হিমাংশুদা, নাটকে আবহ সংগীত দেন। তিনি অভিনয় করেন না, সংলাপ বলেন না, দর্শকাসনের কেউ তাকে দেখতে পায় না, আড়ালে থেকেই যাবতীয় কর্ম করেন। এই যে উনি আমার ওপর নির্ভর করে নিজের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, কিংবা বলা যেতে পারে, ওঁর ওপর নির্ভর করে আমি মঞ্চে নিজের প্রকাশ ঘটাচ্ছি, আসলে আমরা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা চেষ্টা করছি, পরস্পরের ভিতরের জানলাকে খুলে দেওয়ার, নিজের প্রয়াসকে মুক্ত করার। এই আবিষ্কারের আনন্দ ভাষায় বোঝানো যাবে না।
২১.
নাটক বলে নয়, যে কোনও শিল্পকলাতেই একজনের মনের জানলা খোলার জন্য আরেকজনকে দরকার পড়ে।
আমাদের মনের মধ্যে অনেক জানলা। তার বিভিন্ন স্তর আছে। অনেক জানলা আমরা নিজেদের প্রয়াসে খুলতে পারি। আবার কিছু জানলা আছে যা বন্ধ, একার প্রয়াসে খোলা যায় না। মন হয়তো আমাদের বোঝায়, এ জানলা আর কখনও খোলা যাবে না। এতে জং লেগে গেছে। খুললে বিপদ হবে। তখন বাইরে থেকে কেউ এসে মনকে প্রভাবিত করে, বাধ্য করে সেই বদ্ধ জানলাটিকে খুলে ফেলতে। যখন খোলা হয় ওই জানলা, সমস্ত শঙ্কা উড়িয়ে খোলা হাওয়া ঢুকে পড়ে মনের মধ্যে। তখন বুঝতে পারি, এতদিনের লালিত যে ভয়, তা অমূলক ছিল। এই জানলা দিয়ে আসলে মুক্তি আসে। এই জানলা দিয়ে অনেক নতুন ভাবনা আসে।
নাটকের মতো শিল্পকলাতে একজনকে ছাড়া আরেকজন কিছুতেই চলতে পারে না। অপরজনকে পেয়ে আরেকজন এতটাই আহ্লাদিত হয় যে, পরস্পরের মধ্যে এক সংবেদনশীল সম্পর্ক তৈরি হয়, একটা বন্ধন রচিত হয়। এই অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধনটাকে বুঝতে পারা একজন দক্ষ অভিনেতার কাজ।
মঞ্চে যিনি আবহ প্রক্ষেপণ করেন, অর্থাৎ আবহ সংগীত দেন, তিনি হয়তো একটা সুরের মূর্চ্ছনা সৃষ্টি করেছেন বেহালায়, একটা সময় পর তার একটা প্রতীক্ষিত মুহূর্ত থাকে, তিনিও আকুল হয়ে ভাবেন যে, আমি যে জায়গায় সুরটা থামাব, অভিনেতা ঠিক সেই জায়গা থেকে পরের সংলাপটি ধরবেন। যদি তার এক মুহূর্ত এদিক-ওদিক হয়, তিনি কিন্তু ভিতরে ভিতরে আহত হন। হয়তো অভিনেতার মনে হচ্ছে, আরেকটু আগে থেকে সংলাপ শুরু করা দরকার। কিন্তু আবহ সংগীত যিনি দিচ্ছেন, তিনি তা মনে করেন না। তার ইচ্ছা অন্য। সেটা না-হলে মনক্ষুণ্ণ হন।
এই কথাপ্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে হিমাংশু পালের কথা। সিনিয়র আবহ সংগীতকার, নান্দীকারে ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’, যে নাটকে আমি অভিনয় করতাম, সেখানে তিনি আবহ সংগীত দিতেন। নাটকের এক জায়গায়, এক বিশেষ ক্ষণে বাঁশির সুর ভেসে আসত। সেই বাঁশির সুর বেশ চড়া হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি নিজের সংলাপটা বলতাম। আমার প্রথম প্রয়াস দেখেই খুশি হয়েছিলেন হিমাংশুদা। বলছিলেন, ‘আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, যেন সুরটা মিলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যেন সংলাপ ধরা হয়। তুমি ঠিক সেটাই করলে। আমার খুব ভালো লাগল। তুমি এমনটাই বজায় রেখো। চড়া সুর মিলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যখন তুমি সংলাপ ধরছ, মনে হচ্ছে, আমার বাঁশির সুর ঠিক যেন তোমার গলায় বেজে উঠল।’
হিমাংশুদা, নাটকে আবহ সংগীত দেন। তিনি অভিনয় করেন না, সংলাপ বলেন না, দর্শকাসনের কেউ তাকে দেখতে পায় না, আড়ালে থেকেই যাবতীয় কর্ম করেন। এই যে উনি আমার ওপর নির্ভর করে নিজের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, কিংবা বলা যেতে পারে, ওঁর ওপর নির্ভর করে আমি মঞ্চে নিজের প্রকাশ ঘটাচ্ছি, আসলে আমরা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা চেষ্টা করছি, পরস্পরের ভিতরের জানলাকে খুলে দেওয়ার, নিজের প্রয়াসকে মুক্ত করার। এর আবিষ্কারের আনন্দ ভাষায় বোঝানো যাবে না।
মঞ্চে আলোর কথায় আসি। আলোকসজ্জাকে মঞ্চে ফুটিয়ে তোলার জন্য একটা অবজেক্ট বা উপকরণ দরকার। অবজেক্ট না থাকলে আলো-কে দেখা যায় না। তাই মঞ্চসজ্জায় দেওয়াল তোলা হয়। চেয়ার রাখা হয়, যাতে চেয়ারে আলো পড়ে। মঞ্চে একজন অভিনেতার আলো যেমন জরুরি, তেমনই দরকার অবজেক্টকেও। ওই যে চেয়ারের কথা বললাম, সেও চায় তার ওপর অভিনেতা এসে বসুক। বসে সংলাপ বলুক। বসলে ওই চেয়ারের চেহারাটাই বদলে যায়। তখন চেয়ারের প্রকাশ অন্যরকম। এই আনন্দ-বিরক্তি– এই অনুভূতিগুলো অভিনেতার সঙ্গে অবজেক্টের সম্পর্কের রসদ। এই অনুভূতির প্রকাশ অভিনেতা কখনও একার প্রয়াসে করতে পারেন না। তাই তার আলো লাগে, উপকরণের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ভেসে আসা বিমূর্ত সংগীতের। এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে সে প্রকাশ করে তার অসামান্য শিল্পকলা, আমরা তাকেই নাটক বা নাট্যকলা বলি।
‘খেলাঘর’ বলে নাটকটির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে পারছি না। ইবসেনের ‘ডলস হাউস’– ইংরেজি নাটকের বাংলা এই ‘খেলাঘর’। সেই নাটকে আমি অভিনয় করি। সেখানে মঞ্চে পিছনের দেওয়ালগুলো সব কাপড়ের। তিনটি খণ্ডিত ঝুলন্ত কাপড়ের দেওয়াল, উপর থেকে নিচ অবধি সাজানো। নাটকের শেষ দৃশ্যে স্বামীকে ফেলে গৃহিণী যখন নিজের আইডেন্টিটি খুঁজতে ঘর ছেড়ে, এই সংসার ছেড়ে চলে যায়, তখন দেওয়ালগুলো কাঁপতে কাঁপতে নিচে নেমে আসতে থাকে। আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল হয়ে দেখি আমার ঘর, আমার সাজানো সংসার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। দেওয়ালগুলো যখন ভাঙতে থাকে, পড়তে থাকে নিচের দিকে, উপর থেকে নেমে আসার সময় ওই কাপড়ের দেওয়ালের ওপর আলো পড়ে। শুধুই কি আলো পড়ে? বিহ্বলচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা ওই মানুষটির আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, কান্না– তাও কি ঝরে পড়ে না? এই সমস্ত আবেগকে আঁকড়েই কি দেওয়ালটা নিচে নেমে আসে না? ওই মঞ্চের দেওয়ালকে যারা পর্দার আড়াল থেকে নাড়াচ্ছেন, কাঁপাচ্ছেন, তারাও তো একটা বিশেষ আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে দর্শকের মনে, তাদের চেতনায় ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই অনুভূতির মধ্যে অভিনেতা আছেন, আলোর সম্পাত যিনি ঘটাচ্ছেন, তিনি আছেন। আরও অনেকে আছেন।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
এই যে একের সঙ্গে অন্যের মিলেমিশে থাকা, এবং অপর একজনকে ছাড়া নিজেকে প্রকাশের কোনও উপায় নেই, সেই বোধটাই নাটকে সব সময় অনুভব করেছি। অভিনয়ের মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি করে পেয়েছি। এইরকম মুক্তি বা স্বাধীনতা বোধহয় আর কোথায় নেই। তাই যেখানে যখন ‘আমি’ বলে উচ্চারণ করছি, ‘আমরা’ শব্দে তা প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কাছে ফিরে আসছে। ফলে নাটকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, আমাদের শুধু পরস্পর সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকা আছে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২০। খালেদ চৌধুরীর আঁকা ক্যানভাসে প্রাণের আলো জ্বেলেছিলেন তাপস সেন
পর্ব ১৯। তাপস সেন কিংবা খালেদ চৌধুরী নিজের সৃষ্টির জন্য আপস করেননি কোনও দিন
পর্ব ১৮। প্রাণহীন উপকরণের স্পর্শেই প্রাণ পায় আমার অভিনয়
পর্ব ১৭। যে চশমায় নিজেকে মানানসই লাগে না, তবুও যা পরে থাকতে ইচ্ছে করে
পর্ব ১৬। মৃত্যুর পর কী ঘটছে, একমাত্র মঞ্চ অভিনেতার পক্ষেই জানা সম্ভব
পর্ব ১৫। মঞ্চ থেকে প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, এমন নয়
পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করলেন যে, সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক সহযোগ করতে তিনি প্রস্তুত। নেতৃত্বের মোহ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন মহৎ মানুষের অবদান বা তাঁর থেকে দেশের আরও প্রাপ্তি আমরা বিস্মৃত হই না কি?