‘ফল’ শিরোনামের অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, ‘ফল জিনিসটা সমগ্র গাছের শেষ লক্ষ্য– পরিণত মানুষটি তেমনি সমস্ত সংসারবৃক্ষের শেষলাভ’। মানুষের পরিণতির সঙ্গে আমের মিল খোঁজা শুরু করেছেন প্রশ্ন দিয়েই– ‘কিন্তু মানুষের পরিণতি যে আরম্ভ হয়েছে তার লক্ষণ কী? একটি আমফল যে পাকছে তারই বা লক্ষণ কী?’
শান্তিনিকেতনে আমগাছগুলিতে এ বছর আম কম ধরেছে। এবারে তারা পাকতে শুরু করেছে। বাজারেও বেড়েছে আমের আমদানি। মনে পড়ল, আমের সঙ্গে মানুষের জীবনের তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ উপাসনাগৃহে তাঁর এক অভিভাষণে। বলেছেন, মানুষ চিরকালই গাছের ফলের সঙ্গে নিজের সার্থকতার তুলনা করে এসেছে। ভিতরের সাধনা আরম্ভ হলে বাইরে তার কিছু লক্ষণ টের পাওয়া যায়। ফলের মধ্যে মন দিয়ে দেখলে নিজের জীবনের পরিণামকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। ‘ফল’ শিরোনামের এই অভিভাষণে তাঁর বক্তব্য, ‘ফল জিনিসটা সমগ্র গাছের শেষ লক্ষ্য– পরিণত মানুষটি তেমনি সমস্ত সংসারবৃক্ষের শেষলাভ’। মানুষের পরিণতির সঙ্গে আমের মিল খোঁজা শুরু করেছেন প্রশ্ন দিয়েই– ‘কিন্তু মানুষের পরিণতি যে আরম্ভ হয়েছে তার লক্ষণ কী? একটি আমফল যে পাকছে তারই বা লক্ষণ কী?’
আম পাকছে বুঝতে পারি রং ধরতে শুরু করলে। গাঢ় সবুজ রং হালকা হতে আরম্ভ করে। কোনও এক প্রান্তে দেখা দেয় একটু হলুদের আভা। গাছের পাতার রঙের সঙ্গে একই রঙে মিশে আড়ালে থাকা আম যেন আলোর রং ধরতে চায়। রোদের সোনারঙে নিজেও যেন সোনা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। গাছের সঙ্গে নিজের রঙের পার্থক্যটা যেন তার নিজের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। শ্যামলতার আড়াল সরিয়ে আকাশের আলোয় সে যেন প্রকাশিত হতে চায়। ‘আমাদেরও ভিতরে যখন পরিণতি আরম্ভ হয় বাইরে তার দীপ্তি দেখা দেয়। কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়, কোথাও কালো কোথাও সোনা। তার সকল কাজ সকল ভাব সমান উজ্জ্বলতা পায় না, কিন্তু এখানে-ওখানে যেন জ্যোতি দেখা দিতে থাকে।’
………………………………………………………………………………………………………………………
‘সাধক তেমনি যখন নিজের ভিতরে নিজের অমরত্বকে লাভ করতে থাকেন, সেখানটি যখন সুদৃঢ় সুসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন তাঁর বাইরের পদার্থটি ক্রমশই শিথিল হয়ে আসতে থাকে– তখন তাঁর লাভটা হয় ভিতরে, আর দানটা হয় বাইরে।’
………………………………………………………………………………
রঙের বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমের বাইরেটা নরম হতেও শুরু করে। আগে যতটা আঁটি-শক্ত ছিল সেই কাঠিন্য কমে কোমল হয়ে আসে। দীপ্তিময় সুগন্ধময় সেই কোমলতা। সকলকে দেওয়ার জন্য নিজের মধ্যে যেন একটা প্রস্তুতি চলতে থাকে। সকলকে বাইরে ঠেকিয়ে না রেখে যেন সকলকে আহ্বানের প্রস্তুতি। যে তীব্র অম্লতা ছিল তার রসে তার তীব্রতা কমে মধুর হয়ে উঠতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষের মধ্যেও যা কিছু উগ্র, তীব্র, কাঠিন্যের প্রকাশ, তার কারণ গভীরতর সার্থকতার অভাব। সেই দৈন্য আনন্দেরই দৈন্য।
কোমলতা আর মাধুর্য যেমন বাড়ে, আমের বিভিন্ন অংশের বাঁধনও যেন আলগা হতে থাকে। তার শস্য বা শাঁস অংশের থেকে খোসা বা ছাল আলগা হয়, সহজে তখন তা ছাড়িয়ে নেওয়া যায়। আবার শাঁস আলগা হয় আঁটির থেকে, আলাদা হয়ে আসে। আর আলগা হয়ে আসে বোঁটা। গাছকে এতদিন সজোরে আঁকড়ে ছিল যে বোঁটা, নিজেকে গাছের সঙ্গে সেই অত্যন্ত এক করে রাখার চেষ্টা আলগা হয়। তেমনই নিজের যে বাইরের আচ্ছাদন, তার থেকেও বোঁটা আলগা হতে থাকে। বাইরেটা যত কোমল হতে থাকে, আমের ভিতরে যে আঁটি চোখের আড়ালে আছে, সে কিন্তু শক্ত হতে থাকে। যত শক্ত হয়, আর সব কিছুর থেকে আঁটি নিজেকে আলগা করতেও থাকে। শাঁসকে আর আগের মতো আঁকড়ে থাকে না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন আঁটিটাই আমের আসল জিনিস।
‘সাধক তেমনি যখন নিজের ভিতরে নিজের অমরত্বকে লাভ করতে থাকেন, সেখানটি যখন সুদৃঢ় সুসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন তাঁর বাইরের পদার্থটি ক্রমশই শিথিল হয়ে আসতে থাকে– তখন তাঁর লাভটা হয় ভিতরে, আর দানটা হয় বাইরে।’
আঁটি এখন নির্ভয়। ঝড় আসুক, পাখি ঠোকরাক, এমনকী, গাছ যদি শুকিয়েও যায়, আর ভয় নেই। নিজের নিত্যতার সন্ধান আম তার আঁটির মধ্যে পেয়েছে। এখন আর শাঁস-খোসা-বোঁটার অনিত্যতার মধ্যে নিজেকে দেখে না বলেই তাদের সম্পর্কে আর তার ভয় নেই, আসক্তি নেই। এদের মধ্যে নিহিত থেকেও সে এদের সম্পর্কে তখন নির্লিপ্ত। এদের ভালোমন্দের সঙ্গে তার ভালোমন্দ আর এক হয়ে নেই। এদের থেকে তার আর কিছু চাওয়ার নেই। সবই এখন বিনা প্রয়োজনের ঐশ্বর্য। এখন তার দেওয়ার আনন্দ।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রবিবার ডিজিটাল
………………………………………
‘তখন ভিতরে সে লাভ করে, বাইরে সে দান করে; ভিতরে তার দৃঢ়তা, বাইরে তার কোমলতা; ভিতরে সে নিত্যসত্যের, বাইরে সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের; ভিতরে সে পুরুষ, বাইরে সে প্রকৃতি। তখন বাইরে তার প্রয়োজন থাকে না বলেই, পূর্ণভাবে বাইরের প্রয়োজন সাধন করতে থাকে, তখন সে ফলভোগী পাখির ধর্ম ত্যাগ করে ফলদর্শী পাখির ধর্ম গ্রহণ করে। তখন সে আপনাতে আপনি সমাপ্ত হয়ে নির্ভয়ে নিঃসংকোচে সকলের জন্যে আপনাকে সমর্পণ করতে পারে। তখন তার যা-কিছু, সমস্তই তার প্রয়োজনের অতীত, সুতরাং সমস্তই তার ঐশ্বর্য।’
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করে
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব্যাখ্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।’
বর্তমানের ‘মাসি’ ছবির প্রচারকরা ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-কে আদ্যন্ত ভুল পড়ে। অথবা, স্করসেসে এবং ডি নিরোর ক্রিটিকালিটি অগ্রাহ্য করে তারা ট্র্যাভিসের মধ্যে তাদের ফ্যাসিস্ট টক্সিসিটির ম্যানিফেস্টো পেতে চায় বলেই তারা বলে যে তাদের সিনেমাটিক ব্রুটালিটির অন্যতম পূর্বসূরি ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’।