হিজড়েরা বলে একশো টাকা না দিলে তারা নাচ দেখাবে। পিসি বলেন, ‘দেখা, নাচ দেখা। তোদের নাচ শেষ হলে আমিও নাচব।’ এই কথা শুনে তারা গাল পাড়ে, বলে অভিশাপ দেবে। পিসি এত আঘাত পেয়েছেন জীবনে যে অভিশাপে ভয় পান না। বলেন, দেখি কেমন কাজ করে তোদের অভিশাপ। এইভাবে দু’-তিন ঘণ্টা অচলাবস্থার পর দু’পক্ষই বেশ কাহিল! জল-বাতাসার ব্যবস্থা হয়েছে। হিজড়েরা তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলছে। পিসি আর আমি শুনছি। তখন সরকারি ফর্মে সেক্সের পাশে মেল অথবা ফিমেল।
দিল্লি। হাইওয়ে। পরের সিগন্যালে বাঁদিকে গেলেই সিভিল লাইনস। সেখান থেকে একটু এগোলেই নর্থ ক্যাম্পাস, সপরিবার চলেছি। একটুর জন্য গ্রিন মিস করলেন ট্যাক্সি ড্রাইভার আর সঙ্গে সঙ্গেই একাধিক হিজড়ে পরিবৃত আমাদের বাহন। ড্রাইভার বললেন, কাচ নামাবেন না। তারপর নিজেই কাচ নামিয়ে কয়েকটা বাছাই করা খিস্তি দিলেন, ওজনদার উত্তর ভারতীয় পুরুষালি খিস্তি– ‘…এখানে একটা র্যাকেট চলছে জানেন?’ আমি ততক্ষণে জেন্ডার তত্ত্ব নিয়ে মনে মনে দর্শনের ক্লাসে। ভাবছি হিজড়ের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে আজকাল। কলকাতাতেও বাইপাসের সিগন্যালে, খান্নার মোড়ে বা কসবায় গাড়ি দাঁড়ালেই এই উপদ্রব। হ্যাঁ, ‘উপদ্রব’ শব্দটিই কেউ যেন প্রম্পট করে মাথার মধ্যে, আর তার ফলে শীতকালেও গাড়ির কাচ তুলে দিই। ভাগ্যিস অটোম্যাটিক উইন্ডো। ওরা আসার আগেই তরতরিয়ে জানলা উঠে যায়। কাচে টোকা পড়ে, ‘ও কাকু, কিছু দিয়ে যাও।’ কাকু? আগে তো দাদা বলত! আমি মুখ ঘুরিয়ে নিই, অন্যদিকের জানলাতেও আর একজন। আপদ!
পাল্টি। পর্ব ১৭: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
মুম্বইয়ে যোগেশ্বরী সিগন্যালে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। বাইরে ভ্যাপসা গরম। আমি অফিস প্রদত্ত এসি গাড়িতে আরামে। পাশেই একটি অটো দাঁড়িয়ে। আমার জানলার পাশে অটোর কোণের সিটে একটি ষোলো-সতেরোর ছেলে বসে। এক হিজড়ে, যার মুখের দিকে না তাকালে জেন্ডার মালুম হয় না, শরীরে ঢল নামিয়ে তার কাছে টাকা চাইছে। মুম্বইয়ের ট্র্যাফিক জ্যাম সিনেমা দেখার জন্য দু’হাত খুলে সময় ঢেলে দেয় আমজনতার হাতে। মাথা একটু নিচু করে, যেন মোবাইল দেখছি, আড়চোখে তাকিয়ে থাকি। হিজড়েটি বুঝে গেছে ছেলেটি একটি পয়সাও ঠেকাবে না। অথচ অন্য কোনও গাড়ির জানলায় টোকা না মেরে সে বিলি কেটে দিচ্ছে তার ঝাঁকড়া চুলে। তারপর হেড ম্যাসাজ। ছেলেটির কান লাল হচ্ছে ক্রমশ। প্রথমদিকে প্রতিবাদ করছিল হাত-পা নেড়ে, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে ফ্রি ম্যাসাজ নিতে থাকে সে। পাশে বসা যাত্রী পাথরের মতো মুখ করে সিগন্যালের লাল আলোর দিকে তাকিয়ে আর ড্রাইভারের হাসির দমক দুলিয়ে দিচ্ছে তিনচাকার রথ। যতক্ষণ সিগন্যাল লাল, হেড ম্যাসাজ চলল। তারপর বন্ধ জানলা ভেদ করে ব্যস্ত গাড়ির হর্নের আওয়াজ, অটোর স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। হিজড়েটি ভ্যানিশ করে গেল চোখের পলকে।
পাল্টি। পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
ক্লাস সেভেন বা এইট। গরমের ছুটি। পিসি এসেছেন বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) থেকে। হই-হুল্লোড় চলছে। হঠাৎ একদিন ভরদুপুরে হাততালি দিতে দিতে একদল হিজড়ে এসে হাজির! উঠোন পেরিয়ে অন্দরমহলের দরজার সামনে তারা বসে পড়ল। আমাদের এক আত্মীয়ের সন্তান হয়েছে কাছেই এক হাসপাতালে। সেখানকার খাতায় নাকি দু’টি ঠিকানা দেওয়া ছিল। তার মধ্যে আমাদেরটি হাঁটাপথ, তাই তারা এখানেই হাজির হয়েছে। এবং টাকা নিয়ে তবেই যাবে। বাড়ির সবাই, শুধু পিসি ছাড়া, ভিতরে চলে গেলেন। পিসি একটি মোড়া নিয়ে এসে সামনে বসে পড়লেন, আমাকেও ডাকলেন। আমি একটু ইতস্তত করে তাঁর পাশে বসলাম । এরপর এক অনন্ত নেগোশিয়েশন। হিজড়েরা বলে একশো টাকা না দিলে তারা নাচ দেখাবে। পিসি বলেন, ‘দেখা, নাচ দেখা। তোদের নাচ শেষ হলে আমিও নাচব।’ এই কথা শুনে তারা গাল পাড়ে, বলে অভিশাপ দেবে। পিসি এত আঘাত পেয়েছেন জীবনে যে, অভিশাপে ভয় পান না। বলেন, দেখি কেমন কাজ করে তোদের অভিশাপ। এইভাবে দু’-তিন ঘণ্টা অচলাবস্থার পর দু’পক্ষই বেশ কাহিল! জল-বাতাসার ব্যবস্থা হয়েছে। হিজড়েরা তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলছে। পিসি আর আমি শুনছি। তখন সরকারি ফর্মে সেক্সের পাশে মেল অথবা ফিমেল।
সিভিল লাইন্স ধরে ট্যাক্সি স্পিড বাড়িয়েছে, কিন্তু ড্রাইভার ওই হিজড়েদের গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন– ‘জানেন স্যর, এরা আসলে হিজড়েই নয়। বস্তির বেকার ছেলেগুলো দাড়িগোঁফ কামিয়ে, শাড়ি পরে হিজড়ে সেজেছে টু-পাইস কামানোর জন্য। আর আসল হিজড়েগুলোর বদনাম করছে।’ ‘আসল হিজড়ে’ সোজা মাথায় আঘাত করে। আসল, অর্থাৎ নপুংসক? অর্থাৎ শিখণ্ডী? ছোটবেলায় মহাভারত পড়ার সময় যতবার প্রশ্ন করেছি বড়দের, ওঁরা ‘নপুংসক’ শব্দটি উচ্চারণ করেই খুব দ্রুত ঢুকে পড়েছেন কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসায়। শিখণ্ডীর কথা মনে পড়লেই কিন্তু সম্ভ্রম জেগেছে মনে, চিরকাল। হয়তো তিনি ছাড়া অর্জুনের বীরগাথা সম্পূর্ণ হত না, সে কারণে। অথচ রাস্তার কোনও হিজড়েকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করিনি আজ পর্যন্ত, মনে মনেও না। তাঁরা বোধহয় অপেক্ষায় আছেন আরেকটি কুরুক্ষেত্রের জন্য, দিল্লি, মুম্বই অথবা কলকাতার ট্র্যাফিক সিগন্যালে।