
তথ্য আর অভিজ্ঞতার মাঝখানে একরকম হাঁ-মুখ থাকে– তা দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় শিল্প। দস্তয়েভস্কির কারামাজভ পরিবারের যেসব ফাটল, তা দিয়ে আবির্ভূত হয় সন্দর্ভ। দালির আঙুল পটকে উন্মুক্ত করে, পরিপ্রেক্ষিতের মাঝে মাঝে লেখা মুক্ত হয়ে গেলে সেই সার্বভৌম বিস্তারের থেকে ছত্রীসেনার মতো নেমে আসে অন্য কারও সম্ভাব্য চিত্রমালা। ককতোর ছবির চিত্রনাট্যে চির ধরে গেলে সেইপথ দিয়েই প্রবেশ করে কাব্য। এমন নয় যে আমাদের এসব জানা নেই। সংবাদসূত্রে একজন কবি জেনেছিলেন– এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে। জ্ঞাপনের এই প্রক্রিয়া পরিশোধিত হয়ে আমাদের জানায়, জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কি না।
৭.
সরোজিনী হত্যারহস্যের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন এবার পেশ করার সময় এসেছে।
আমাদের কোনও সংকেতবাক্য ছিল না, অথবা কোনও অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। তবু আমরা দেখেছি শূন্য চাকুরির মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে আছে আততায়ী।
তথ্য আর অভিজ্ঞতার মাঝখানে একরকম হাঁ-মুখ থাকে– তা দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় শিল্প। দস্তয়েভস্কির কারামাজভ পরিবারের যেসব ফাটল, তা দিয়ে আবির্ভূত হয় সন্দর্ভ। দালির আঙুল পটকে উন্মুক্ত করে, পরিপ্রেক্ষিতের মাঝে মাঝে লেখা মুক্ত হয়ে গেলে সেই সার্বভৌম বিস্তারের থেকে ছত্রীসেনার মতো নেমে আসে অন্য কারও সম্ভাব্য চিত্রমালা। ককতোর ছবির চিত্রনাট্যে চির ধরে গেলে সেইপথ দিয়েই প্রবেশ করে কাব্য। এমন নয় যে আমাদের এসব জানা নেই। সংবাদসূত্রে একজন কবি জেনেছিলেন– এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে। জ্ঞাপনের এই প্রক্রিয়া পরিশোধিত হয়ে আমাদের জানায়, জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কি না।

সমস্যা এই যে আমরা সত্যের গতিপ্রবাহকে ধরতে পারিনি। আমাদের খুব দোষ নেই। অধ্যাপক-অধ্যুষিত সমালোচনা সাহিত্য একটি সুগোল দেশ-কাল প্রতিমার মায়া ছড়ায়। সুতরাং আমাদের অভ্যাস হয়ে গেল দৃশ্যের প্রত্যক্ষ অবয়ব অথবা ধ্বনির মূর্ত প্রতিমা। অথচ চলতি নাটকের আদি পর্বে যখন জনৈকা নগ্নিকা সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে থাকে, তার পাশ দিয়েই বাস্তবতা উঁচুতে উঠতে শুরু করে। সরোজিনী চলে গেল অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া পাখিদের মতো পাখা বিনা? অবশ্য পূর্বোক্ত কবিপুরুষ এই প্রশ্নটিও করলে যাঁরা সামান্য অর্থসন্ধানী তাঁরা ব্যাখ্যার অবসরে অব্যাহতি পেতে চেয়েছিলেন। আসলে কিন্তু সন্দেহভাজন ওই নারীরা অতীত ও বর্তমান অবিচ্ছিন্ন নয়, রয়ে গিয়েছে শূন্যতার একটি অবতল যা প্রস্তাব ও তার সমালোচনার অন্তর্বর্তী স্তর যা কবিতার বিহারভূমি।
শতাব্দী জুড়ে থাকা এই ময়নাতদন্তের ধারাবাহিক প্রকাশ প্রমাণ করে যে, কথকতার দায় আর কবির নয়। বরং কবিতা সৌন্দর্যপ্রথার যে মাংসল প্রবর্তন সম্ভব করেছে, তাতে কবির প্রতি শর্তহীন আনুগত্য ছুড়ে ফেলে বহুগামিনী সরোজিনী ক্রমেই দাবি করেছে পাঠকের রতিমুখরতা। আমরা প্রতিবেদনের এই স্তরে রল্যাঁ বার্থ থেকে মিশেল ফুকো পর্যন্ত অনেকের সাক্ষ্যই অন্তর্ভুক্ত করেছি।

আমরা নথিভুক্ত করতে পেরেছি যে, এই সময়সীমায় কোনও স্মরণীয় কবি এমন কোনও পঙক্তি রচনা করেননি, যা নিজেই নিজের প্রতি সন্দিহান নয়। অথচ কবিতার বয়ান ও সেই বিষয়ে প্রশ্নসমূহ আলাদা থাকেনি। একইসঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। সংযোজনের এই তত্ত্ব সবসময়ে বয়ানের পরিধিতেও থমকে থাকেনি, বয়ানাতিরিক্ত ভাবেও উন্মোচিত হয়েছে। তাঁর প্রণয়ী যা সরোজিনীকে দেখায় এত সীমাহীন আগ্রহ দেখিয়েছে: যুগপৎ স্তন ও নিতম্বের সহ-উপস্থিতি, শ্রোণীযুগ, গোড়ালি ও গ্রিবার কোলাজ এই অতিব্যবহৃতা স্ত্রীলোকটিকেও সমন্বিত লেখা ও বহুবাচনিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে নক্ষত্রবীথি কিংবা দিওতিমার সমীপবর্তী করে।
অথচ ঘাতক নিজেও নিশ্চিত ছিল না যে সে সরোজিনীর জরায়ু পর্যন্ত অনুগমন করেছে। নজির হিসেবে আমরা সংরক্ষিত করেছি তার আত্মঘাতী কণ্ঠস্বরের একটি অনুলিপি– বাস্তবিকই জল কি জলের নিকটতম মানে? এবং অবশেষে দেখেছি নিহত ও হত্যাকারী দু’জনে অবস্থান বদল করে অনুপুঙ্খে পরীক্ষা করে দেখেছে হত্যাকাণ্ডের মহলা। এবং নিশ্চিত হতে পেরেছি যে হারিয়ে যাচ্ছে না কেউ, না ‘আমি’, না মৃত্যুর চূড়ান্ত বিমূর্তন।
এখন মঞ্চ আলোকিত। না দৃশ্য, না সংলাপ, শূন্য, সাদা নৈশ অববাহিকায় আমরা কুড়িয়ে ফিরলাম চিন্তাশ্রয়ী অভিজ্ঞতার কিছু নুড়ি-পাথর।
সরোজিনী ছিল আমাদের আদিম বিকল্প।
…ট্রামলাইনের সারস…
পর্ব ৬. শ্রয়ডিঙ্গারের মার্জার আর জীবনানন্দের লুপ্ত বিড়াল প্রায় একই অর্থ বিচ্ছুরণ করে
পর্ব ৫. বিজ্ঞানই দর্শনকে গঠন করবে, ধর্ম নয়, ভেবেছিলেন জীবনানন্দ
পর্ব ৪. জীবনানন্দ কি তবে ‘দেশ’ বলতে স্পেস বুঝিয়েছেন?
পর্ব ৩. জীবনানন্দ কি তবে ‘দেশ’ বলতে স্পেস বুঝিয়েছেন?
পর্ব ২. জীবনানন্দেরই বিড়ালের মতো তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয় নৈশ সড়কে, ইতিহাসে
পর্ব ১. রবীন্দ্রনাথের নীড় থেকে জীবনানন্দর নীড়, এক অলৌকিক ওলটপালট
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved