মানুষের আপন জগৎটি তার প্রাসাদেরই মতো। চারদিকের জগৎ নতুন থাকে অথচ তার মধ্যে মানুষের ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্রের জগৎ পুরনো হতে থাকে। মানুষের স্বাতন্ত্র তার ঔদ্ধত্যের শক্তিতে মত্ত হয়ে বিরাট প্রকৃতির থেকে ক্রমাগত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে আর ক্রমশ বাড়িয়ে তুলতে থাকে বিকৃতির জঞ্জাল। সেই জঞ্জালের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় বলেই তার ভিতর থেকে নবীন আলোয় বেরিয়ে আসা মানুষের পক্ষে এত প্রাণান্তকর কঠিন ব্যাপার।
‘এই-যে নববর্ষ আজ জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, এ কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে? আমাদের জীবনে কি আজ নববর্ষ আরম্ভ হল?’ রবীন্দ্রনাথের এই জিজ্ঞাসা ১৩১৮ পয়লা বৈশাখের সকালের উপাসনায়।
প্রতিটি সকালের মতোই বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি যখন প্রতি বছর আকাশপ্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ায়, আকাশভরা অন্ধকার কেমন অনায়াসে নিমেষে অপসারিত হয়, কোথাও কোনও দরজা ধাক্কাধাক্কি, ভাঙাভাঙি, ছিটকিনি খোলার শব্দটুকুও হয় না। আমাদের অন্তরে নূতনের প্রকাশ এত সহজে তো হতে পারে না। আমরা নিজেদের খানিক ভুলিয়ে রাখতে পারি। স্নিগ্ধ নির্মল ভোরের নরম আলোয়, পাখিদের কাকলির মাধুর্যে মোহিত হয়ে, খানিক আনুষ্ঠানিক নামগান ইত্যাদি করে, ভাবের আনন্দে খানিক ডুব দিয়ে নিয়ে আমরা মনে করতে পারি নববর্ষকে আমরা আমাদের জীবনে আহ্বান করতে পেরেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়; সে এমন শান্তির নববর্ষ নয়; পাখির গান তার গান নয়, অরুণের আলো তার আলো নয়। তার নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করে; আবরণের আবরণকে ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
জগতের মাঝখানে মানুষের নিজের একটি বিশেষ জগৎ আছে। তার মনের জগৎ। স্বাতন্ত্রের বেড়া তৈরি করে মানুষ নিজেকে নিজে যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। চিরপ্রকাশিত নবীনকে তাই মানুষ সহজে গ্রহণ করতে পারে না। তাকে চিন্তা করে গ্রহণ করতে হয়। বিশ্বের চিরনবীনতাকে একটি কোনও বিশেষ দিনে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে তবে তাকে উপলব্ধির চেষ্টা করতে হয়। তাই মানুষের পক্ষে নববর্ষ স্বাভাবিক ঘটনা নয়, নববর্ষকে অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে একটা কঠিন সাধনা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বিশ্বজগতে নববর্ষ চলেছে চিরপ্রবহমান নদীর মতো, নিত্যলোকের সিংহদুয়ার সেখানে চিরকালই খোলা, নবীনত্বের অমৃতধারা অবিশ্রাম প্রবাহিত হয়েই চলেছে। সেইজন্য কোটি কোটি বছরেও আকাশের বিপুল নীলিমার মধ্যে লেশমাত্র জীর্ণতার রেশ থাকে না। কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে নববর্ষের কোনও বিশেষ দিন না থাকলেও মানুষকে তা আরোপ করতে হয়। জগতের মাঝখানে মানুষের নিজের একটি বিশেষ জগৎ আছে। তার মনের জগৎ। স্বাতন্ত্রের বেড়া তৈরি করে মানুষ নিজেকে নিজে যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। চিরপ্রকাশিত নবীনকে তাই মানুষ সহজে গ্রহণ করতে পারে না। তাকে চিন্তা করে গ্রহণ করতে হয়। বিশ্বের চিরনবীনতাকে একটি কোনও বিশেষ দিনে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে তবে তাকে উপলব্ধির চেষ্টা করতে হয়। তাই মানুষের পক্ষে নববর্ষ স্বাভাবিক ঘটনা নয়, নববর্ষকে অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে একটা কঠিন সাধনা।
রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, ‘মানুষ যদিচ এই এই সৃষ্টর বেশিদিনের সন্তান নয়, তবু জগতের মধ্যে সে সকলের চেয়ে প্রাচীন। কেননা সে যে আপনার মনটি দিয়ে বেষ্টিত; যে বিশাল বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে চিরযৌবনের রস অবাধে সর্বত্র সঞ্চারিত হচ্ছে তার সঙ্গে সে একেবারে একাত্ম মিলে থাকতে পারছে না। সে আপনার শতসহস্র সংস্কারের দ্বারা, অভ্যাসের দ্বারা নিজের মধ্যে আবদ্ধ।’ নিজের রুচিবিশ্বাস-মতামতের দ্বারা সীমাবদ্ধ জগতে আটকে পড়ে মানুষ দেখতে দেখতে পুরনো হয়ে যায়। হাজার বছরের অরণ্য অনায়াসে শ্যামল থাকে, কিন্তু মানুষের নিজের তৈরি প্রাসাদ দেখতে দেখতে জীর্ণ হয়ে যায় আর লজ্জায় শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির আঁচলেই মুখ লুকোয়।
মানুষের আপন জগৎটি তার প্রাসাদেরই মতো। চারদিকের জগৎ নতুন থাকে অথচ তার মধ্যে মানুষের ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্রের জগৎ পুরনো হতে থাকে। মানুষের স্বাতন্ত্র তার ঔদ্ধত্যের শক্তিতে মত্ত হয়ে বিরাট প্রকৃতির থেকে ক্রমাগত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে আর ক্রমশ বাড়িয়ে তুলতে থাকে বিকৃতির জঞ্জাল। সেই জঞ্জালের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় বলেই তার ভিতর থেকে নবীন আলোয় বেরিয়ে আসা মানুষের পক্ষে এত প্রাণান্তকর কঠিন ব্যাপার। তার সযত্ন নির্মিত জঞ্জালের স্তূপকে রক্ষা করতে নিয়ত কত যুদ্ধ কত হত্যা কত সংগ্রাম। অসীম জগতের সহজ আলোয় বেরিয়ে আসা তার পক্ষে কঠিনতম কারণ যে অন্ধকার তাকে বিদীর্ণ করতে হয় সে যে তার স্বরচিত সযত্নপালিত অন্ধকার।
মানুষের মনুষ্যত্বের স্বাতন্ত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে প্রকৃতির লক্ষ-কোটি বছরের ধারাবাহিক সংস্কারের ভার। সৃষ্টির শেষ সন্তান বলেই মানুষ সকলের চেয়ে প্রচীন। সৃষ্টির যুগযুগান্তরের ইতিহাস, জড়ের উদ্ভিদের পশুর ইতিহাস একত্রে বহন করছে মানুষের মনুষ্যত্ব। এই সমস্ত মনুষ্যত্বের উপকরণকে যতক্ষণ মানুষ একটা উদার ঐক্যের মধ্যে সুসংগত সুসংহত করে তুলতে না পারছে ততক্ষণ এই উপকরণগুলিই তার মনুষ্যত্বের বাধা হয়ে থাকে। নিজের সচেতন মনের সাধনার শক্তিতে যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার বিরাট আয়োজনকে একটা মহৎ অভিপ্রায়ের সার্থকতার দিকে গেঁথে তুলতে না পারে ততক্ষণ সব এলোমেলো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে সুষমার বদলে কুশ্রীতার জঞ্জালে চারিদিক অবরুদ্ধ করে দিতে থাকে।
‘বিশ্বমানবের জ্ঞানের সাধনা, প্রেমের সাধনা, কর্মের সাধনা মানুষকে গ্রহণ করতে হয়েছে। সমস্ত মানুষ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আপনাকে চরিতার্থ করবে বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এইজন্যেই তার উপরে এত দাবি। এইজন্যে নিজেকে তার পদে পদে এত খর্ব করে চলতে হয়; এত তার ত্যাগ, এত তার দুঃখ; এত তার আত্মসংবরণ’।
মানুষের নববর্ষ শান্তির নববর্ষ নয়। দুঃখস্বীকারের, আত্মসংবরণের নববর্ষ।
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব