কলকাতা থেকে এসে স্যালিউ টিম হোটেলে ঢুকতেই আমার রুমে নিয়ে গেলাম। বললাম, চার্চিলের দশজন ফুটবলারকে ভুলে যেতে। এমনকী, মাঠের মধ্যে যদি ইয়াকুবু বাদ দিয়ে চার্চিলের বাকি দশজনকে দেখতেও না পায়, সেটাই ভাল হবে আমাদের জন্য। স্যালিউর চোখ থাকবে শুধুই ইয়াকুবুর প্রতি। মাঠের যে কোণে ইয়াকুবু যাবে, স্যালিউর কাজ থাকবে সেই খানে পৌঁছে ইয়াকুবুর শরীরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকা। ইয়াকুবু ঘুরলে স্যালিউ ঘুরবে। ইয়াকুবু হাঁটলে স্যালিউ হাঁটবে। ইয়াকুবু দৌড়লে স্যালিউ দৌড়বে। মানে, মাঠের ভিতর ইয়াকুবু যা করবে স্যালিউ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে। ইয়াকুবু যেন কোনও মতেই ‘ফ্রি’ না থাকতে পারে।
৮.
কোচ সুব্রতকে বোঝানোর গুরুদায়িত্বটা আমার ঘাড়েই পড়ল। কিন্তু পরিস্থিতিটা একবার ভাবুন! খেলা হবে চার্চিলের ঘরের মাঠে। ওদের সমর্থকরা গ্যালারিতে বসে শুরু থেকেই হুশ, হুশ আওয়াজ দিতে শুরু করে। আলেমাও চার্চিল একেবারে পরিবার, দলবল নিয়ে ভিআইপিতে বসে থাকে। ওদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দরকার শুধু একটা ড্র। সেখানে আমাদের জিততেই হবে। তার উপর ওরা হেলাফেলা করা দল নয়। কারণ, ওদের স্ট্রাইকারের নাম– ইউসুফ ইয়াকুবু। টপ ফর্মের ইয়াকুবুকে যাঁরা সামলেছে, সেই ডিফেন্ডারদের জিজ্ঞাসা করে নিতে পারেন, ব্যাপারটা কতটা কঠিন ছিল। এরকম অবস্থায় ঘরের মাঠে চার্চিল আমাদের ছেড়ে দেবে ভেবেছেন? তবুও আমরা সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছিলাম না। সুযোগের এত কাছে এসে গিয়েছি যখন, সবাই মিলে একটা শেষ চেষ্টা করতে চাইছিলাম। এমনিতে দলের ব্যপারে শেষ কথা কোচেরই বলা উচিত। কোন ফুটবলাররা খেলবে, তা ঠিক করার সিদ্ধান্ত একমাত্র কোচের। কিন্তু কোনও কোনও সময় হয়তো নানা চাপে কোচও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সেই সময় পাশ থেকে টুকরোটাকরা অ্যাডভাইসে পুরো পরিস্থিতিটা বদলে যায়। এবার কোচ পাশ থেকে আসা সেই অ্যাডভাইস নিতেও পারেন। না-ও নিতে পারেন। সেদিন গোয়াতে পরিস্থিতিটা ছিল এরকমই। তবে শুধু অ্যাডভাইস নয়। বাঘাদা’র জায়গায় অন্য স্টপার নিয়ে আসতেই হবে এরকম ভাবনা থেকেই সেদিন রাতে টিম হোটেলে সুব্রতর ঘরের দরজায় নক করলাম।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুব্রত বাঘাদাকে উড়িয়ে আনার স্বপক্ষে কিছু যুক্তি দিলেন। আমিও আমার কথা বললাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমার যুক্তি মেনে নিল সুব্রত। এবার জানতে চাইলেন, অ্যামাউরি নেই। বাঘাদাকেও আনা যাবে না। তাহলে বিকল্প কে? আমি বললাম– স্যালিউ। সুব্রত প্রায় আঁতকে উঠেছিলেন! বললেন, স্যা-লি-উ। আসলে সেই সময় স্যালিউ খুব একটা ভালো ফর্মে ছিল না। ফলে তাঁর ওপর কোচের খুব একটা ভরসা ছিল না। চার্চিলের ঘরের মাঠে ইয়াকুবুর মুখের সামনে স্যালিউকে ফেলে দেওয়াতে খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না সুব্রত। কিন্তু আমাদের হাতে তখন স্যালিউ ছাড়া অন্য কোনও অপশন নেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দরজাটা অল্প ভেজানোই ছিল। দরজার বাইরে থেকে বললাম, ‘কোচ, ব্যারেটো…।’ ভিতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ এল– ‘কাম ইন।’ ঢুকে দেখলাম, সাদা রংয়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে খাটের উপর হালকা শোয়া কোচ। একটা বই পড়ছিলেন। আমাকে এমনিতে খুবই ভালোবাসতেন সুব্রত। অন্য কোনও এক অধ্যায়ে সুব্রত-সহ আমার কোচদের নিয়ে আলাদা করে বলা যাবে। এখন বরং সেদিনের গল্পটা বলি। কোচকে পুরো পরিস্থিতিটা খুলে বললাম। বাঘাদা খারাপ স্টপার নয়। কিন্তু আমরা দেখে এসেছি, সামান্য চোট রয়েছে। যে কারণে ভালোভাবে প্র্যাকটিস করতে পারেনি। এই অবস্থায় ইয়াকুবকে সামলানো সমস্যা হবে।
সুব্রত বাঘাদাকে উড়িয়ে আনার স্বপক্ষে কিছু যুক্তি দিলেন। আমিও আমার কথা বললাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমার যুক্তি মেনে নিল সুব্রত। এবার জানতে চাইলেন, অ্যামাউরি নেই। বাঘাদাকেও আনা যাবে না। তাহলে বিকল্প কে? আমি বললাম– স্যালিউ। সুব্রত প্রায় আঁতকে উঠেছিলেন! বললেন, স্যা-লি-উ। আসলে সেই সময় স্যালিউ খুব একটা ভালো ফর্মে ছিল না। ফলে তাঁর ওপর কোচের খুব একটা ভরসা ছিল না। চার্চিলের ঘরের মাঠে ইয়াকুবুর মুখের সামনে স্যালিউকে ফেলে দেওয়াতে খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না সুব্রত। কিন্তু আমাদের হাতে তখন স্যালিউ ছাড়া অন্য কোনও অপশন নেই। কোচকে বোঝালাম, স্যালিউ স্ট্রং চেহারা। পুরো ফিট। আমরা যদি ইয়াকুবর পিছনে স্যালিউকে পুলিশ ম্যান করে দিই, তাহলে কাজে লাগতে পারে। মোদ্দা কথা, আমরা স্যালিউকে ব্যবহার করতে চাই ইয়াকুবকে আটকানোর জন্য। বাকিটা আমরা উপরে বুঝে নেব। আমার যুক্তি মেনে নিয়ে স্যালিউকে কলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা জন্য সম্মতি দিলেন সুব্রত।
কলকাতা থেকে এসে স্যালিউ টিম হোটেলে ঢুকতেই আমার রুমে নিয়ে গেলাম। বললাম, চার্চিলের দশজন ফুটবলারকে ভুলে যেতে। এমনকী, মাঠের মধ্যে যদি ইয়াকুবু বাদ দিয়ে চার্চিলের বাকি দশজনকে দেখতেও না পায়, সেটাই ভাল হবে আমাদের জন্য। স্যালিউর চোখ থাকবে শুধুই ইয়াকুবুর প্রতি। মাঠের যে কোণে ইয়াকুবু যাবে, স্যালিউর কাজ থাকবে সেই খানে পৌঁছে ইয়াকুবুর শরীরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকা। ইয়াকুবু ঘুরলে স্যালিউ ঘুরবে। ইয়াকুবু হাঁটলে স্যালিউ হাঁটবে। ইয়াকুবু দৌড়লে স্যালিউ দৌড়বে। মানে, মাঠের ভিতর ইয়াকুবু যা করবে স্যালিউ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে। ইয়াকুবু যেন কোনও মতেই ‘ফ্রি’ না থাকতে পারে। আর বল নিয়ে স্যালিউকে অতিক্রম করতে না পারে। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে আলোচনার সময় স্যালিউ যে প্রশ্নটা করেছিল, তা বোধহয় মজার ছেলে স্যালিউর পক্ষেই সম্ভব। মাঠের ভিতর ওর কাজ সব শুনে টুনে স্যালিউ বলল, ‘মাঠের ভিতর তো বুঝলাম। কিন্তু ইয়াকুবু যদি কোনও কারণে মাঠ ছেড়ে বাথরুমে যায়। তাহলে আমি সেই জায়গায় কীভাবে মার্ক করব?’ আমিও পাল্টা বলে দিই, স্যালিউকে তাহলে ইযাকুবুর সঙ্গে বাথরুমেই যেতে হবে।
সেদিন যাঁরা মাঠে গ্যালারিতে ছিলেন, অথবা টিভিতে ম্যাচটা দেখেছেন, কারও কি স্যালিউর খেলা কিছু মনে আছে? সেদিন মাঠের ভিতর ইয়াকুবুকে ঘুরতে পর্যন্ত দেয়নি। আর তারপর? প্রভু যিশু বোধহয় এরমকটাই চেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে ইয়াকুবুকে ছেড়ে ওভারল্যাপে উঠে হেডে গোল করে দলকে শুধু জেতালোই না, মোহনবাগানকে জাতীয় লিগটাও জিতিয়ে দিল সেই স্যালিউ। আমি আর দেবাশিস দেখা হলে এখনও সেদিনের গল্পটা বলি আর হাসাহাসি করি। সত্যিই যদি সেদিন জোর করে স্যালিউকে কলকাতা থেকে উড়িয়ে নিয়ে না যেতাম, কী হত তাহলে?
অনুলিখন: দুলাল দে
(চলবে)
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব