সবুজ-মেরুন সমর্থকদের অগাধ আস্থা ছিল আমার ওপর। ক্লাব টেন্টে বসে দেবজিৎদের মুখে যখন ২৯ জুলাইয়ের গল্প শুনতাম, ভাবতাম মোহনবাগানের জার্সি গায়ে কত মহান কাজ করেছিলেন সেই ফুটবলাররা! না হলে যে শিল্ড জয় করা হয়েছিল ১৯১১-তে, সেই কীর্তি এখনও মানুষ মনে বয়ে নিয়ে চলেছে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে।
১২.
অনেক দিন বিরতি নিতে হল। মাঝে ব্রাজিলে চলে গিয়েছিলাম। তারপর রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের কাজ নিয়েও ব্যস্ত ছিলাম মারাত্মক। ফলে কলাম লেখা থেকে বিরতি নিতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। তবে ভেবেই রেখেছিলাম, ব্যক্তিগত কাজ শেষ হলেই ফের কলাম লেখা শুরু করব। ভেবে দেখলাম, ২৯ জুলাই থেকে ফের কলাম শুরু করলে কেমন হয়? বিদেশি হলেও আমি যে আসলে মোহনবাগানী, আর একজন মোহনবাগানীর জন্য ২৯ জুলাই এর থেকে পবিত্র দিন আর কিছুই হতে পারে না। তাই মনে হল, ‘মোহনবাগান ডে’ আদর্শ দিন ফের ‘তোতাকাহিনি’ শুরু করার।
আগের কলাম যেখানে শেষ করেছিলাম, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করি।
ডার্বির আগে খেলার মতো জায়গায় ছিলাম না। ম্যাচের একদিন আগে কলকাতায় এসেছি। সামান্যতম ফিটনেস নেই। কিন্তু ক্লাবকর্তা থেকে মোহনবাগান সমর্থক– সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ব্যারেটো যখন আছে, কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে। ওর বুঝতেই চাইছিল না, আবেগ আর যুক্তি এক নয়। তার ওপর ম্যাচটার নাম ‘ডার্বি’। আসলে সবুজ-মেরুন সমর্থকদের অগাধ আস্থা ছিল আমার ওপর। ক্লাব টেন্টে বসে দেবজিৎদের মুখে যখন ২৯ জুলাইয়ের গল্প শুনতাম, ভাবতাম মোহনবাগানের জার্সি গায়ে কত মহান কাজ করেছিলেন সেই ফুটবলাররা! না হলে যে শিল্ড জয় করা হয়েছিল ১৯১১-তে, সেই কীর্তি এখনও মানুষ মনে বয়ে নিয়ে চলেছে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে।
সালটা ঠিক মনে নেই। আমি তখন মোহনবাগানে শুরুর দিকে। পরে দেখেছি, এই সময়টায় কখনও কখনও আমি মরশুম শুরুর আগে ব্রাজিলে থেকেছি। কখনও প্র্যাকটিসে যোগ দিতে হবে বলে চলে এসেছি। সেবার প্রথমবার আমি এখানেই। কলকাতা লিগের জন্য প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্লাব থেকে বলা হল, বিকেলে অনুষ্ঠানে আসতে। মনে আছে, সকালে প্র্যাকটিস হয়েছিল আমাদের। ফলে বিকেলে না এসে অনুষ্ঠানে আসতে আসতে একটু বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। মাঠে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। গ্যালারি ভর্তি লোক। আর মাঠে ফুটবল খেলছেন প্রাক্তন ফুটবলাররা।
বহু প্রাক্তন ফুটবলারকে দেখেছি লনে আড্ডা দিতে। সকালে খুব একটা কেউ আসতেন না। বিকেলে প্র্যাকটিস থাকলেই তাঁদের আসতে দেখেছি। কখনও টেন্টের ভিতরে। কখনও লনে। আমাকে শুরু থেকেই প্রাক্তন ফুটবলাররা বেশ ভালোবাসতেন। তো সেই ২৯ জুলাই ‘মোহনবাগান দিবস’-এ প্রথম দেখি মাঠে প্রাক্তন ফুটবলারদের ম্যাচ হচ্ছে। আর আমি মাঠে ঢুকতেই গ্যালারি থেকে ‘ব্যারেটো… ব্যারেটো…’ আওয়াজ শুরু হয়ে গেল। অনুষ্ঠান বলে সমর্থকরা অনেকে মাঠের ভিতরেও ছিলেন।
…………………………………………………………..
সালটা ঠিক মনে নেই। আমি তখন মোহনবাগানে শুরুর দিকে। পরে দেখেছি, এই সময়টায় কখনও কখনও আমি মরশুম শুরুর আগে ব্রাজিলে থেকেছি। কখনও প্র্যাকটিসে যোগ দিতে হবে বলে চলে এসেছি। সেবার প্রথমবার আমি এখানেই। কলকাতা লিগের জন্য প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্লাব থেকে বলা হল, বিকেলে অনুষ্ঠানে আসতে। মনে আছে, সকালে প্র্যাকটিস হয়েছিল আমাদের। ফলে বিকেলে না এসে অনুষ্ঠানে আসতে আসতে একটু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। মাঠে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। গ্যালারি ভর্তি লোক। আর মাঠে ফুটবল খেলছেন প্রাক্তন ফুটবলাররা।
…………………………………………………………..
আমার শুরুর দিকের মোহনবাগান। গ্যালারি থেকে সমর্থকরা হুড়মুড়িয়ে মাঠে নেমে আসতে শুরু করল আমাকে ছোঁয়ার জন্য। এখনকার মতো সেলফি ছিল না তখন। সেই সময় ছিল অটোগ্রাফের যুগ। প্রাক্তন ফুটবলারদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। উৎসবের পরিবেশ বলে অনেকে পরিবার নিয়ে মাঠে এসেছিলেন। আমাকে দেখেই সমর্থকরা হুড়মুড় করে গ্যালারি থেকে দৌড় শুরু করল। যাঁরা খেলছিলেন না, সেরকম বেশ কয়েকজন প্রাক্তন ফুটবলারের সঙ্গে মাঠের পাশে তখন হাত মেলাচ্ছি। হঠাৎই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি গ্যালারি থেকে সব দৌড়ে আসছে। মাঠের মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও ততক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরবে বলে দৌড় শুরু করেছে।
ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই আমাকে ঘিরে ফেললেন সমর্থকরা। তখন আমার ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখন মনে নেই, কাঁরা আমাকে সেই ভিড় থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তবে একটু সুযোগ পেতেই দৌড় লাগিয়েছিলাম তাঁবুর দিকে। তারপর চুপ করে বসেছিলাম, টেন্টের ভিতর, ড্রেসিংরুমে। যখন খেলা শেষে মঞ্চে অনুষ্ঠান শুরু হল, কর্মকর্তারা আমাকে নিয়ে গেলেন অনুষ্ঠান-মঞ্চে। ফলে আর সবজ-মেরুন জনতার প্লাবনের মুখে পড়তে হয়নি। এতদিন শুনে এসেছি। সেই প্রথম ২৯ জুলাই ‘মোহনবাগান ডে’-র অনুষ্ঠান সামনে থেকে দেখলাম।
……………………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………………….
এরপরেও অনেকবার গিয়েছি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। আমি বিদেশি ফুটবলার, কিন্তু ‘মোহনবাগান দিবস’-এ ক্লাবে গিয়ে একবারও মনে হয়নি আমি বিদেশি। বরং অন্য ভারতীয় ফুটবলার যেভাবে ‘মোহনবাগান ডে’ পালন করে, আমিও সেভাবেই করেছি। আমাকেও সমর্থকরা সেভাবে বরণ করে নিয়েছেন।
‘মোহনবাগান দিবস’ একজন ভারতীয় ফুটবলারের কাছে যতটা আবেগের, আমার হৃদয়েও ঠিক ততটাই।
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১। ডার্বির আগের দিন ইস্টবেঙ্গল টিম হোটেলে আড্ডায় বসে গেলাম বাইচুংয়ের সঙ্গে
পর্ব ১০। ইংরেজি শেখাতে বাড়িতে আসতেন এক মোহনবাগান সমর্থক
পর্ব ৯। বারপুজোয় সমর্থকদের ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছিলাম টেন্টের দিকে
পর্ব ৮। মাঠে তো বটেই, ইয়াকুবু বাথরুমে গেলেও ফলো করবে স্যালিউ
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব