Robbar

খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 16, 2025 8:42 pm
  • Updated:December 16, 2025 8:42 pm  

শিউলিরা রসের উপযোগী গাছ ঝোরে সেই কার্তিক মাস থেকে। বিকেল হলেই বাঁশের তৈরি ‘ঠুই’ বা ‘ঠোলা’ পিঠেতে বেঁধে নেয়। তাতে থাকে দা, হেসো। বালি আর সুপারি কাঠে হেসো ধার দিয়ে নেয়। কোমরে থাকে খানিকটা চট। একটা ছোট দড়ি। হাত তিনেক লম্বা বাঁশের টুকরো গাছের সঙ্গে বেঁধে নেয়। তার উপরে দাঁড়িয়ে আরেক প্রস্থ দড়ি দিয়ে নিজেকে বেঁধে নেয় গাছের সঙ্গে।

স্বপনকুমার ঠাকুর

১৪.

হিম হিম হাওয়া। পাতা ঝরা বিষণ্ণ বিকেল। কামানো খেজুর গাছের চিকন নল বেয়ে টুপ টুপ করে ঝড়ে পড়ে জিরেনের রস। শীত-ভেজা সকালে আলতো রসে পড়ে আলগা আঁচ। বাউল বাতাস তখন মিষ্টি গন্ধে ম-ম। এ যেন নলেন গুড়ের মৌতাত। 

গেরস্থের ভাঁড়ারে উৎসবের আমেজ। পাটালির চাক ভেঙে গৃহদেবতাকে নিবেদন। পিঠে-পুলি-পাটিসাপটা-পায়েসের পদাবলি। নবান্নের স্পেশাল মিষ্টান্ন নলেন গুড়ের কাঁচাগোল্লা। একপেট গুড়-ভরা লোভনীয় রসের পৃথিবী গিরিমাখা গুড়ের রসগোল্লার আবক্ষ অবগাহন। মনের একতারায় বাজে– ‘খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন’।

কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই আপাত কাটখোট্টা খেজুর গাছ বা খেজুর গুড় নিয়ে সামান্য খেজুরে আলাপটি পর্যন্ত নেই। উভয়েই ব্রাত্য।

অথচ সেখানে স্বমহিমায় আখ আর আখের গুড়। দক্ষিণবঙ্গের পুরনো নাম গৌড়দেশ। উত্তরবঙ্গকে বলা হত পুণ্ড্রবর্ধন। পণ্ডিতরা বলেন– দু’টি স্থাননামই এসেছে আখ ও আখের গুড় থেকে। গ্রাম-বাংলায় আখ শুধু আখ নয়, যেন বলির পশু। ঠাকুর-দেবতার থানে তার বাড়তি কদর। 

এদিকে চৈতি বাওর তখনও গনগনে আগুন হয়ে ওঠেনি। সাঁঝ-সকালে নরম-গরম ভাব। মাঠঘাটে খরানির ধানের জমিতে সবুজের অভিযান। এদিকে ব্যস্ততা আখ কাটায়, ঝোরায়, ডাং করে বোঝা বাঁধায়। গাঁয়ের তেঁতুলতলায় আখ মারাইয়ের শাল বসেছে। সারা দিনরাত জোড়া-জোড়া বলদের শুধু পরটানা, অর্থাৎ প্রহর জাগা। আখ পেষাই করে এক পাদনা রস করে দিলেই এক জোড়া বলদ আর মুনিশের ছুটি।

গ্রামবাংলার আখশাল

মৌমাছির মতো ভ্যান ভ্যান করে ছেলেপুলের দল। নিশিরাতে গুড়বারুইরা ধম্মোরাজের দোহাই পেড়ে রসের জাল পাড়ে। শুকনো আলসের আঁচে। গাদ তোলা। রসে ফুট এলে ঝাঁপ মারা। শেষে টোপা-টোপা গুড় ফুট। শুরু হয় তুঙ্গ ব্যস্ততা। শেষে তাকবাগ দেখে নাদনা খুলে সফেন লালচে গুড় মাটির গামলায়। 

একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ভোরের বাওরে। মনে পড়ে যায় হাজার বছর আগের লেখা সদুক্তিকর্ণামৃতের একটি শ্লোকের শেষ পঙ্‌ক্তি– ‘সংসক্ত ধবনদিক্ষুযন্ত্রমুখরা গ্রামা গুড়ামোদিনঃ’ অর্থাৎ গাঁয়ে গাঁয়ে আখ মারাইয়ের কলের শব্দে মুখর আর নতুন গুড়ের গন্ধে আমোদিত।

আখের গুড় নামছে

কিন্তু খেজুর গাছ সম্পর্কে এমন কথা কখনওই শুনিনি। আমাদের দেশে যত্নআত্তি করে ব্যবসাদার বিনে কেউ খেজুর গাছ লাগান কি না জানা নেই। পরিচর্যার কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল। পাখির ঠোঁট বাহিত হয়ে অযত্নে অবহেলায় ঝোপেঝাড়ে উঁকি মারে হাড়-বেরনো অনাথ খেজুর গাছ। 

অথচ বাইবেলে এই গাছ বারবার অভিনন্দিত। মুসলিমদের ইফতার পর্ব এই ফলটি দিয়েই শুরু হয়। খেজুরের পুষ্টিমূল্য অসাধারণ। ক্যালসিয়াম, আয়রন আর ফসফরাস মেশানো এক উত্তেজিত টনিকের মতো পাতলা সুগন্ধি নলেন গুড়।

একেবারেই কৌলিন্য নেই এমন কথা খানিকটা গা-জোয়ারি। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪-পরগনা, গাঙ্গেয় বৃহত্তর বর্ধমান– বিশেষ করে দাঁইহাট-অগ্রদ্বীপ-পাটুলি-দেবগ্রাম-মাটিয়ারির সঙ্গে জড়িয়ে আছে খেজুর গুড়ের খ্যাতি। আর মিষ্টি বাণিজ্যের ইতিকথা।

বাংলাদেশের যশোরের পরিচিতি এক রসালো ছড়ায়– ‘যশোরের যশ/ খেজুরের রস’। পাটুলি-র নাম না কি খেজুরের পাটালি থেকে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের বাংলা কালচারে খেজুর গাছ কামানো থেকে গুড় বানানো– এই পুরো বিষয়টিতে জড়িয়ে আছে এক প্রাচীন জনজাতি– ‘শিউলি’। এরাই প্রাচীন রস-শিল্পী। গুড়বারুই। ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ থেকে এরাই গাছ কামিয়ে বের করেন ডাগর কলসি-ভরা রস। কাঁচরাপাড়ার কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন–

পরিপূর্ণ সুধা বিন্দু খেজুরের কাঠে।
কাঠ কেটে উঠে রস যত কাঠ কাটে।।
দেবের দুর্লভ ধন জীবনের ঘড়া।
এক বিন্ধু রস খেলে বেঁচে ওঠে মরা।।

শিউলিদের ঠুলি

শিউলিরা রসের উপযোগী গাছ ঝোরে সেই কার্তিক মাস থেকে। বিকেল হলেই বাঁশের তৈরি ‘ঠুই’ বা ‘ঠোলা’ পিঠেতে বেঁধে নেয়। তাতে থাকে দা, হেসো। বালি আর সুপারি কাঠে হেসো ধার দিয়ে নেয়। কোমরে থাকে খানিকটা চট। একটা ছোট দড়ি। হাত তিনেক লম্বা বাঁশের টুকরো গাছের সঙ্গে বেঁধে নেয়। তার উপরে দাঁড়িয়ে আরেক প্রস্থ দড়ি দিয়ে নিজেকে বেঁধে নেয় গাছের সঙ্গে।

সূর্যের আলো পড়ে যে দিকে গাছের চাঁচ পড়ে সেদিকে। পরপর কয়েকদিন। তারপর গাছ রসবতী হলে দু’ মাথায় গজাল ঠুকে ঠিলি বা কলসি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ভি-আকৃতির চাঁচার বিন্দুতে গেড়ে দেওয়া হয় বাঁশের একটি নল। টুপটুপ করে ঝরে পড়ে রস। ভোরবেলায় শিশির-মাখা রসের কলসি নিয়ে গুড় প্রস্তুতির আয়োজন।

সপ্তাহে তিনদিন জিরেন দিয়ে যে প্রথম কাটের রস বের হয়, তার নাম জিরেন কাটের রস। দেখতে কাচ-কাচ। সুগন্ধযুক্ত। খেতে ভারি মিষ্টি আর সুস্বাদু। এরপর রয়েছে দো-কেটের রস। গেঁজে যাওয়া রস ‘তাড়ি’। অনেকের বড় আদরের সামগ্রী। খেলে বেবাক নেশা ধরে।

গুড় তৈরির এলাহি কাণ্ড! বসে বসে জ্বাল দেওয়া। তাকবাগ দেখে গুড় নামানো। এক কথায় এক অপূর্ব শিল্পকথন। এই সুগন্ধি নলেন গুড়ের সঙ্গে কনকচূড় ধানের খই মিশিয়ে জয়নগরের মোয়া বানানো হয়। রসঘন পাটালি, আসকে পিঠে, সরুচাকলি খাওয়ার প্রধান উপকরণ। সুফিয়া কামালের ‘হেমন্ত’ কবিতাটি মনে পড়ে:

আরও এলো সাথে সাথে
নতুন গাছের খেজুর রসে।
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।। 

এখন সেই রাম না থাকলেও ভেজালের অযোধ্যার বিচিত্র পরিধি। গুড়ে চিনি তো ছিলই, সঙ্গে আলুসেদ্ধ আর কৃত্রিম রঙের ছড়াছড়ি। ‘গুড়’ নামক বস্তুটি ক্রমশ উধাও। পাকা খেজুরের মতো কবে খসে পড়েছে ‘শিউলি’ নামক রসরাজরা। 

 

তবু শীত এলেই মনে পড়ে খেজুর গাছ। গাছে হাঁড়ি। হাঁড়িতে রস। রসে মন। আর মনের একতারায় বাজে রসের অনাহত ধ্বনি– খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন…

আলোকচিত্র: সুমন্ত বড়াল

………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..

পর্ব ১৩: বৈদিক যুগের ‘স্থালী’-ই আজকের প্লেট, ‘উখ্য’-ই ফ্রাইং প্যান

পর্ব ১২: লোকখেলার মধ্যে মিশে রয়েছে হাজার বছরের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি

পর্ব ১১: অঘ্রানের নবান্ন মূলত নববর্ষেরই উৎসব ছিল

পর্ব ১০: বারবণিতাদের আরাধনার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল কাটোয়ার কার্তিক লড়াই

পর্ব ৯: শিশুঘাতক থেকে কেন শিশুরক্ষক দেবতা হয়ে উঠলেন কার্তিক?

পর্ব ৮: তেনাদের পুজো, তেনাদের মেলা-মোচ্ছব

পর্ব ৭: প্রেত মানেই ভূত বা অতীত, কিন্তু সকল প্রেতই ভূত নয়!

পর্ব ৬: কেবল কালী নন, লৌকিক লক্ষ্মী ঠাকরুনও দাঁড়ান স্বামী নারায়ণের বুকে পা রেখেই

পর্ব ৫: মহিষাসুরমর্দিনী নন, কৃষিপ্রধান বাংলায় আদিপূজিতা ছিলেন শস্যদেবী নবপত্রিকা

পর্ব ৪: পুকুরের দেবতা পুকুরের ভূত

পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস

পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর

পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প