নেপাল এবং জাপান থেকে আঁকার নতুন পদ্ধতি তাঁর অন্ধত্বের সঙ্গে মিশিয়ে ফিরে এলেন বিনোদবিহারী। পশ্চিমের আধুনিক শিল্পধারার নিজস্ব ইডিয়মের সঙ্গে মেশালেন বিনোদবিহারী তাঁর ‘যে আঁধার-আলোর-অধিক’ থেকে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিকতা। নিঃসন্দেহে এই ফিউশন, এই তরল একীকরণ, বহন করল নতুন এক বিনোদবিহারীর জন্মচিহ্ন। এবং তাঁর অন্ধত্ব ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল জ্বলন্ত ফারনেস, সৃজনের বহ্নিময় অগ্নিকুণ্ড।
১০.
এই সিরিজের লেখাগুলো লিখতে লিখতে কখন যেন শুরু হয়ে গেছে আমার একান্ত ব্যক্তিগত আবিষ্কারের অভিযান! শিল্প, সংস্কৃতি, ভাবনার ভুবনকে যেন নতুন আলোয়, আবার নতুন আঁধারেও ভাবতে পারছি, দেখতে শিখছি।
মিল্টনকে ‘অন্ধ কবি’ বলে তেমনভাবে তো আগে কখনও ভাবিনি। কিন্তু ক’দিন আগে মিল্টনের অন্ধত্বের আলোকে যখন তাঁর মহাকাব্যগুলি দেখতে পেলাম, যখন মনে হল, অন্ধত্বই তো তাঁর লেখার টেবিল, তাঁর মননের নিলয়, তখন এই মহাকবির অন্তর ভুবনকে নতুনভাবে চিনতেও পারলাম। আর মুহূর্তে মনে পড়ল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের প্রাচীন গ্রিক অন্ধ কবি হোমারকে– যাঁর অন্ধত্বের সোনার ধান ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’। হোমারের যত প্রস্তরমূর্তি আমি দেখেছি, কোনওটাতেই নেই তাঁর চোখের তারা। তিনি চেয়ে আছেন। কিন্তু দেখছেন না কিছুই। ভুল বললাম। তাঁর বাইরের চোখ দেখছে না। দেখছে তাঁর অন্তরদৃষ্টি– দ্য ইনার আই। আর অমনি মনে পড়ে গেল, সত্যজিৎ রায়ের ‘দ্য ইনার আই’ তথ্যচিত্রটি, তাঁর অন্ধ অঙ্কন-শিক্ষক, কলকাতার বেহালার ছেলে, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে।
যত অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন, যত আঁধার নেমে আসছে তাঁর দৃষ্টিতে, ততই যেন ছবির সৃজনে বিনোদবিহারী উত্তীর্ণ হচ্ছেন নতুন নতুন মৌলিকতার মৌতাতে। অন্ধ লেখক না হয় বিপুল প্রতিভার তপ্ত তাড়নায় মুখে মুখে বলে যেতে পারেন প্রাণের কথা। কিন্তু অন্ধশিল্পী? যাঁর জন্য নিভে যাচ্ছে ক্রমশ রং, তুলি, রেখা, ক্যানভাস, নেমে আসছে অনিবার্য অন্ধকার– তাঁর পক্ষে কি সম্ভব ছবি আঁকা? কিংবা তৈরি করা দেওয়াল জুড়ে অবিশ্বাস্য সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনার মিউরাল বা দেওয়াল চিত্র। কিংবা না-দেখা আঙুলের সাহায্যে অন্ধ মানুষটি কি বানাতে পারেন বিচিত্র নরনারী বা দেবদেবী, বা আদিম বা আধুনিক প্রাণী?
সত্যজিৎ রায়ের ‘ইনার আই’-তে শান্তিনিকেতনে তাঁর আঁকার শিক্ষক বিনোদবিহারী বলছেন, ‘ব্লাইন্ডনেস ইজ আ নিউ ফিলিং, আ নিউ এক্সপিরিয়ান্স, আ নিউ স্টেট্ অফ বিয়িং।’ বিনোদবিহারী হেরে গেলেন না অন্ধত্বের কাছে। তিনি নতুনভাবে ভালবাসায় ফিরে এলেন তাঁর আঁকার টেবিলে। এবং টেবিলটির কাছে তিনি নতুন প্রার্থনায় আবিষ্ট ও ধ্যানস্থ হলেন: ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’–। আমায় অন্ধ করেছ, কিন্তু জ্বেলে রাখো আমার চৈতন্যের আলো, আমার প্রতিভার প্রাণন। বিনোদবিহারী পরাজিত হলেন না এই প্রবল প্রতিকূলতার সামনেও। হেরে ভূত হল মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তাঁর অন্ধত্বের পূর্ণগ্রাস! ৭৬ বছর বয়সে পৃথিবী ছাড়ার আগে পর্যন্ত তিনি সমানে কাজ করে গেছেন, কখনও এঁকেছেন ছবি, কখনও করেছেন বিশাল-বিশাল মিউরাল, কখনও গড়েছেন মূর্তি, কখনও ফলিয়েছেন অন্ধত্বের সোনার ফসল তাঁর মৌলিক ভাবনার নিখুঁত কলম-স্কেচে!
তিনি নন্দলাল বসুর প্রতিভাবান ছাত্রদের একজন। তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে সত্যজিৎ রায়ের অঙ্কনশিক্ষক। এবং ছেলেবেলা থেকেই একটি চোখ নষ্ট ছিল তাঁর। এবং অন্য চোখটির দৃষ্টি প্রবল মায়োপিয়ায় বিপুল বাধাপ্রাপ্ত। অতএব, এক ঝাপসা পৃথিবীর অধিবাসী তিনি ছেলেবেলা থেকেই। অথচ টেবিলে কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বসলেই বিনোদকে টেবিল যেন বলে, ছবি আঁকো বিনোদ, ছবি আঁকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই তোমার পৃথিবীতে। এই যে ঝাপসা পৃথিবীটা তুমি চারধারে দেখছ, গাছপালা-মাঠঘাট-আকাশ-পাখি-ফুল-মানুষ-গাড়ি-বাড়ি-নদী– তোমার মতো করে ভাব তুমি, যা তুমি দেখতে পাচ্ছ না, তা-ও আঁকো, সেটাই তোমার বাস্তব বিনোদ, সেই ছবি আর কেউ আঁকতে পারবে না। মনে রেখো, তোমার অন্ধত্বই হবে তোমার জয়ের অস্ত্র।
…………………………………………
একদিন টেবিলটা তাঁকে বলল, এই যে তুমি তোমার কুটিরে একেবারে একলা থাক ও অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ঠিক সব কাজ করতে পার, তুমি কি জান, অন্ধকারকে তুমি ছুঁতে পারছ, অন্ধকারকে ধরতে পারছ, বিনোদ অন্ধকার তোমার কাছে ‘সলিড’। তুমি যখন নিজের জন্য চা করো, কাপে চা ঢালো– এইসব কাজে অন্ধকারের হাত তুমি ধরতে পার। তুমি কাজে লাগাও তোমার ছবিতে অন্ধকারের এই নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব। সেইদিন টেবিলের দান সার্থক হল বিনোদের জীবনে।
…………………………………………
বিনোদবিহারী ছেলেবেলায় চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সূর্যের মতো বিরাজ করছেন সেখানে। কিন্তু সেই সূর্যের কাছে বিনোদ শিখলেন জীবনের সবথেকে জরুরি শেখা! সেই শিক্ষাটি, কী করে সমস্ত ভিড়ের মধ্যে নিজের কাজ ও ধ্যান নিয়ে একা হতে হয়। নন্দলাল বসু বিনোদবিহারীকে টেনে নিলেন নিজের আদরে, যত্নে ও উষ্ণতায়। বিনোদ ক্রমশ হারাচ্ছেন তাঁর চোখের দৃষ্টি। কোনও কিছু আঁকতে গেলে তাঁকে টেবিলের ওপর কাগজ পেতে তার ওপর প্রায় চোখ ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে আঁকতে হয়। বিনোদের মনে হয়, যত কমছে তার দৃষ্টিশক্তি, ততই তার ছবিতে জন্ম নিচ্ছে নতুন বাস্তব, যা বাইরের চোখ দেখতে পায় না, ভিতরের চোখ দেখতে পায়।
তাঁর ছবির সুনাম ও আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়ল কাঠমান্ডু থেকে টোকিও পর্যন্ত। তাঁর দেওয়ালচিত্র, তাঁর জলরঙের ছবি, তাঁর তৈলচিত্র, যে-ছবিই আঁকুন তিনি, অন্য একটা ডাইমেনশন আসছে, যা কারও ছবিতে আসে না, আসতে পারে না। ছানি অপারেশনের পরে ১৯৫৭ সালে সম্পূর্ণ দৃষ্টি হারালেন বিনোদবিহারী। আর আলোর কোনও চিহ্ন পর্যন্ত থাকল না তাঁর নিরেট অন্ধত্ব ও অন্ধকারে।
একদিন টেবিলটা তাঁকে বলল, এই যে তুমি তোমার কুটিরে একেবারে একলা থাক ও অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ঠিক সব কাজ করতে পার, তুমি কি জান, অন্ধকারকে তুমি ছুঁতে পারছ, অন্ধকারকে ধরতে পারছ, বিনোদ অন্ধকার তোমার কাছে ‘সলিড’। তুমি যখন নিজের জন্য চা করো, কাপে চা ঢালো– এইসব কাজে অন্ধকারের হাত তুমি ধরতে পার। তুমি কাজে লাগাও তোমার ছবিতে অন্ধকারের এই নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব। সেইদিন টেবিলের দান সার্থক হল বিনোদের জীবনে। বিনোদ বুঝলেন, ‘ব্লাইন্ডনেস ইজ আ নিউ স্টেট অফ বিয়িং’।
নেপাল এবং জাপান থেকে আঁকার নতুন পদ্ধতি তাঁর অন্ধত্বের সঙ্গে মিশিয়ে ফিরে এলেন বিনোদবিহারী। পশ্চিমের আধুনিক শিল্পধারার নিজস্ব ইডিয়মের সঙ্গে মেশালেন বিনোদবিহারী তাঁর ‘যে আঁধার-আলোর-অধিক’ থেকে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিকতা। নিঃসন্দেহে এই ফিউশন, এই তরল একীকরণ, বহন করল নতুন এক বিনোদবিহারীর জন্মচিহ্ন। এবং তাঁর অন্ধত্ব ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল জ্বলন্ত ফারনেস, সৃজনের বহ্নিময় অগ্নিকুণ্ড।
সত্যজিৎ রায়ের ‘দ্য ইনার আই’ ছবিতে সম্পূর্ণ অন্ধ বিনোদবিহারী দাঁড়িয়ে আছেন একটি পাঁচ ফুট উঁচু, ৬০ ফুট চওড়া দেওয়ালের সামনে। বিনোদবিহারীকে বলা হয়েছে দেওয়ালটি দৃষ্টিনন্দন করতে হবে বিশটি মিউরালের সাহায্যে। একটি কম-বেশি হলে চলবে না। এবং বিশটি মিউরাল যেন পরস্পরের সঙ্গে পৃথক হয়েও কোনও শিল্পিত বন্ধনে জড়িয়ে থাকে।
অন্ধ বিনোদ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন দেওয়ালটির দিকে, যা তিনি দেখছেন না। বা না দেখতে পেয়েও অনুভব করছেন। তারপর ধীরে ধীরে স্পর্শ করেন দেওয়ালটিকে, যেন বুঝে নেন দেওয়ালের মনের বাসনা, কীভাবে সাজতে চাইছে এই দেওয়াল। এবং কাঁচি আর কাগজ দিয়ে অন্ধ বিনোদ তৈরি করতে থাকেন কত রকমের মিশ্রিত ডিজাইন, মানুষ, ফুল, ফল, গাছ, প্রাণী, নদী, চিত্রিত বহতা! সেগুলি সব টাইলে রূপান্তরিত হয়। এবং শুধু হাত দিয়ে স্পর্শ করে সঠিক পারম্পর্যে টাইলগুলি দেওয়ালের গায়ে লাগাতে থাকেন বিনোদ! তৈরি হয় বিশটি পৃথক পৃথক দেওয়ালচিত্র। অথচ যারা পরস্পরের পরমাত্মীয়।
এই যে তারা আলাদা হয়েও হতে পারল আত্মীয়, এই একীকরণ কিন্তু সম্ভব করেছে বিনোদবিহারীর অন্ধত্ব। প্রত্যেকটি ছবির মধ্যে এমন একটা স্পিরিচুয়াল ডেসোলেশন, বা মানসিক শূন্যতা আছে, এমনকী কখনও-কখনও আছে বিষাদপ্রবাহ, যা বিনোদবিহারীর অন্ধত্বেরই উপহার।
এই বিবিক্ত বিষাদ আছে অন্ধ হোমারে। তার অন্য আর এক রূপ দেখা যায় দৃষ্টিহীন মিল্টনে। এবং আছে বেঠোভেন-এর সুরে, যে-সুর তিনি সৃষ্টি করেও কোনও দিন শুনতে পেলেন না তাঁর নিশ্ছিদ্র ব্যাপ্ত বধিরতার বাধার কারণে।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
মাঝে মাঝে একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে আমার চোখের সামনে। বেঠোভেন স্বরলিপি লিখছেন নিঃসঙ্গ টেবিলে বসে। তারপর সেই সৃজিত সুর তিনি নিখুঁত স্পন্দনে তুলে আনছেন পিয়ানোর বুক থেকে। কিন্তু তাঁর ভয়াবহ শ্রবণহীনতা পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে। তাঁর কালজয়ী সৃজনের কণাটুকু প্রবিষ্ট হতে পারছে না তাঁর নিজস্ব উপভোগে! ঠিক তেমনই বিনোদবিহারী দেখতে পাননি তাঁর নিজের অনেক অপূর্ব সৃষ্টি, সেই সব কালজয়ী সৃজনের কণাটুকুও তিনি নিজে উপভোগ করতে পারেননি! পথ আগলে দাঁড়িয়েছে তাঁর দৃষ্টির পূর্ণ লুপ্তি।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল