ওই সময় থেকেই হেরোইন নামক বিষটি কীভাবে যেন ম্যাজিকের মতো চলে আসে কোনও অজানা পথ দিয়ে এ বাংলা দেশে। নতুন শব্দ শুনতে পাওয়া যায়– রিহ্যাব। গজিয়ে উঠতে থাকে নেশামুক্তি কেন্দ্র। আমি নিজের চোখে দেখেছি একঝাঁক ব্রিলিয়ান্ট ছেলের দল কীভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকে। কীভাবে তাদের চরিত্র পর্যন্ত বদলে দেয় এই নেশা, আমি দেখেছি। কেউ কেউ ফিরে এসেছে, বেশিরভাগই চলে গেছে।
না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে তাহাকে চুরি বলা হয়, বলে নিলে তা চুরি হয় না। ’৮৪ সালেও এদেশে শিবঠাকুরের পরম প্রসাদ পাওয়া যেত সরকারি আবগারি দোকানে। যে দেশের চন্দ্রযান বীরবিক্রমে চাঁদের পিঠে তার ধাতব পা রাখে, সেই জায়গার নাম হয় মহাদেবের নামে। আবার সে দেশেই ক্লোরোফিল থাকা বা ক্লোরোফিল সমৃদ্ধ আয়ুর্বেদিক নেশা, যা আবার কিনা হিন্দু ধর্মের মহা দেবতা, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের সুপারস্টার শিবের প্রসাদ সেটাই বন্ধ করে দেওয়া হয় কার ষড়যন্ত্রে, কে জানে? এ এক ধোঁয়াশা। আরও ধোঁয়াশা, যখন তার বহু যুগ আগে এক কবি লিখে ফেলেন, ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে।’ আরও ধোঁয়াশা হয়, যখন মনে পড়ে ওই সময় থেকেই হেরোইন নামক বিষটি কীভাবে যেন ম্যাজিকের মতো চলে আসে কোনও অজানা পথ দিয়ে এ বাংলা দেশে। লক্ষ লক্ষ যৌবন ওই নোংরা মাদকের মহিমায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে ফেলে, প্রভু হয়ে যায় সে নেশা। র্যাট-পয়জন আর ওপিয়ম মেশানো সেই বিষ রাংতার ওপর পুড়তে থাকে, পুড়তে থাকে কত পরিবার। নতুন শব্দ শুনতে পাওয়া যায়– রিহ্যাব। গজিয়ে উঠতে থাকে নেশামুক্তি কেন্দ্র। ‘ধোঁয়া আর ধোঁয়া তুমি যে কুয়াশা ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া’।
আমি নিজের চোখে দেখেছি একঝাঁক ব্রিলিয়ান্ট ছেলের দল কীভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকে। কীভাবে তাদের চরিত্র পর্যন্ত বদলে দেয় এই নেশা, আমি দেখেছি। কেউ কেউ ফিরে এসেছে, বেশিরভাগই চলে গেছে। ফিকে হয়ে গেছে। আমি দেখেছি আমার বন্ধুদের হারিয়ে যেতে। তাদের পরিবারের পাংশু মুখ দেখেছি। দেখেছি কোনও বন্ধুর স্ত্রীকে আত্মহত্যা করতে। সুন্দর, সুস্থ স্বাভাবিক স্বজনকে দেখেছি এই নেশার পয়সা জোগাড় করার জন্য চুরি করতে।
আমি অবশ্য এই কারণে চুরি করিনি, আমি চুরি করেছিলাম খুবই অল্প বয়সে, একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। না বলে নিয়েছিলাম। পরের দ্রব্য তো বটেই, কিন্তু সে বড় অল্প বয়সে। সে ঘটনার বিশদ বিবরণের আগে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, আমার দুই বন্ধুর মুখ। নাম বলছি না, নামে কী আসে যায়! চরিত্ররা বদলে যায়, কিন্তু ঘটনাগুলো যেন একই ঘটতে থাকে। একই প্রেম, একই বিচ্ছেদ, একই যুদ্ধ, একই খুন, একই চুরি, শুধু বদলে যায় মুখগুলো। চুরি অনেকেই করে। কিন্তু রসিক চোর পাওয়া যে কোনও রসিক মানুষ পাওয়ার মতোই দুষ্কর। দূরবীন লাগিয়ে খুঁজতে।
নাম দুটো বদলে দিলাম। ধরে নিলাম রূপম আর রূপেশ। রূপম বঙ্গের বাইরে পাহাড়ি বোর্ডিংয়ে থাকা একটি বড় লোকের ছেলে। কলকাতায় ফিরে ভর্তি হয়েছে উত্তর কলকাতার একটি কলেজে। রূপেশ অনাথ। মামার বাড়িতে মানুষ। স্বাদ পেয়েছে হেরোইনের। যার দেশি ডাকনাম হয়েছিল ‘পাতা’। তা সেই অর্থে সে ততদিনে হয়ে উঠেছিল পুরোদস্তুর পাতাখোর। আর পাতার বশে তার চরিত্র গেছিল বদলে। একদিন রূপম আমাকে বলল, রূপেশ না কি তার ছ’টা ক্যাসেট নিয়ে চলে গেছে। আর ফেরত দিচ্ছে না। আমি একটু ডাকাবুকো বরাবরেরই। আমার পরিচিত সমবয়সিরা আমাকে একটু সমঝে চলত। রূপেশ তো বটেই। বিশ্বাস করা কঠিন হবে হয়তো, কিন্তু এরকম একটা সময় ছিল, যখন পাড়ায় কোনও সমস্যা হলে কেউ কেউ তার সমাধানের জন্য আমার শ্মরণাপন্ন হত। কেউ হয়তো কারও টাকা ফেরত দেয়নি বা একটা ক্লাবঘরের দখল নেওয়া দরকার। আমার কাছে এরকম টুকটাক সমস্যা সমাধানের জন্য আসত কেউ না কেউ। সে সবই হয়তো খুব ছোট সমস্যা। কিন্তু আসত আমার কাছে। সে একটা সময় ছিল। বয়স কম, বুঝতাম কম। কিন্তু অনেকেই আমাকে পছন্দ করে আমার পাশে থেকে যেত। পছন্দ করত। লোকে ভাবত আমার দল আছে এবং ক্ষমতাও। ঠিক এই ভাবনা থেকেই সম্ভবত রূপম এসে কমপ্লেন করল আমার কাছে। যে রূপেশ নাকি তার ছ’-ছ’টা ক্যাসেট নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। আমি রূপমকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ক্যাসেট নিয়েছে তোর থেকে? রূপম যে অ্যালবামগুলোর নাম বলল, তাতে আমার সন্দেহের ঘনত্ব আরও বাড়ল। ‘এসিডিসি’ আর ‘হোয়াইট স্নেক’-এর গানের ক্যাসেট। রূপেশ! অসম্ভব! রূপেশের সঙ্গে এ গানের যোজন যোজন দূরত্ব। ও ব্যাটা খুব বেশি হলে ‘বনি এম’ বা ‘আব্বা’ শুনলেও শুনতে পারে। কিন্তু অ্যাসিড রক! রূপেশ ইম্পসেবল! রূপেশের সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি খুব পরিষ্কার করে বললাম, তুই রূপমের ক্যাসেট চুরি করেছিস কেন? সে বলল, আমি তো চুরি করিনি। বললাম, ইয়ার্কি হচ্ছে। তুই রূপমের থেকে ক্যাসেটগুলো নিসনি? অক্লেশে বলল, হুঁ, নিয়েছি। কিন্তু আমি তো রূপমকে বলে নিয়েছি। আমি বললাম, তুই ফেরত দিসনি কেন ক্যাসেটগুলো। রূপেশ বলল, কী করে দেব, ওগুলো তো আমি বিক্রি করে দিয়েছি।
বিদ্যাসাগরের কথা কেমন যেন ঘেঁটে গেছিল আমার সেদিন। বলিয়া পরের দ্রব্য নিয়ে তাহা ফেরত না দিয়ে যদি কেহ বিক্রি করে দেয়, তাহলে কি তাকে চুরি বলা যাবে! আমার মা আমাকে বাধ্য করেছিল ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা ফেরত দিতে। আমার উপায় ছিল না। আমি ফেরত দিয়েছিলাম। অপমানিত হয়েছিলাম। সেই খেলনা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা, আজও ভাবি আমি তো কোনও দিন ডাক্তার হতে চাইনি। তবে কেন চুরি করেছিলাম। খেলার ছলে?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved