বাউলের জীবনবোধ, ধ্যান ও সহজ সরল যোগদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করব এই যৌথযাপন কী। জীবন ধারণের বিজ্ঞানকে বাউল কীভাবে দেখে? আমাদের প্রাচীন গুরু মহাজনেরা এর সম্পর্কে কী বলে গেছেন? আমরা কীভাবে এই ধারণা, ভাবনা ও ধ্যানকে সময়োপযোগী করে আমাদের জীবনে কার্যকরী করতে পারি।
চিত্র-ঋণ: একতারা কালারি
১.
গৌরচন্দ্রিকা
এই কলামটি যখন লিখতে শুরু করছি, তখন আমি ভারতবর্ষ থেকে অনেক দূরে, দক্ষিণ আফ্রিকায়।
ব্যস্ত দিন আর রাত। তার মধ্যে বসে লেখা সহজ নয়। কিন্তু ‘যৌথযাপন’ বিষয়টি, এবং এ বিষয়ক আলোচনা আজকের সময়ে আবার নতুন করে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তাতে এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে আমারও দু’কলম লিখতে পারাটা একটা সৌভাগ্যের বিষয় বইকি। বিশেষত আজকের জন্য। আজকের সময়ের মানুষের জন্য। যেমন টুনটুনি পাখির ঠোঁটে করে একবিন্দু জল সাগরে দেওয়ার মতো।
এই লেখার শুরুতে আমি আমার গুরুকে স্মরণ করি। যা লেখাবেন, তা যেন একান্তই তাঁর ইচ্ছা হয়। তিনি যেন তাঁর কৃপা আর আত্মজ্ঞানের আলোতে পাঠক পাঠিকা ও লেখিকার হৃদয়কে সমৃদ্ধ করেন।
যৌথযাপন। একসঙ্গে বাঁচার প্রচেষ্টা । যার মধ্যে রয়েছে বেঁচে থাকার মূল কারণ। আমাদের মানবজন্মের সারবস্তু। আমরা এই মানবজীবন পেয়েছি তার একটাই কারণ– সুন্দরভাবে জীবনকে একটা আধ্যাত্মিক ছন্দে এনে, তার সম্পূর্ণ নির্মল আনন্দকে উপোভোগ করা, জীবনকে সুন্দরের আরাধনায় উৎসর্গ করা। আর তা কি আমরা একা করতে পারি?
যুগ যুগান্তর ভারতীয় ঋষিরা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করেছেন–
‘লোকা সমস্তা সুখিনো ভবন্তু।’
এই মন্ত্র, এই প্রার্থনা আমাদের ভারতীয় জীবনদর্শনের মূল কথা। এই বিশ্বচরাচরে যা আছে, যেই আছে, সবাই সুখী হোক, সব কিছু মঙ্গলময় হোক। ঋষিরা বলেননি শুধু নিজের জন্য প্রার্থনা করো, শুধু নিজের পরিবার, নিজের দেশ, নিজের সম্প্রদায়েরই মঙ্গল কামনা করো– যাতে শুধু আমরা ভালো থাকলেই হবে। তাঁরা বলেছেন সমগ্র বিশ্ব সংসারের কথা। এই বিশ্ব সংসার নানা বর্ণ, জাতি, বিশ্বাস, ধর্ম, সমাজ ও দেশের। এই বিশ্ব সংসার শুধু মানুষের নয়, তাতে পশু, পাখি বিভিন্ন প্রাণী, কীট-পতঙ্গ স্থাবর-অস্থাবর সব কিছু রয়েছে। সবাইকে নিয়ে আমাদের সমাজ। সবাই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব। শাক্ত কবিরা লিখেছেন–
‘তুই জগৎ চিন্তাময়ী তারা
আমি কি মা জগৎ ছাড়া?’
এই আধুনিক জীবনে বিশেষ করে শহুরে জীবনে আমরা একসঙ্গে বাঁচার কথাটি প্রায় সবাই ভুলতে বসেছি। সংসার, পারিবারিক জীবন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে গেছে। মানুষ এখন প্রবাসী পাখির মতো জীবনধারণের উপায় করতে স্থান থেকে স্থানান্তরে যাচ্ছে। ১০টা-৫টার ক্রীতদাস। তারপর যতটুকু সময় থাকল মুঠোফোনের ক্রীতদাস। মানুষ কর্মসংস্থান করেছে দু’বেলা দু’মুঠো আহারের জন্য। কিন্তু এখন অযাচিত কর্ম মানুষের জীবনকেই গ্রাস করেছে। খাবার সময় নেই। রান্না করে গরম গরম খাবার সমস্ত পরিবারের সঙ্গে বসে উপভোগ করা এখন বিলাসিতা, বা তার সময় নেই। প্রসেস্ড খাবার প্যাকেট, মুঠোফোনে অর্ডার দেওয়া কমার্শিয়াল খাবার, ফ্রিজে রাখা পুরনো ঠান্ডা খাবার এখনকার জীবনছন্দ। একজনের সঙ্গে অপরজনের আন্তরিক বার্তালাপ, আদানপ্রদান কোথায়; অথচ আমরা মুঠোফোনে ইমোজি দিয়ে অর্ধবিকৃত ভাষায় একটা গোটা বাক্যকে সম্পূর্ণ না করে টেক্সট করতে ব্যস্ত। মানুষকে একাকিত্ব এমনভাবে গ্রাস করেছে যে মরে গেলেও তার মৃতদেহ পাওয়া যায় কিছু দিন বা অনেক দিন পরে, কেউ খবর নেওয়ার নেই।
নিজের সময় বলতে আমরা যা বুঝি খানিকটা সময় একান্তে থাকে আত্মচিন্তায় মগ্ন হওয়া, বা বারান্দায় বসে প্রকৃতি দর্শন। মুঠোফোন তাও গ্রাস করেছে, জগতের সব ভালো খারাপ, যা আমাদের জানা হয়তো চূড়ান্তভাবে অপ্রয়োজনীয়, আমাদের শয্যা প্রান্তে। নিজস্ব বলতে আর কী রইল?
আমাদের মানসিকতা এখন ছোটখাটো সবজিওয়ালা রিকশওয়ালাদের সঙ্গে একটাকা-দু’টাকা নিয়ে বচসা করা, অথচ আমরা স্বেচ্ছায় নিজের ঘরের ধনসম্পত্তি ছদ্মবেশী ডাকাতের হাতে তুলে দিয়ে আসি এবং তাতে গর্ববোধও করি। কোথায় আত্মচিন্তা? জীবনবোধ, চেতনা ও চৈতন্য?
তার ফলাফল নানা রকমের শারীরিক, মানসিক রোগ এসে বাসা বাঁধে। অকালে বার্ধক্য।
সোশালাইজিং করতে আমরা যা বুঝি, তা হল সপ্তাহের শেষে শনি-রবিবার কিছু লোক একত্রিত হয়ে পানভোজন ও অর্থহীন সংলাপ।
কী রইল তবে আমাদের হাতে?
এত ছোটাছুটি পরিশ্রম করে কী পেলাম আমরা?
বাউলের ভাষায়–
‘তোর আপন ঘরে সিঁদ কেটে তুই করলি রে চুরি
দুই দিনের খেলা রে ভাই, করো কিসের জারিজুরি।’
এবারের লেখাগুলোর মাধ্যমে আমরা বাউলের জীবনবোধ, ধ্যান ও সহজ সরল যোগদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করব এই যৌথযাপন কী। জীবন ধারণের বিজ্ঞানকে বাউল কীভাবে দেখে? আমাদের প্রাচীন গুরু মহাজনেরা এর সম্পর্কে কী বলে গেছেন? আমরা কীভাবে এই ধারণা, ভাবনা ও ধ্যানকে সময়োপযোগী করে আমাদের জীবনে কার্যকরী করতে পারি ইত্যাদি।
এই ধারণা ভাবনা ও ধ্যান বলতে কী বোঝাচ্ছে?
কোনও বিষয়কে গভীরভাবে জানতে গেলে এই তিনটি বিষয় ধারণা, ভাবনা আর ধ্যান এই তিনটি পদক্ষেপে এগোতে হবে।
সর্বোপরি ছোট্ট করে বলি ধারণা কী। আমাদের যা কিছু জ্ঞান তা হয় আমরা কোথাও শুনেছি অথবা পড়েছি, এই পূর্ব মহাজনেরা কী বলে গেছেন বা বইয়ের ভাষায় কী বলা হয়েছে– সেটা শোনা বা পড়া, অথবা শিক্ষক বা আচার্যের তত্ত্বাবধানে একবার করে দেখাটাই হল ধারণা। যাতে একটি ভালো ভিত স্থাপন হয়।
একবার শুনে নিয়ে বা পড়ে নিয়ে আমরা তাকে আরও জানতে চাই। তখন আমাদের মন জানা আর না জানার আলোছায়ায় অচিনকে চিনতে চেষ্টা করে। যা আমাদের শোনা ও পড়ার অতীত। তাকে বাউল বলছে ভাবনা।
ধারণা আর ভাবনার হাত ধরে মন যখন একাগ্র হয় তখন থেকে ধ্যানের শুরু হয়। একবার ধ্যান শুরু হয়ে গেলে মন শান্তি ও সেই চিরন্তন সুখ ও ছন্দের সন্ধান পায়। তখন তার অন্য কিছু আর ভালো লাগে না।
‘ভাবিলে ভাবের উদয় হয়
যেমন ভাব, তেমনি লাভ, মূল সে প্রত্যয়।’
আমাদের সমাজে যে রোগ এসে বাসা বেঁধেছে, তা হল নিজের দেশ, ভাষা, শিল্প, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ ও সংস্কারের প্রতি আমাদের আস্থা হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু তার বিকল্পে আমরা নতুন কিছু যা আমাদের প্রাণশক্তির জন্য প্রয়োজন তা আমরা নিজেদেরকে দিয়ে উঠতে পারিনি। অতএব আপন ও আপনার যারা, তাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হতে হতে মানসিক একাকিত্ব ও বিষন্নতায় এসে ঠেকেছি। অসুস্থ সমাজে আমরা নতুন ভাবনা ভাবতে সাহস হারিয়ে ফেলেছি। দুর্বল মন ও দেহ নিয়ে কোনওরকম বেঁচে থাকাকে আমরা কীভাবে আনন্দময় ও দীপ্ত জীবন করে তুলতে পারি?
এই সময়ের ধর্ম হল রাজনীতি। ধর্মের বিপথগামী আর বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন প্রধানেরা যেভাবে তাদের বুজরুকির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করেছে আর মানুষকে চূড়ান্ত কষ্টে ফেলেছে। আজকের রাজনৈতিক নেতারা সেই ভূমিকা নিয়েছেন। আগে যেমন ভাবা হত ধর্মের প্রধানের কথা শুনলে স্বর্গ লাভ হবে, এখন আমরা ভাবি রাজনীতির নেতাদের মাধ্যমে সমাজ বদলাবে আর আমাদের ভালো থাকা না থাকাটা আমরা পুরোপুরিই সঁপে দিয়েছি কিছু মুষ্টিমেয় স্বার্থপর মানুষের হাতে–
‘আমার ঘরের চাবি রইল পরের হাতে রে
কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে…’
কীভাবে বাঁচব?
কীভাবে আমার জীবনের উদ্দেশ্যকে আমি পরিপূর্ণ রূপ দিতে পারব?
সত্যিকারের স্ব-এর তন্ত্রের মাধ্যমে আমি কীভাবে স্বতন্ত্র হয়ে বাঁচব?
এই স্ব-তন্ত্রকে জানতে হলে, আগে ‘স্ব’ অর্থাৎ আমি কে? তাকে আগে জানতে হবে।
এই নিজেকে জানা বা স্বাধ্যায়, আত্ম অধ্যয়ন অথবা নিজের অধ্যয়ন করতে গেলে কিছু কিছু বিষয়ের ওপরে মনোনিবেশ করতে হবে। তা আমি পরের লেখায় আরও বিস্তারিত বলব, যা আমাদের ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমরা আজকের শিক্ষাব্যবস্থা বলতে যা বুঝি তা আমাদের বাস্তবিক কর্ম সংস্থানের জন্য কিছু দক্ষতা নিয়ে আসে। কিন্তু তা আত্ম অধ্যয়ন নয়। আজ আমরা যে শিক্ষায় শিক্ষিত, তা ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতির থেকে অনেক দূরে। এই ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে আত্ম অধ্যয়ন নিয়ে আমরা পরের পর্বে আলোচনা করব।
পরবর্তী পর্বগুলিতে আমরা এই যৌথযাপনের উপায় স্বরূপ বিভিন্ন বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরব।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved