এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, গানের ক্ষেত্রে শুধু বাণীর দিকটায় আগ্রহ ছিল ঋতুদার। ওইজন্য গীতবিতান প্রিয় বই ছিল। আমাদের গানও ভালোবাসার কারণ, অন্যধারার লিরিক। ওই সাহিত্যবোধটুকুই পছন্দের ছিল, সুর মনোগ্রাহী হলে ভালো, না হলেও চলবে। কিন্তু লেখা ভালো হওয়া চাই। ‘ত্বকের যত্ন নিন’ ক্যাসেটে সবচেয়ে মনে ধরেছিল রিকশাওলা, একটা হাটুরে গান, যে শেষমেশ একজন রিকশাকবিকে পেয়ে যায়, এই আকস্মিক বদলটা নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। আমি সবসময়ই আশা করতাম, আমাদের গান নিয়ে এই বুঝি ঋতুদা কিছু লিখবে। সে অবশ্য কখনই ঘটেনি বাস্তবে।
‘তারা’ উঠে যাবে কি না– খুব কৌশলে সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছিলেন সিইও বুদ্ধদেব গুহ। কিন্তু মনে একটা ভয় ঢুকে গেল, ফের চাকরি যাওয়ার! চাকরি গেলে খাবটা কী? যৌবনের যেমন একটা স্পর্ধা আছে, তেমন একটা অনিশ্চয়তাও আছে। বিশেষ করে যদি বাড়ির কিছু দায়িত্ব থাকে। সেই বছরটা একটু বেশি দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। দীর্ঘদিনের প্রেম, সে-ও কেমন নড়বড় করতে করতে ভেঙেচুরে গেল, একগাদা অশান্তির সাঁকো টলমল পায়ে পার হচ্ছি নিত্য। তার মাঝে চলছে রিহার্সাল, শুটিং আর মদ্যপান। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছেই করে না কোনও দিন। সব ঝামেলার মাঝে একটাই বাঁচোয়া– আমাদের তৃতীয় ক্যাসেট ‘ত্বকের যত্ন নিন’ প্রকাশিত হয়েছিল চুপচাপ। রেকর্ডিং-এর সময় ‘আশা অডিও’র সঙ্গে একটা তুচ্ছ কারণে কথা কাটাকাটি হয়। কোম্পানিও নিজের জায়গায় অনড় ছিল, আমরাও। মীমাংসাসূত্র না মেলায় পুজোয় প্রকাশ পায়নি অ্যালবামটা। ‘বেবিদা’ মানে শোভন মুখোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় শেষমেশ বেরয় ‘ত্বকের যত্ন নিন’। কোনও রিলিজ অনুষ্ঠান হয়নি অবশ্যই।
অ্যালবাম বেরনোর কাছাকাছি সময় মিউজিক ওয়ার্ল্ডে সপ্তাহব্যাপী একটা গানের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ‘চন্দ্রবিন্দু’র অনুষ্ঠানে অনেক ছাত্রছাত্রী এসেছিল, আর ‘তারা’-র বন্ধুরা এসেছিল। মেহেলি খুব অবাক হয়েছিল, আমার এত ফ্যান আছে দেখে! মনে হয়, তারপর থেকে একটু সিরিয়াসলি নিয়েছিল আমায়। নতুন ক্যাসেট যথারীতি ঋতুদাকে দিতে গেলাম। ‘গাধা’তে যেমন গানের বুকলেট ছিল, ‘ত্বকের যত্ন নিন’-এ তেমনটা না পেয়ে খুবই বিরক্ত হল ঋতুদা। অনেক মানুষ আছে, লিরিকটা পড়তে চায়। আর তোদের উচ্চারণ ভাল না তো– “ব-এ শূন্য ‘র’কে ড-এ শূন্য ‘ড়’ বলিস, কী করে বুঝবে মানুষ গানের কথা।” লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার। গান গুনগুন করে গাইত, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের লিরিক সজোরে গড়গড় করে বলত।
ঋইউনিয়ন। পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্যই লাগত। এত গানের লিরিক জানে ঋতুদা! এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, গানের ক্ষেত্রে শুধু বাণীর দিকটায় আগ্রহ ছিল ঋতুদার। ওই জন্য গীতবিতান প্রিয় বই ছিল। আমাদের গানও ভালোবাসার কারণ, অন্যধারার লিরিক। ওই সাহিত্যবোধটুকুই পছন্দের ছিল, সুর মনোগ্রাহী হলে ভালো, না হলেও চলবে। কিন্তু লেখা ভালো হওয়া চাই। ‘ত্বকের যত্ন নিন’ ক্যাসেটে সবচেয়ে মনে ধরেছিল রিকশাওলা, একটা হাটুরে গান, যে শেষমেশ একজন রিকশাকবিকে পেয়ে যায়, এই আকস্মিক বদলটা নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। আমি সবসময়ই আশা করতাম, আমাদের গান নিয়ে এই বুঝি ঋতুদা কিছু লিখবে। সে অবশ্য কখনই ঘটেনি বাস্তবে।
‘তারা’ যখন পুরোদমে চলছে, ঋতুদা কিন্তু ‘আনন্দলোক’ ছাড়েনি, ফলে সে অফিসেরও কিছু ব্যস্ততা ছিল। ‘তারা’ জয়েন করার আগে যত আড্ডা হত, যত পরিকল্পনা, কাজ শুরু হওয়ার পর দেখলাম, তত নিস্তরঙ্গ আড্ডা আর বসছে না মোটে। কখনও কখনও ঋতুদার বাড়ি না বলেই চলে এসেছি। নানারকম সমস্যা সমাধানে দেখছি ওর ভূমিকা। নির্মল নামে প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল একজন। মূলত তার সঙ্গেই সমস্যা। সে ছিল ‘তারা’র প্রোডাকশন হেড। যতরকম হিসেবনিকেশ সব তার হাতে। এমনকী, আমার ‘তারাদের কথা’ বা ‘অচেনা উত্তম’ও তারই সামলানো। সেই নির্মল শুটিংয়ের যে খরচ জমা দিত ‘তারা’র অফিসে, সেসব একদানে পাস হত না। ফলে সকাল থেকে নির্মল বাধ্য হনুমানের মতো ধরনা দিয়ে বসে থাকত তাসের ঘর-এ। ঋতুদা একবার সুমন্ত্রদা, একবার বুদ্ধদেব গুহ– এই করত। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বলত, ‘তুই এখন যা।’ নির্মল নারাজ মুখে বাইরে যেতেই আমার দিকে ফিরে বলত, ‘এসব আর পারা যায়, বল!’ আমি ক্লিষ্ট হাসতাম।
‘তুই ঠিক আছিস?’ আমি মাথা নাড়তাম। ঋতুদা বুঝে যেত আমি ঠিক নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত কোনও কিছু নিয়েই ঋতুদা জিজ্ঞেস করত না কিছু। এ এক বড় গুণ ছিল। শিঙারা, মুড়িমাখা দিয়ে বাকি সন্ধেটা গল্প করে কাটত। ফেরার সময় ঋতুদার গাড়ি বহুদিন রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন পৌঁছে দিত।
ঋইউনিয়ন। পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
‘তারা’র অফিস ছড়িয়েছিল দুটো বাড়ি জুড়ে। একদিন নোটিশ পড়ল, আমাদের বসার জায়গা বদল হবে, কারণ একটি বাড়ি আর অফিস নয় আমাদের। ‘দেব ফিচার্স’-এর বহু যন্ত্র ফেরত চলে গেল। ওয়াকিটকি করে প্রোডাকশন কন্ট্রোলারের হাঁটাচলাও বদলে যেতে লাগল। এবং সেই প্রথম মাস শেষে কারও স্যালারি অ্যাকাউন্টে জমা পড়ল না। আমাদের সকলের অত্যাধুনিক এটিএম কার্ড বারবার মেশিনে ঢুকিয়ে স্টেটমেন্ট বের করেও গোটা মাসে মাইনে এল না। আশপাশে কান পেতে যা শুনলাম, ফাইনান্সিয়াল ক্রাঞ্চ, আবার নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। অফিসে মিটিং ডাকলেন কোম্পানির মালিক স্বয়ং। সেই প্রথমবার রতিকান্ত বসুর মুখোমুখি হওয়া। সবাইকে বললেন, কিছুটা ধৈর্য ধরতে, ‘তারা’ নিজের পথে ফিরে আসবে। ভয় লাগছে, অস্থির লাগছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মাত্র এই কয়েক মাসে একটা এত বড় চ্যানেলের এই হাল হল কী করে!
ছুটলাম আনোয়ার শাহ রোড। ঋতুদা ঘরে নেই। ওপরে কোনও কাজে ব্যস্ত। একরাশ দুশ্চিন্তার আলো-ছায়ায় ঋতুদা ঘরে ঢুকল মুখ কালো করে। “একটা কথা সত্যি করে বলো তো, ‘তারা’ কি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?”
ঋতুদা মাথা নিচু করে বসে। জানে, কেন আমি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করছি। এক পেশা থেকে অন্য পেশা বদল ওরই জন্য। ঋতুদার নিচু গলায় বলল, “চিন্তা করিস না, ‘তারা’ বন্ধ হবে না।” একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ওঠার আগেই ফের ঋতুদার গলা শুনলাম। “তবে আমি হয়তো ছেড়ে দেব ‘তারা’”।
(চলবে)
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved