Robbar

সেকালের ডাকাতির গপ্প

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 22, 2025 5:32 pm
  • Updated:August 23, 2025 3:15 pm  
Story of a village dacoit by Swapan Kumar Thakur | Robbar

আগেকার দিনে বড়লোকেরা কুড়ুৎ জাম কাঠের এক পাল্লার মোটা ফ্রেমের শোয়ানো দরজা করত। কাঠ আর মোটা মোটা লোহার রড দিয়ে বানানো সেই দরজা দোতালার সিঁড়ির মুখে ফেলে দিলে ওপরে ঢোকা প্রায় দুঃসাধ্য ছিল। তারপর দু’-বস্তা সর্ষে চাপিয়ে মোকা মরদ ছিরু মোড়ল পরনের কাপড় বাগিয়ে ইস্পাতের টেঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোহার রডের ফাঁক দিয়ে সাপের জিবের মতো ফলাটা ঝিলিক মারছে ঝলকে ঝলকে। মোড়ল তখন বলছে, ‘বাপের বেটা হবি তো ওঠ শালারা!’

স্বপনকুমার ঠাকুর

চাটুজ্যে ঠাকুর। বয়স চার কুড়ি পেরলে কী হবে, এখনও বেশ দড়ো। ছিপছিপে পাকা কঞ্চির মতো গড়ন। গায়ে একগোছ মোটা পইতে। স্বপাক রান্না করেন। এক মেয়ে। নাতি-পুতির ঠাকুমা। শহরে থাকে। বাপকে কতবার বলেছে, ‘আমার কাছে থাকবে চল’। সে গুড়ে বালি! ‘ভিটের মায়া ছাড়া কী সহজ কথা রে মা।’ পোস্ট আপিসে চাকরি করতেন। অল্পস্বল্প পেনসন পান। তাতেই দিব্যি হেসে-খেলে চলে যায়।

দু’-কুঠুরি চৌরি মাটির বাড়ি। লাগোয়া বঠুকখানা। পুবে পুকুর। বেশ স্বচ্ছ জল। হাঁস চড়ে। পানকৌড়ি থেকে থেকে ডুব মারে। পুকুরের ধারে বাঁশঝাড়। ঝিরঝির করে হাওয়া বয়। ঘাটে ঘাটে বউঝিরা বাসন মাজে। কোলাহল করে। জলছবির মতো দেখতে লাগে। নেশার মতো দেখতে দেখতে বেলা যায় বহে।

সাঁজবেলায় বঠুকখানা যেন গল্পদাদুর আসর। গল্প বলতে চাটুজ্যে ঠাকুরের জুড়ি নেই। অতুল মোড়ল আসে। গাঁ-সম্পর্কে পাতানো বেহাই। মানে বাল্যবন্ধু। পেংলা বায়েন আসে। গোলক বাউরি আসে। ছেউটে ছেলেপিলেরাও ভিড় করে তামাকের লোভে। দেদার চা। চা করে হোরে লাপিত। খরচাপাতি দেয় ঠাকুরমশাই। চা-টা খেয়ে চাটুজ্যে ঠাকুর আয়েশ করে। নিকোনো উঠোনে মোড়ায় বসে হুঁকো টানে পুরুত পুরুত করে। হ্যারিকেনের আলোটা চালের বাতায় ঝোলানো। বাঁশতলা থেকে চাঁদের আলো উঁকি মারে। একথা-সেকথা গালগল্প চলে সেই রাত ন’টা অবধি।

কথাটা পারল অতুল বেই। এক কলকে গাঁজা সেজে ক’টা ব-টান মেরে আঙারটাকে জমিয়ে নিয়েছে ততক্ষণ। তারপর জোরে একটা রাম-টান। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে কলকেটাকে বাড়িয়ে দেয় ওৎ পেতে বসে থাকা পেংলাকে। খুসখুশে কাশিটাকে সামলে বলে,

–ভারি সমিস্যে হয়েছে গো বেই!

–তোমার আবার কী হল?

–আমার কিছু লয়! গাঁয়ে ডাকাত আচ্চে শোন নাই!

–ডাকাত! চমকে ওঠে ঠাকুরমশাই। 

–কাল ধেঁয়ের পুকুরের পারে অনেকেই আলা দেখেছে। এনেক আলা জড়ো হয়েসল।

পেংলা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললে, ‘গাঁয়ে ঢেঁরি পড়েছে গো। কালকে বারোয়ারি তলায় মিটিন ডেকেছে সঞ্জয় মোড়ল। আগল দিতে হবে। তোমার কাছেও চাঁদা লিতে আসবে দা-ঠাকুর।

চাটুজ্যে ঠাকুর গম্ভীর হয়ে বললে, ‘বোশেখ-জষ্টি মাস। খুউব সাবধানে থাকতে হবে রে!’

–সেই তো গো!

–এখন তো যখসখ। আগে ফাগুনমাস পড়লেই গাঁয়ের লোকের কাছে রাত মানে আতঙ্ক। বেই তোমার তো মনে আছে, আমাদের ছোটবেলায় সেই ছিরু মোড়লের বাড়ির ডাকাত পড়ার ঘটনা।

কলকেতে শেষ টান মেরে অতুল মোড়ল বলে, সে আর বলতে! ওঃ কী ভয়ানক কাণ্ড! তুমিও তো ছিলে। কী রকম ডাকাতি বলো দিকিনি। ওরম বাবার জম্মেও শুনি নাই।

সবাই তখন একযোগে বলতে লাগল– ‘ডাকাতির ঘটনাটা বলেন দা-ঠাকুর’। সকলের জোরাজুরিতে চাটুজ্যে ঠাকুর শুরু করল সেই রোমহর্ষক ডাকাতির কাহিনি।

অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক

তা আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগেকার ঘটনা বটে বৈকি। কী গো বেই ঠিক কি না?

অতুল মোড়ল সায় দেয়। ‘হ্যাঁ, আমাদের তখন ছেউটে বয়েস’। ঠাকুর মশাই বললে– হঠাৎ খবর হল গাঁয়ে ডাকাতে টিকেল মারছে। মানে আরকাটি লাগিয়েছে।

গোলক বাউরি চিরকালের বোকা। কথার মাঝে ফোড়ং দেওয়া অভ্যেস। 

–মামা ঠাউর ওই আড়কাটি মানেটা তো বুঝলাম না। 

পেংলা ভীষণ ওল-কুটকুটে। গোলকের প্রতি বিরক্ত হয়ে বললে, ‘মুরুক্ষুর শতেক দোষ! সব কতাতেই ওস্তাদি!’

আহা! ওকে বকছিস কেন! বুইলি গোলক এই আগেকার দিনে ‘আড়কাটি’ মানে আগে থেকে লোক লাগিয়ে সব খবরাখবর সংগ্রহ করত। আরও কাজ ছিল তাদের। সেটাই বলছি শোন। জেনা পাইকার (গোরু-মোষের বেচাকেনা করত বলে গাঁয়ে তার পরিচিতি ছিল ‘পাইকার’) তখন গাঁয়ের মোড়ল। ক্ষেপা মোষের মতো চেহারা। দারুণ একগুঁয়ে আর সাহসী। বললে, ‘চার পাড়ায় চারটে দল করে রাত-পাহাড়া ফেল। রাত ১০টা থেকে ভোর ৩টে। তারপর দেখছি।’ 

আমাদের দলটা ছিল উত্তরপাড়ার মোড়ে। এটাই তো মেন রাস্তা। দিকশুনের মাঠকে নজর রাখতে হবে। জেনাকাকার দল আগল দিচ্ছে। বয়সে ছোট হলেও আমি আর বেই দলে ছিলাম। গোরুরগাড়ি লাগিয়ে আমাদের মতো রেঙা ফচকে ছেলের দল হুল্লাট করি সারারাত । মুরুব্বিরা হাতে লাঠি রামদা নিয়ে মাঠের দিকে সতর্ক নজর রাখে। তারপর সবাই মিলে আচমকা হাঁক মারি প্রবল উৎসাহে– ‘হৈ… হৈ…’।

‘হৈ’ ওঠে তিনপাড়া থেকে। এইভাবেই চলছিল। একদিন হঠাৎ হলো কী…

সবাই দ্বিগুণ কৌতূহল নিয়ে বললে, ‘কী হল? কী হল?’

আরে বলছি রে বাবা! মাঠে ঘুরঘুট্টি আঁধার। জেনা পাইকারের চোখ অন্ধকারেও জ্বলে। সবাইকে বললে– ‘চুপ! একদম চুপ। আয় আমার সঙ্গে।’ বুনোপুকুরের তেঁতুলতলা থেকে চাপা স্বরে বললে, ‘ওই দ্যাখ!’

‘কী দেখলেন?’ গোলক বাউরি জিজ্ঞাসা করে।

রেতের মাঠ বড় ভয়ানক রহস্যময় রে। রাত তখন দুটো তো বটেই। সবাই দেখছে একটা আলো অনেকদূর থেকে মাঠ ভেঙে এগিয়ে আসছে। আর মাঝে মাঝে বুইলি কি না দফ করে দু’ হাত লাফিয়ে আগুন জ্বলে উঠছে।

 –বাপ রে! ও যে পেত্তা! আলারভুত!

আমরাও তাই মনে করেছিলাম। কিন্তু জেনা পাইকার অন্য ধাতুতে তৈরি। তার বাঁ-হাতে মশাল আর এক হাতে চকচকে রাম-দা। বললে, ‘শ্যালোর ভূত আজ দেখবই। চল তো দেখি।’

জমাট বাঁধা আঁধার। আমি তো পইতেটা ধরে রামনাপ জপ করতে করতে ওদের মাঝে আলপথ ধরে এগুচ্ছি। অনেকটা কাছে চলে এসে এসেছে আলোটা। এক-একবার দপ করে জ্বলে ওঠে। আবার ছোট হয়ে যায়। হঠাৎ আলোটা থমকে গেল। কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। তারপর অনেকটা দূরে যেন আলোটা ছিটকে পড়ে গেল। তারপর দ্রুত পায়ের শব্দ। মনে হয় লোক দেখে দেলা বাঙ্কানা!

‘তাহলে আলোটা কীসের জেঠু!’ মানিক মুখুজ্যের ছোকরা ছেলেটি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করে। 

–মাথায় বিঁড়ে করে বসানো মাটির খাপুড়িতে ঘুঁটের আগুন। মাঝে মাঝে ধুনো দিচ্ছিল আর আগুন জ্বলে উঠছিল। 

–তারপর! তারপর!

জেনা পাইকার মশাল নিয়ে ছুটছে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড! সেও ছুটছে, আমরাও ছুটছি। জেনা পাইকার খিস্তিখেউর করছে আর বলছে, ‘আয় দেখি! ভয় দেখাবার জায়গা পাস নাই। আজ তোকে মায়ের ভোগে পাঠাব।’ গ্রাম ছেড়ে তখন আমরা পাকা সরানের কাছাকাছি। 

কিন্তু আলোর ভূত তার আগেই মিলিয়ে গেছে ঘোর অন্ধকারে।

হঠাৎ ঘোর কাটে হাড়হিম আর্তনাদে!

–বাঁচাও! বাঁচাও!

জেনা খুড়ো হায় হায় করে উঠল। ‘যা! আড়কাটি দিয়ে আমাদেরকে বোকা বানিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে ডাকাতদল গ্রামে ঢুকে পড়েছে!’ 

নারীকণ্ঠের আর্ত চিৎকারটা ভেসে আসছিল ছিরু মোড়লের বাড়ি থেকে। ছিরু মোড়ল গাঁয়ের ধনী লোক। বিরাট জোতদার। চার-হেলের চাষ। ওর বাড়িতে ডাকাতি করাটাও সহজ কম্মটি নয়। কিগো বেই ঠিক কি না? বেই অতুল মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ে। 

চাটুজ্যে ঠাকুর তামাক টানতে টানতে বলে, গাঁয়ের মূল রাস্তার ধারে তখন দোতালা দালানবাড়ি। ইটের বারান্দাকোঠা। বিশাল উঠোন। একপাশে ঢেঁকিশাল। রান্নার চালা। উঁচু ইটের প্রাচীর। তারপরে খামারবাড়ি। সাঁই সাঁই মড়াই বাঁধা। একটেরে গোয়ালবাড়ি। বড় বড় খড়ের পালুই। ছানিকাটা চালা। তার উপর আবার চাপা দরজা! 

‘সেটা আবার কী দরজা গো দা-ঠাকুর?’ হোরে লাপিত জিজ্ঞেস করে।

আগেকার দিনে বড়লোকেরা কুড়ুৎ জাম কাঠের এক পাল্লার মোটা ফ্রেমের শোয়ানো দরজা করত। কাঠ আর মোটা মোটা লোহার রড দিয়ে বানানো সেই দরজা দোতালার সিঁড়ির মুখে ফেলে দিলে ওপরে ঢোকা প্রায় দুঃসাধ্য ছিল। তারপর দু’-বস্তা সর্ষে চাপিয়ে মোকা মরদ ছিরু মোড়ল পরনের কাপড় বাগিয়ে ইস্পাতের টেঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

লোহার রডের ফাঁক দিয়ে সাপের জিবের মতো ফলাটা ঝিলিক মারছে ঝলকে ঝলকে।

মোড়ল তখন বলছে, ‘বাপের বেটা হবি তো ওঠ শালারা!’

জনা পঞ্চাশেকের ডাকাত দল। পরনে হাফ প্যান্ট। গায়ে কালো গেঞ্জি। মুখে কালিঝুলি। রাস্তার দু’পাশে কয়েকজন কালান্তক যমের মতো ডাকাত সরকি নিয়ে দাঁড়িয়ে ।

বাজখাঁই গলায় বলছে– ‘খবরদার! এগুলেই শেষ।’ 

ততক্ষণে গাঁয়ের লোক সব জেগে গেছে। লাঠি হাতে তারাও অনেকটা তফাতে দাঁড়িয়ে। এগোবার জো নেই। কারণ সাক্ষাৎ মরণ দাঁড়িয়ে। জেনা খুড়ো তখন পরামর্শ করতে লেগেছে গাঁয়ের বাছাই করা জোয়ান ছেলেদের সঙ্গে। 

দুম দুম করে বিকট আওয়াজ আসছে। দরজা ভাঙছে ডাকাতরা। সবাই বুঝতে পারল ডাকাতরা ঢেঁকিশালের ঢেঁকি তুলে সম্মিলিতভাবে দরজার মাঝে মারছে প্রবল গুঁতো। আর পাল্লা দিয়ে মেয়ে-বউরা আর্তচিৎকার করে বলছে– ‘কে কোথায় আছ, বাঁচাও!’

জেনা পাইকার অস্থির হয়ে বললে এভাবে হবে না। দুটো বাছাই দলের একটিকে ওই রাস্তার মোড়ে পাঠিয়ে দিল। আরেকটা দল এই রাস্তার মোড়ে থাকল। বললে, ‘ডাকাতি করবি কর। কিন্তু কোনদিকে বেরিয়ে যাস একবার দেখব। দু’-একটাকে ঠিক কবজা করবই।’

আবার হাউমাউ করে কান্নার চিৎকার ভেসে উঠল। ‘বাঁচাও গো! মোড়লকে মেরে ফেলল।’

সবাই বুঝতে পারল, দরজা ভেঙে ডাকাতরা দোতালায় সেঁদিয়েছে। আর মোড়লকে ধরে ফেলেছে। একের পর পর এক অপারেশন চলছে। ডাকাতরা মাথায় করে বড় বড় বস্তা আনছে খামারবাড়িতে। দড়াম করে পড়তে বোঝা গেল ওগুলো কাঁসার বাসনপত্তর। মোড়লের বন্দুকি কারবার ছিল। সেইসব বস্তাবন্দি বাসন নিয়ে আসছে ডাকাতরা।

সবাই তখন বলাবলি করছে, ‘আমরাও দেখব ওই বস্তা লিয়ে তোরা কীভাবে গাঁ থেকে বেরিয়ে যাস!’

মোড়ল চিৎকার করছে ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ 

মোড়লের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। সেকালের ডাকাতদের অত্যাচার ছিল ভয়ংকর। ওরা মেয়েদের গায়ে হাত দিত না। কিন্তু সব রাগ পুষিয়ে নিত বাড়ির পুরুষকে বাগে পেলে। উনুনে আগুন জ্বেলে তামার টাটে ন্যাংটো করে বসিয়ে চেপে ধরত– পেট থেকে খবর বের করার জন্য। কিংবা ঢেঁকির গড়ে উপুড় করে শুইয়ে দুটো দশাসই ডাকাত পার দিত মাজার ওপরে। মাঝার হাড় ছাতু হয়ে যেত। সেইরকম একটা কিছু হচ্ছে আর কী! 

মোড়ল আর্ত চিৎকার করে বলছে, ‘জানি না, জানি না সে কোথায়! ছেড়ে দাও তোমাদের দুটো পায়ে পড়ি। আর সহ্য করতে পারছি না গো।’ পরে শোনা গিয়েছিল সোনাদানা পুঁটুলি বেঁধে মোড়লগিন্নি কোন ফাঁকে চম্পট দিয়েছে। ডাকাতদের কাছে খবরাখবর থাকে। হন্যে হয়ে মোড়লগিন্নির খোঁজ করছে ডাকাতরা।

কিন্তু কোথায় মোড়ল গিন্নি! এদিকে ডাকাতিও প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশি হয়ে গেছে। জেনা পাইকারের দলবলও প্রস্তুত।

সবাই চিৎকার করে বলল, ‘আসছে! ডাকাত আসছে! সাবধান। তফাত যাও।’ সামনের লোকটা চকচকে বগি হাতে অন্ধকারে মিশে গেল। জেনার দল একটু কাছে ঘেঁষতেই উড়ে আসতে লাগল এক-একটা মারাত্মক চক্র! 

–চক্র! সেটা আবার কী!

ওই যে কাঁসার বগি! বেলিঞ্চি, কানা উঁচু থালা। ডাকাতরা এমন কায়দায় ঘুরিয়ে লোকের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এসে আছড়ে পড়ছে আমাদের পায়ের কাছে। সামনে যে যাবে তার গলা দু’-ফাঁক হয়ে যাবে মুহূর্তেই।

 –ওরে বাসরে! 

হ্যাঁ! তবে আর বলছি কী! দু’দিকেই ছুড়ছে। লোকজন হতভম্ব হয়ে গাঁয়ের ভেতর বাগে ছোটাছুটি শুরু করেছে। ডাকাতদের সামনে দাঁড়ানোর কার হিম্মত আছে!

–বলেন কী জেঠু! 

নিজের চোখে দেখা। বুইলে বাপধন, ‘ফ্লাইং ডিস্ক’। মহাভারতে যেমন শ্রীকৃষ্ণ চক্র ছুড়ে শিশুপালের গলা কেটে দিয়েছিল সেইরকম ব্যাপার। চোখের সামনে দিয়ে ডাকাতদল ডাকাতি করে এমন কায়দা করে বেরিয়ে গেল– সত্যি ভাবা যায় না! কত কৌশল আর বুদ্ধি ধরে ডাকাতদের ঘটে।

–তারপর? তারপর?

তারপর আবার কী! সবাই মোড়লের বাড়ি গেলাম। মোড়লকে খুব অত্যাচার করেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মোড়লের বাড়ির মেয়েরা আতঙ্কে তখনও ঠক ঠক করে কাঁপছে। মোড়ল কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘ওরে ডাকাতরা গিন্নিকে মেরে কোথায় ফেলে রেখেছে দ্যাখ তোরা।’ হায় হায় বলে কপাল চাপড়াতে লাগল।

সবাই মোড়লগিন্নির খোঁজ করছি। এ গলি সে গলি। মড়াই-এর ফাঁকফোঁকর, খড়ের পালুইয়ের তলা– সবাই তন্ন করে তন্ন করে খুঁজছি। কোথাও তার টিকি দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ…

–বাকিটা বলো গো বেই।

বলেই দুলে দুলে পরাত পরাত করে হুঁকো টানতে লাগল।

সবাই তখন বেইকে ঘিরে ধরে বলতে লাগল, ‘বলো বলো, শেষ পর্যন্ত কী হল?’

কী আর হবে! আমি হঠাৎ ছানিকাটার চালায় গিয়ে বড় বাজরাটা তুলতেই দেখি– মোড়লগিন্নি বুকের মধ্যে পুঁটলি ধরে গুটিয়ে ডাব হয়ে মরে পড়ে আছে।

–বলো কী!

হ্যাঁ। কিন্তু পুঁটুলিটা টানতেই আরেক কাণ্ড! 

মোড়লগিন্নি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এই! এই কেলে ছোঁড়া! খবরদার আমার পুঁটুলিতে হাত দিবি না।’

ব্যস! সকলে হো হো করে হেসে উঠল।

লোক শব্দার্থ:

১. ছেউটে– অল্পবয়সি| ২. ব-টান– ছোট ছোট করে টেনে আগুন জমানো টান| ৩. ঢেঁরি– গ্রামের বারোয়ারি কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে মিটিং ডাকার প্রয়োজন হলে ঢোল বাজিয়ে জানানোর প্রথা| ৪. ওলকুটকুটে– দেশি ওল খেলে যেমন গলা কুটকুট করে তেমনি মুখরা স্বভাব (লোকবাগধারা) | ৫. আগল– রাতপাহাড়া | ৬. রেতে– রাতি > রাইত > রেত (খাঁটি অভিশ্রুতির দৃষ্টান্ত)| ৭. পেত্তা– প্রেত; লোকবিশ্বাসে অগ্নিমুখী ভূত| ৮. দেলা বাঙ্কানা– সাঁওতালি শব্দগুচ্ছ, এখানে কেটে পড়া অর্থে ব্যবহৃত | ৯. বিঁড়ে– খড় দিয়ে বানানো গোলাকার রিং| ১০. চার হেলে– আটটা বলদ নিয়ে চাসবাস করা। জমির আধিক্য বোঝাতে ব্যবহৃত। | ১১. সাঁই সাঁই– প্রকাণ্ড অর্থে। লৌকিক বহবচনাত্মক প্রত্যয়। | ১২. মোকা– দুর্ধর্ষ | ১৩. টেঁটা– বল্লম | ১৪. রেঙা-ফচকে– ‘রেঙা’ শব্দটি এসেছে রাঙা থেকে। ‘ফচকে’ মানে তরলমতি। অর্থাৎ রঙ্গপ্রিয় কিশোর সুলভ আচরণ।

……………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

……………………….