Robbar

‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ আর পালিত হবে না, পালিত হবে বড়দিন– চোখের সামনে বদলে যাচ্ছিল সোভিয়েত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 6, 2025 6:56 pm
  • Updated:January 6, 2025 6:56 pm  

দীর্ঘ ৭৪ বছর পর এবার হয়তো আর ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ পালিত হবে না সোভিয়েতে। ৭ নভেম্বরের ওই বিশেষ দিনটিতে ক্রেমলিনের রেড স্কোয়ারে আর দেখা যাবে না রেড স্কোয়ার ছাপিয়ে যাওয়া শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সুবিশাল সমাবেশ, অবিরত জনস্রোত। আগে যা হয়নি কখনও, সেই বড়দিন, অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হল সরকারি ছুটির দিন হিসেবে। এতদিন সোভিয়েতে জাতীয় উৎসব ছিল সাকুল‌্যে তিনটি– ৭ নভেম্বরে ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’, ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও ৯ মে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন। কোনও নেতার জন্মদিনই ছিল না ছুটির তালিকায়। লেনিনের জন্মদিন ২২ এপ্রিলও নয়। তবে ওই জন্মদিনের ঠিক আগের শনিবারটি পালিত হত ‘শ্রমদান দিবস’ হিসেবে। এ বছর তাও হয়নি।

অরুণ সোম

৪৫.

বাতিলের মুখে সোভিয়েত ব‌্যবস্থা

মস্কোর ‘গোর্কি স্ট্রিট’-এর নাম বদলে ‘ত্‌ভের্‌স্কারা স্ট্রিট’-এ ফিরিয়ে আনায় আমার পাড়া-প্রতিবেশী অনেকেই বলেছিলেন আপদ গেল! যখন লাল পতাকার বদলে জারের পতাকা নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে রোমাঞ্চ জাগছে, তখন সত‌্যিই এ আর এমনকী গুরুতর বিস্মরণ? তা বলে বল্‌শয় ব‌্যালেকে ২০ বছরের জন‌্য মস্কো থেকে নির্বাসন! হ‌্যাঁ, এও সম্ভব হয়েছে। মস্কোয় এলে এখনও এমন বহু কিছু পাবেন, যা আগে শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক, মায়ামি বা টেক্সাসে পাওয়া যেত। কিন্তু সোয়ান লোক বা মুনলাইট সোনাটা দেখতে পাবেন না। দেখতে গেলে যেতে হবে ইতালি। ২০ বছরের জন‌্য চুক্তি করে গোটা ট্রুপটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রোমে। ঘোর ডামাডোলে অতিষ্ঠ, ভালো নাচিয়ে-গাইয়েরাও পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিমে। কেনই-বা পাড়ি জমাবে না? মস্কো শহরে এখন চিনি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। যা হচ্ছে স্বাস্থ‌্যের পক্ষে ভালোই হচ্ছে– এ ধরনের কিছু ভাবতে ভাবতে চা গলাধঃকরণ করে নিচ্ছি। মস্কো যেন সেই ১৯৭৪-’৭৫ সালের কলকাতা, যখন চিনির বদলে রেশনে ডিউস্লিপ দেওয়া হত!

যতই কাকতলীয় হোক, মস্কোতেও চিনি আর ভোদ্‌কার জন‌্য স্লিপ দেওয়া চালু আছে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিষয় একটাই– ডিপার্টমেন্টাল সেন্টার রক্ষকের এধার-ওধার দোদুল‌্যমান মাথা দেখে ফিরে আসা। অনেকে ভাবতে শুরু করেছে, কী সুখে আর মস্কোয় থাকা? বাসমতী চাল মিলত ৮৮ কোপেকে, আজ কিনলাম ৯৩ রুবলেআটা, সূর্যমুখী তেল মুখ লুকিয়েছেঅবশ‌্য আমাদের কাছে আবার্ত এলাকায় বাজার করতে গিয়ে আমার স্ত্রী-র যখন দাম দেখে ভেঙে পড়ার অবস্থা, পাশের বিয়ার বারে তখন মারাত্মক ভিড়। মস্কোর মদ‌্যপায়ীরা যখন সাধারণ মানের ১১ রুবলের রুস্‌স্কাইয়া ভোদ্‌কা পাচ্ছেন না, টয়োটা গাড়ি করে ডাচ বিয়ারের ক্রেট তুলে নিয়ে যাচ্ছেন ভাগ‌্যবানরা। প্রতিটি বোতল ১৫ রুবল। গত ৫৬ বছর ব‌্যক্তিগত ব‌্যবসার কল‌্যাণে এমনতর ভাগ‌্যবানের সংখ‌্যা এখন কম নয়। খরচখরচা করার সুযোগও বেড়েছে। আগে মস্কোয় ক’টা টয়োটা গাড়ি দেখা যেত? এখন অসংখ‌্য। বিভিন্ন শহরে বিলাসবহুল বাংলো বাড়ি ‘দাচা’ কিনে রাখা যায়। কয়েক বছর আগে এঁরা অসুখে ভুগতেন এই ভেবে যে, সবাই যা পায় আমাকেও তাই নিতে হয়। এমন সুখ– সবাই যা পায় না, আমি তাই পাই।

তবে সাম্প্রতিক পরিবর্তনে শুধুমাত্র এঁরাই খুশি– একথা বলা ঠিক হবে না। সাধারণ মানুষেরও একটা বড় অংশ কমিউনিস্ট খোঁজার কাজে হাত লাগিয়েছেন। বাংলা শিখতে যে-ছেলেটি আমার বাড়ি আসে, সেই ঝাঁকড়া চুলের বেশি পাওয়ারের চশমা পরা বেহিসেব সের্গেই পর্যন্ত মনে করে, একটু দেরি করে ফেললেও টয়োটা গাড়ির স্বপ্নময় জীবন এখনও নিভে যায়নি। তবে আমার বাড়ির আলো নিভে গেল বলে। পড়ার ঘরের বাল্‌বটা কাঁপছে। এখনই যাবে। এখানে বাল্‌বের মান এতই খারাপ যে ডিমের মতো ডজন হিসেবে কিনে রাখতে হয়। এটি আমার দ্বাদশতম! কয়েক দিন হল ‘লোডশেডিং’ হচ্ছে না কিন্তু বাল্‌ব ছাড়া বৈদ‌্যুতিক শক্তিকে ভাস্বর করে তোলার উপায়-বা কী? এখন আবার বাল্‌বও পাওয়া যাচ্ছে না। কেরোসিন বা মোমবাতির চল নেই। এখন করি কী?

লেনিন স্মৃতি সৌধ

১৮ সেপ্টেম্বর। মস্কোর কেন্দ্রস্থলে লেনিন মিউজিয়ামকে ঘিরে জটলা চলছেই। এটা যেন একটা স্থায়ী বিতর্ক সভার চেহারা নিয়েছে। স্মৃতিসৌধের শবাধারে শায়িত লেনিনকে দেখতে প্রচণ্ড ভিড়। এত ভিড় গত বসন্তেও দেখিনি। এত মানুষ দেখতে আসছে, কিন্তু তাঁকে এখানে রাখা হবে, না পেতের্বুর্গে তাঁর মায়ের পাশে সমাধিস্থ করা হবে– তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। অসংখ‌্য মানুষ সারাদিন পিকেট করে বসে আছেন, যাতে রাতের আঁধারে লেনিন শবাধার স্থানান্তরিত হয়ে না যায়, পিকেট করে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন ‘লেনিনবাদী কমিউনিস্ট’ হিসেবে। সরকারি হুকুমনামায় নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন কিছু এঁরা বলছেন না। প্রকাশ‌্য কট্টর স্তালিনবাদী আন্দ্রেইভাও এঁদের সঙ্গে নেই। তবে কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়ন, বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ প্রকাশ‌্যেই ‘লেনিনবাদী কমিউনিস্ট’দের সঙ্গে আছেন। এঁরা অধিকাংশই প্রবীণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পিতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। বলছেন, লেনিন স্মৃতিরক্ষায় দরকার হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।

A parade on Red Square in 1970. Soviet leaders can be seen lined up along the viewing platform of the mausoleum. The mausoleum served as the symbolic core of Soviet power, and as such has been the target of scores of attacks, including a suicide bombing in 1973 that killed the bomber and a couple entering the mausoleum behind him. Lenin’s body was reportedly unharmed by the blast.  
১৯৭০ সালে রোড স্কোয়ারের প্যারেড

ইতিমধ‌্যে গড়েছেন একটি জাতীয় কমিটি, তহবিল ইত‌্যাদি। পিকেটের স্থলে এঁদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ব‌্যর্থ হলাম, কারণ পুলিশ ঘিরে রয়েছে। এবার লেনিন স্মৃতিসৌধে এত ভিড় হচ্ছে তার একটা কারণ সম্ভবত আশঙ্কা। কারণ, পেতের্বুর্গের মেয়র সব্‌চাক ঘোষণা করেছেন, লেলিনের শবদেহ তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর মায়ের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করতে হবে সম্পূর্ণ ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে। এতেই নাকি লেনিনের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হবেকিন্তু এই শেষ ইচ্ছার উইল কার কাছে আছে বা আদৌ তেমন শেষ ইচ্ছা ছিল কি না– তা জানা যাচ্ছে না। অন‌্যদিকে, মস্কোর মেয়র ‘ডি ডে’ দিয়েছেন ১ অক্টোবর। তাঁর দাবি ওই দিনের আগে স্মৃতিসৌধের জায়গা-জমি মস্কোর পুরসংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে। তবে লেনিনের গায়ে হাত তোলার আগে সম্ভবত মার্কস-এঙ্গেলসের গায়ে হাত উঠে যাবে। এঁদের স্মৃতিগুলোর গায়ে অশ্লীল গালিগালাজও লেখা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা এটা পছন্দ করছেন না। কিন্তু কিছু ‘সাধারণ মানুষ’ সোৎসাহে এসব চালিয়ে যাচ্ছেন। উৎসাহের মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে এখনও বেশ কিছুদিন তা চলবে। 

মস্কো। রেড স্কোয়ার

২৩ অক্টোবর, ১৯৯১– আগস্টের ব‌্যর্থ কমিউনিস্ট অভ‌্যুত্থানের সময় যে তিনজন গণতন্ত্রী রেড স্কোয়ারে ট‌্যাঙ্কের তলায় চাপা পড়ে নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ‌্যে ১ নভেম্বর দিনটিকে গোটা সোভিয়েতে ‘শোকদিবস’ হিসেবে পালন করার দাবি জানিয়েছে রুশ ডেমোক্রেটিক ও রুশ ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাটিক পার্টি। ওইদিন নিহত ব‌্যক্তিদের উদ্দেশে তর্পণ করা হবে লুবিয়ান্‌কা স্কোয়ারে (এই সেদিনও যার নাম ছিল দ্‌জের্‌জিন্‌স্কি স্কোয়ার) যেখানে কেজিবি-র সদর দপ্তর অবস্থান করছে। বেরবে একটি শোভাযাত্রাও। বলশেভিক বিপ্লবের আগে মস্কোর যে-জায়গায় ছিল একটি প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন চার্চ, শোভাযাত্রাকারীরা সেখানে মিলিত হবেন একটি প্রার্থনাসভায়। রুশ ডেমোক্রেটিক ও রুশ ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির আরও একটি দাবি: ১ নভেম্বরেই সমাধিস্থ করা হোক লেনিনকে। বলা বাহুল‌্য, কাজটি করতে চাওয়া হয়েছে প্রতীকীভাবে। লেনিনের দেহ নয়, তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তিকেই সমাহিত করা হবে ১ নভেম্বর। দাবিগুলি জানানো হয়েছে রুশ প্রজাতন্ত্র ও সোভিয়েত সরকারের কাছে। সম্মতি মেলেনি এখনও। তবে দাবিগুলি মেনে নেওয়া হবে বলেই সকলের ধারণারুশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েল্‌ৎসিনের এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীও তাই মনে করছেন।

এদিকে ৭ নভেম্বর রেড স্কোয়ারে এবার ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ উপলক্ষ‌ে কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে না সরকারিভাবে। তবে ওইদিন রেড স্কোয়ারে ও তার আশপাশের এলাকায় গোলমালের আশঙ্কা করছেন রুশ প্রশাসনের একাংশ। ওদিকে মস্কোর মেয়রের নির্দেশমতো ১ অক্টোবরেই রেড স্কোয়ার এলাকা থেকে লেনিন মিউজিয়ামটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সম্ভব হয়নি। হবে কী করে? তিন-চার দিন আগে থেকেই মিউজিয়ামের সামনে সমবেত স্বেচ্ছাসেবী প্রহরীর হাতে হাতে ঘুরছিল নানা ফেস্টুন। সাদা রঙের সেইসব ফেস্টুনের কোনওটিতে লাল অক্ষরে লেখা ‘লেনিন আমরা তোমাকে ভুলিনি’, কোনওটিতে ‘আমরা আবার ফিরে আসব’, কোনওটিতে আবার মায়াকোভ্‌স্কির কবিতা থেকে তুলে দেওয়া উদ্ধৃতি ‘লেনিন ছিলেন, আছেন, লেনিন থাকবেন।’ ফেস্টুনের ছবি ছাপিয়ে তার খবর করেছিল এখানকার কাগজগুলো। জুড়ে দিয়েছিল মন্তব‌্য: ‘ওরা এখনও সশস্ত্র নয়, তবে একদিন ওরাও…।’ সশস্ত্র হাঙ্গামার ভয়ে ওই মিউজিয়ামটিকে ঘিরে এখনও রয়েছে চাপা উত্তেজনা। রয়েছেন ফেস্টুনধারী স্বেচ্ছাসেবী প্রহরীরা। আর হ‌্যাঁ, ১ অক্টোবরের পরেও ওখানে রয়েছে মিউজিয়ামটি। স্বেচ্ছাসেবী প্রহরীদের সঙ্গে কথা বলে একদিন গিয়েছিলাম সেখানে। গত সপ্তাহে। ভাব জমালাম এক প্রহরীর সঙ্গে। প্রশ্ন করলাম, দৈনিক কত জন এখানকার স্বেচ্ছাসেবী প্রহরী দলে নাম লেখান, বিনা পারিশ্রমিকে কতজন এখানে রাতভর পাহারা দেন মিউজিয়ামটি, প্রহরী হতে যাঁরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন, সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ তাঁরা? এখনও সোভিয়েতে এ-ব‌্যাপারে কারও আগ্রহ আছে দেখে মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার প্রহরীবন্ধুটির। সবে উনি আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে যাবেন, এমন সময়ে কোত্থেকে যেন উড়ে এসে আমাদের ঘিরে ফেলেই অশ্রাব‌্য গালাগালি দিতে লাগল। রেহাই পেলেন না লেনিনও। তাঁকে দেওয়া হল ‘খুনে’ উপাধি। হইহই করে এগিয়ে এলেন অন‌্যান‌্য প্রহরীরা। শুরু হয়ে গেল কথা কাটাকাটি, স্লোগান, পালটা স্লোগান। হট্টগোলের মধ‌্যেই স্বেচ্ছাসেবী দলের এক বৃদ্ধা নিঃশব্দে বিলি করে যাচ্ছিলেন লিফলেট। দুঃস্বপ্নের রাতগুলোতে লেনিন কীভাবে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন দেশবাসীকে সেই ইতিহাস লেখা ছিল লিফলেটগুলোতে। ‘গণতন্ত্রপ্রেমী’ যুবক-যুবতীরা ওই বৃদ্ধার হাত থেকে লিফলেটগুলো কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল। চোখের সামনে যেন সেদিন দেখতে পেলাম ‘গোর্কির মা’ উপন‌্যাসের পেলেগেইয়া নিলভ্‌না চরিত্রটিকে। মানতেই হচ্ছে, ওই বৃদ্ধার চেয়ে আমার শিরদাঁড়ার জোর অনেক কম। তাই গন্ডগোল দেখে পিঠ বাঁচাতে পালিয়ে এলাম আমি। ১২ অক্টোবর ওই মিউজিয়ামের সামনেই হল কমিউনিস্টদের একটি সভা। প্রায় হাজার দুই মানুষের জমায়েত হয়েছিল সেখানে।

Demonstrators in Moscow carry a portrait of Soviet state founder Vladimir Lenin. Photo by Sergei Karpukhin/Reuters
২০১৭। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১০০ বছর পূর্তিতে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব দিবস পালিত হচ্ছে মস্কোর রাস্তায়

৯ অক্টোবর। দীর্ঘ ৭৪ বছর পর এবার হয়তো আর ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ পালিত হবে না সোভিয়েতে। ৭ নভেম্বরের ওই বিশেষ দিনটিতে ক্রেমলিনের রেড স্কোয়ারে আর দেখা যাবে না রেড স্কোয়ার ছাপিয়ে যাওয়া শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সুবিশাল সমাবেশ, অবিরত জনস্রোত। এমনকী, গত বছরের মতো শ্রমিক সংগঠন, কমিউনিস্ট পার্টি ও নাগরিক কমিটিগুলোর ডাকে রেড স্কোয়ার থেকে বেরবে না চোখ চেয়ে দেখার মতো সুদীর্ঘ গণমিছিল। তবে আগে যা হয়নি কখনও, সেই বড়দিন, অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হল সরকারি ছুটির দিন হিসেবে। এতদিন সোভিয়েতে জাতীয় উৎসব ছিল সাকুল‌্যে তিনটি– ৭ নভেম্বরে ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’, ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও ৯ মে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন। কোনও নেতার জন্মদিনই ছিল না ছুটির তালিকায়। লেনিনের জন্মদিন ২২ এপ্রিলও নয়। তবে ওই জন্মদিনের ঠিক আগের শনিবারটি পালিত হত ‘শ্রমদান দিবস’ হিসেবেএ বছর তাও হয়নি। ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ জাতীয় উৎসবের তালিকা থেকে বাদ পড়ল। মনে হচ্ছে এবার বাতিল হবে ৯ মে-র ‘বিজয় দিবস’ও। জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হবে ১ মে। তবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ওই দিনটি পালিত হবে ‘বসন্ত উৎসব’ হিসেবে।

রুশ প্রজাতন্ত্রের গণপ্রতিনিধিদের সম্মেলন বসছে ২৮ অক্টোবর। ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ পালন করা হবে কি না– সে ব‌্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বৈঠকেই। কী কারণে জাতীয় উৎসবের তালিকা থেকে এবার বাদ পড়তে চলেছে ৭ নভেম্বরের ওই বিশেষ দিনটি? বিদ্বেষ, অপরিসীম ঘৃণা। দেখছি এখানকার সাধারণ মানুষ এখন দারুণভাবে ঘৃণা করেন ওই দিনটিকে। মনে করেন, ওই দিনটিই তাঁদের সুখ ও সমৃদ্ধির লক্ষ‌্যে পৌঁছনোর মূল অন্তরায়। জাতীয় উৎসবের তালিকা থেকে বাদ দিলে ওই দিনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা আর বার্তা পাঠাবেন না। না, ওই দিনে বিদেশের শুভেচ্ছা নিতেও রাজি নন সোভিয়েত নাগরিকরা। উদ্‌যাপন করবে না সদ‌্য স্বাধীন তিন বাল্টিক দেশ– লিথুয়ানিয়া, লাত্‌ভিয়া ও এস্তোনিয়াও। তাদের নিজস্ব জাতীয় উৎসব আছে। উক্রাইনা, মোল্‌দাভিয়া, জর্জিয়া? তাদেরও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। ৭ নভেম্বরের উৎসবটি গত বছরেই ছোট করা হয়েছিল। বাদ দেওয়া হয়েছিল রেড স্কোয়ারে সামরিক কুচকাওয়াজ। তবে কমিউনিস্ট পার্টির উদ‌্যোগে বেরিয়েছিল সুবিশাল একটি গণমিছিল। রেড স্কোয়ারে উপস্থিত ছিলেন গর্বাচ‌্যোভ্‌। কিন্তু গত বছর ওই মিছিল থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সম্পাদক গর্বাচ‌্যোভের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল। বেগতিক দেখে বন্ধ করতে হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানের দূরদর্শন সম্প্রচার। বিক্ষোভ এড়াতে মাঝপথেই রেড স্কোয়ার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গর্বাচ‌্যোভ্‌।

…………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………….

এবার রুশিদের দাবি সোভিয়েত ইউনিয়নকে অক্ষুণ্ণ, অটুট রাখার উদ্দেশ‌্য ১৯৯১ সালের ১৯ থেকে ২১ আগস্ট কমিউনিস্টদের যে-অভ‌্যুত্থান ঘটেছিল, সেই উপলক্ষ‌ে ২১ আগস্ট ‘অভ‌্যুত্থান’ ব‌্যর্থ হওয়ার দিনটিকেই পালন করা হোক ‘জাতীয় উৎসব’ হিসেবে। কেউ কেউ বলছেন সাত দশকের যে-ব‌্যবস্থার ফলে দেশবাসীর আজ ‘দুর্বিষহ অবস্থা’, তার স্মৃতিতে নির্মাণ করা হোক ঈশ্বর উপাসনার একটি সৌধ, প‌্যারিসে ‘প‌্যারি কমিউন’-এর পতনের পর যেন গড়ে তোলা হয়েছিল সাক্রে ক‌্যুরে ক‌্যাথেড্রাল। আপাতত ওইরকম কোনও সৌধ না গড়া হোক, ডিসেম্বরে গোটা সোভিয়েতে হইহই করে পালিত হবে খ্রিস্টের জন্মোৎসব। ২৫ ডিসেম্বর (রুশ দেশের গির্জার ক‌্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি) থাকবে সরকারি ছুটি।

…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ৪৪। রাজনীতিতে অদূরদর্শিতার ফল যে কত সুদূরপ্রসারী, তার প্রমাণ আফগানিস্তান

পর্ব ৪৩। জানলা দিয়ে পূর্ব জার্মানি দেখতে দেখতে গর্বাচ্যোভ বলেছিলেন, তাহলে এখানেই শেষ!

পর্ব ৪২। পেরেস্ত্রৈকা শুরু হলে বুঝেছিলাম ‘প্রগতি’ ‘রাদুগা’– এসব কিছুই থাকবে না

পর্ব ৪১। কল্পনা যোশীর তুলনায় ইলা মিত্রকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছে

পর্ব ৪০। বেসরকারিকরণের শুরু দিকে রাস্তাঘাটে ছিনতাই বেড়ে গেছিল, কারণ সব লেনদেন নগদে হত

পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা

পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়

পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা

পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’

পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ

পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল

পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে

পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন

পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য

পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো

পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা

পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা

পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী

পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস

পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না

পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ

পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে

পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত

পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত

পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন

পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী

পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর

পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে

পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!

পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ

পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়

পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক

পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?

পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?

পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা

পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন

পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি

পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত

পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে

পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না

পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ

পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল

পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না

পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি