Robbar

তাপস সেন কিংবা খালেদ চৌধুরী নিজের সৃষ্টির জন্য আপস করেননি কোনও দিন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 29, 2024 8:12 pm
  • Updated:October 19, 2024 2:54 pm  

নাটকের দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। একজন আলোকশিল্পী, আলোর জাদুকর তাপস সেন। অপরজন মঞ্চসজ্জার কিংবদন্তি, বিরল প্রতিভা– খালেদ চৌধুরী। আলো এবং মঞ্চের কাজ আমায় বরাবর টানত। অভিনয়ের বাইরে আমি আলোর কাজ করতে ভালোবাসতাম, মঞ্চের কাজও। আমি যখন এই দুই মহীরুহের সঙ্গে কাজ করেছি, শিক্ষানবিশি কাজ শিখছি, নান্দীকারে মঞ্চের আলোকসম্পাত, কিংবা মঞ্চসজ্জা যখন তাঁরা করছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে থেকে বোঝার চেষ্টা করতাম, কীভাবে কোন দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি এই কাজটির মাধ্যমে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন ও দেখাচ্ছেন।

দেবশঙ্কর হালদার

১৯.

নাটকের সমস্ত বিষয় একে-অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই অবজেক্টগুলো একে-অপরকে অবলম্বন করে বাঁচে। অন্যান্য শিল্পেও নিশ্চয়ই এমনটা ঘটে। কিন্তু নাটক কিংবা নাট্যকলার ক্ষেত্রে সেই অস্তিত্বের প্রকাশ অনেক স্পষ্ট।

নাটকে দর্শক সবার আগে প্রত্যক্ষ করেন অভিনেতাকে। আমি যেহেতু অভিনেতা, মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকের বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তুলি, ফলে আমার অভিনয় সত্তার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয় দর্শক-সাধারণের। মঞ্চে নাটক উপস্থাপনায় অভিনেতাকেই খুঁটিয়ে দেখেন দর্শক। বলা হয়ে থাকে, নাটকের ক্ষেত্রে একজন অভিনেতাকে কেন্দ্র করেই ঘটনা-পরম্পরা, যাবতীয় কিছু আবর্তিত হয়। এই ধারণাকে যদি ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিই, তাহলেও একটা ব্যাপার অনস্বীকার্য– নাটকে কোনও কিছুই অভিনেতার পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব নয়।

মঞ্চে দেবশঙ্কর হালদার। ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা মঞ্চ-নাটকের ক্ষেত্রে, দর্শক সবসময় অভিনেতাকে চোখের সামনে দেখছে। তবে অভিনেতাকে কেন্দ্র করে নাটক আবর্তিত হলেও মঞ্চে আরও অনেক কিছু আছে, সেগুলো ছাড়া অভিনেতার প্রকাশ নেই। সেই ‘অনেক কিছু’ আসলে কি? মঞ্চসজ্জা, আলোকসজ্জা এছাড়াও অভিনয়ের নানা আনুসঙ্গিক উপকরণ– যা অভিনেতা মঞ্চে অভিনয়ের সময় ব্যবহার করেন। এই প্রতিটি বস্তুর আলাদা অস্তিত্ব আছে, তা নিয়ে গর্ব আছে, অহংকার আছে। তা সত্ত্বেও এরা অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে বাধ্য। অনেক সময় সেই নির্ভরশীলতার কথা অভিনেতা ভুলে যান। হয়তো বলে বসেন, তাকে ছাড়া নাটক চলবে না। কিন্তু ভেবে দেখলে, তিনি নাটকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ নন।

Here is the review of Tiner Tolowar, Utpal Dutt's great creation reprised by Mukhomukhi
‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে দেবশঙ্কর হালদার, সঙ্গী অভিনেতা শঙ্কর চক্রবর্তী

অভিনেতাকেও অনেককিছুর ওপর নির্ভর করেই মঞ্চে নিজের প্রকাশ ঘটাতে হয়। মঞ্চসজ্জা যিনি করছেন, তিনি সুচারুভাবে মঞ্চকে সাজিয়ে না তুললে কি অভিনেতা নিজেকে মেলে ধরতে পারতেন? তার অভিনয় কি তখন দর্শক-সাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত? উঠত না। একই কথা আলোকশিল্পীও বলতে পারেন। অভিনেতার সামনে প্রশ্ন রাখতেই পারেন, মঞ্চে যদি অভিনেতার গায়ে ওই মায়াবি আলো না ফেলতেন তিনি, তাহলে যথাযথভাবে প্রকাশ ঘটত অভিনেতার? ঘটত না। একটা ফুট-লাইটে যদি অভিনেতাকে ধরার চেষ্টা করতেন আলোকশিল্পী, তাহলে তার যাবতীয় সৌন্দর্য ধসে পড়ত! ঠিক যেমনটা ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বেণীমাধব চাটুজ্জে অর্থাৎ ওই কাপ্তেনবাবু ময়নাকে বলেছিল– একদিন স্টেজে আলো একটু তেরচা করে মুখে মারলেই তোমার সব রূপ ধসে গিয়ে কঙ্কালের অস্থিসার, ওই বীভৎস রূপ বেরিয়ে আসবে। আসলে নাটকের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি উপকরণ, উপাদানের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। একা কিছু নয়, সব মিলে, সবের সমাহারে বিষয়টা সুন্দর, পরিণত। অভিনেতা কখনও-সখনও সেই নির্ভরশীলতার কথা ভুলে যান বটে, তবে যতই ক্ষেত্রবিশেষে তা ভুলে যান, অবচেতনে তিনি সেই নির্ভরশীলতাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য।

তাপস সেন : শতবর্ষে অন্তরঙ্গ আলোর রাজা
তাপস সেন। ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

এই আলোচনা প্রসঙ্গে আমার দু’জনের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। নাটকের দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। একজন আলোকশিল্পী, আলোর জাদুকর তাপস সেন। অপরজন মঞ্চসজ্জার কিংবদন্তি, বিরল প্রতিভা– খালেদ চৌধুরী। আলো এবং মঞ্চের কাজ আমায় বরাবর টানত। অভিনয়ের বাইরে আমি আলোর কাজ করতে ভালোবাসতাম, মঞ্চের কাজও। আমি যখন এই দুই মহীরুহের সঙ্গে কাজ করেছি, শিক্ষানবিশি কাজ শিখছি, নান্দীকারে মঞ্চের আলোকসম্পাত, কিংবা মঞ্চসজ্জা যখন তাঁরা করছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে থেকে বোঝার চেষ্টা করতাম, কীভাবে কোন দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি এই কাজটির মাধ্যমে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন ও দেখাচ্ছেন।

No photo description available.
খালেদ চৌধুরী

…………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………….

দু’জনের মধ্যেই অদ্ভুত পাণ্ডিত্য, সৃষ্টিশীল চেতনা লক্ষ করতাম। একথা অনস্বীকার্য, নিজের কাজটিকে তাঁরা এতই আদরের বলে মনে করতেন যে, তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। এবং সেই সৃষ্টিশীল কর্মটিকে রক্ষা করার জন্য শেষসীমা পর্যন্ত যেতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। সবাইকে নিয়ে সামগ্রিকভাবে কাজ– এটা তাদের মাথায় থাকত বটে, কিন্তু নিজের শ্রেষ্ঠ প্রয়াসে যতক্ষণ না তা পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ সেই চেষ্টা জারি রাখতেন, এমনকী, অন্যের জন্য সেটিকে বিসর্জন দিতেন না। আমরা অনেক সময় অন্যের অনুরোধে কিংবা নির্দেশ মেনে নিজেদের ভাবনা থেকে সরে আসি, নিজেদের অন্তরের দাবিটিকে প্রাধান্য না দিয়ে একটু মেনে-মানিয়ে নিই। কিন্তু তাপস সেন, খালেদ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্ব মেনে-মানিয়ে নেওয়ার মানুষ ছিলেন না। নিজেদের সৃষ্টিকর্মের শ্রেষ্ঠ প্রকাশবিন্দুতে পৌঁছনো না পর্যন্ত তাঁরা কাজ, পরিশ্রম চালিয়ে যেতেন।

…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১৮। প্রাণহীন উপকরণের স্পর্শেই প্রাণ পায় আমার অভিনয়

পর্ব ১৭। যে চশমায় নিজেকে মানানসই লাগে না, তবুও যা পরে থাকতে ইচ্ছে করে

পর্ব ১৬। মৃত্যুর পর কী ঘটছে, একমাত্র মঞ্চ অভিনেতার পক্ষেই জানা সম্ভব

পর্ব ১৫। মঞ্চ থেকে প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, এমন নয়

পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে

পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে

পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা

পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে

পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?

পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়

পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?

পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে

পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার

পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে

পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই

পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে

পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?