজি শিক্ষকের কাছে পড়তে যেত হত। আর মাঝেমধ্যে বাবার যে সমস্ত শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের কাছে আমাকে যেতে হত। তাঁরা আমাকে পরীক্ষা করতেন, এক একজন শিক্ষক এক একজন বটগাছ। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হত আমার!
এদিকে রবিবারে শীতের দুপুরে মথুর সেন গার্ডেন লেন থেকে শুনতে পাচ্ছি জয়ন্তদের গলা– ‘হাউজ দ্যাট’ আর আমাকে বাবার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যেতে হচ্ছে বই-খাতা নিয়ে, বউবাজার, উফ্ কী অত্যাচার! বাবার সঙ্গে হেঁটে পাল্লা দেওয়াও দুষ্কর ছিল। সবসময় একটা দূরত্ব থেকে যেত পাঁচ-ছ’ ফিটের, বাবা মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়তেন আমার জন্য। আবার শুরু হত হাঁটা। খু-উ-ব ছোটবেলার কথা বলছি না। তখন আমার বয়স কম নয়। এরকম নয় যে আমি নেহাত শিশু, বাপির তখন হয়তো ৩৬, আমার ১৪। কিন্তু তাল রাখতে পারতাম না বাবার হাঁটার গতির সঙ্গে। কী করে পারব, যে লোকটা ৯ নম্বর বি. কে. পাল অ্যাভিনিউ থেকে লিন্ডসে স্ট্রিট মাঝেমধ্যেই হেঁটে যেতেন। অ্যাটলিস্ট, মাইনে যেদিন পেতেন সেদিন বাবা বাড়ি ফিরতেন হেঁটেই, মাইনে নিয়ে বাসে করে বাড়ি ফিরলে পকেটমারি হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে! একমাসের মাইনের টাকা পকেটমারকে দেওয়ার থেকে দশ কিমি হেঁটে বাড়ি ফেরাটা বাপির কাছে ছিল জলভাত।
আমার মনে আছে, বাপির ফোর্থ স্টেজ ক্যানসার। আমি বাবাকে একটু মালিশ করে দিচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না, আমার হাতে মাসাজ নিলে বাপি ঘুমিয়ে পড়ত, কিন্তু বাপির শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণার উপশম আমার দ্বারা হচ্ছে না। আমি বাপিকে মোটিভেট করার জন্য পাঞ্জা লড়ছি। কোনও দিনও আমি বাবাকে পাঞ্জাতে হারাতে পারিনি। ভাইয়ের কাছেও যতবার খেলেছি, হেরেছি। বাপির সেই শারীরিক অবস্থায় আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম যে, বাপি পারবে না কিন্তু আমি বাবাকে হারাব না। এমন একটা ভাব করব যেন প্রায় সমানে-সমানে শেষ হবে। আমি পারিনি। বাপি আমাকে হারিয়ে দিয়েছিল।